Site icon Shaili Tv

অচেনা গলি, অচেনা সন্ধ্যা / ইকবাল আহমদ খান

[আগে আমার গল্পটা পড়ে নিন, তারপর এটা নিখাদ গল্প, না কল্পনা, না ইলুশন, তার বিবেচনার ভার আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম।]

রোজই অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাতটা কখনো আটটা বেজে যায়। বাসায় যাওয়ার গলি সংকীর্ণ হওয়াতে গলির মাথায় নেমে পড়ি। তারপর কখনো হেঁটে হেঁটে অথবা গায়ে আলসেমি ভর করলে রিকশা চেপে বাসায় ফিরি। রিকশায় করে বাসায় পৌঁছুতে লাগে মাত্র ৫ মিনিট। গতকালও অফিসের গাড়ি থেকে গলির মোড়ে নেমে গেলাম যথারীতি।হেঁটে যাওয়ার মনস্থির করলাম মাত্র, ঠিক পরপরেই একটা রিকশা এসে দাঁড়ালো আমার পাশে, বললো -স্যার উঠুন। আমি কোনো কিছু আগপাছ না ভেবে মন্ত্র মুগ্ধের মতো রিকশায় উঠে বসলাম। ভাবলাম পাড়ার রিকশাওয়ালা, আমাকে হয়তো চেনে।তারপর মোবালাইল বের করে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এমনিতে কয়েকদিন যাবৎ গরম পড়ছে ভয়ানক রকমের। এসিওয়ালা গাড়ি থেকে নামার পর ভীম মার্কা অসহ্য গরম সারা শরীরটাকে চেপে ধরেছে।একটু পর অনুভব করলাম হিম শীতল বাতাস সারা শরীরে এসে লাগছে। ভাবলাম আকাশে মেঘ জমে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে পারে।অবাক হওয়ার কী ই বা আছে! খেয়াল করলাম ইন্টারনেট কাজ করছেনা ।মোবাইলের নেটওয়ার্কের দাগ শূন্যের কোটায়।পরক্ষণ মনে হল, অনেক্ষণ ধরেই তো রিকশায় চড়ছি, বাসায় তো পৌঁছে যাওয়ার কথা! ডান বাম মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম দোকান-পাট, ঘর-বাড়ি সম্পূর্ণ অপরিচিত, শুধু অপরিচিতই নয়,যেন নেপালের ভক্তপুরের কোন প্রাচীন গলিতে আমি চলে এসেছি। কতক্ষণ যাবৎ রিকশা ছুটে চলছে একদম ঠাহর করা যাচ্ছিলোনা। রিকশাওয়ালাকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘এই! তুমি আমাকে কোন এলাকায় নিয়ে যাচ্ছ? তুমি চেন না আমার বাসা?”, স্যার চিন্তা করবেন না,একটু পর পৌঁছে দিচ্ছি, মিহি গলায় উত্তর দিল।

পরিস্থিতি একদম বুঝে উঠতে পারছিনা, সাধারণত স্বপ্নে এধরনের অদ্ভূতুড়ে ব্যাপার ঘটে, আমি কি স্বপ্ন দেখছি না জাগরণে আছি? একপ্রকার ধন্ধে পড়ে গেলাম।হাতে চিমটি কেটে দেখলাম,ব্যাথ্যা ঠিকই অনুভূত হচ্ছে! আশেপাশের দোকান পাট রংবেরঙের! স্বপ্ন তো এমন মাল্টিকালার হয়না, স্বপ্ন যে আমি দেখছি না সে ব্যাপারটা মোটামুটিরকমভাবে নিশ্চিত হলাম। তাহলে আমি এখন কোথায় ? নেপালে গিয়েছিলাম সে তো দশ বছর আগে।নাকি কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? কিছুদিন আগে হেলথ চেকআপ করাতে গিয়ে ডাক্তার সাহেব কিছু ওষুধ পাল্টে দিয়েছিলেন। তাও তো দু’সপ্তাহের উপরে হলো।এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রিকশা থামিয়ে রিকশাওয়ালা বললো, স্যার একটু অপেক্ষা করেন , আমি একটু হয়ে আসছি, বুঝলাম ছোট কোন প্রকৃতির ডাক সাড়া দিতে যাচ্ছে। জায়গাটা বেশ জমজমাট।স্ট্রিট ফুড, নানা রকমের দোকান। অদ্ভুত মসলার গন্ধ নাকে এসে লাগছে, বেশ ঝাঁঝালো,মন্দ বলা যাবেনা কিন্তু একদম অচেনা।দোকানের বাতি গুলো কেমন নিষ্প্রভ, কমলা রঙের, কারো চেহারা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না। ডান পাশের একটা খাওয়ার রেস্টুরেন্টে দেখলাম শিক দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে তান্দুরীর মত আইটেম, অদ্ভুত রকমের আকার, না চিকেন না বীফ অথবা ফিশ, ভেতরে ভেতরে রিকশাওয়ালার ওপর মহা বিরক্ত হয়ে আছি।গেল তো গেল, ফেরার নাম গন্ধ নেই। মনে হচ্ছে বিরাট ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছি।

রাস্তার বাম পাশ থেকে ফিরতেই দেখলাম এক বার তের বছরের ফ্রক পড়া মেয়ে, হাতে কতগুলো মালা ঝুলিয়ে আমার দিকে আসছে। রিকশার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রিন-রিনে গলায় বলল, ‘স্যার! ভাবীর জন্য একটা মালা নিয়ে যান! রাতের বেলায় পরলে খুব মানাবে’।এমনিতে ঘোলাটে আধোভৌতিক অবস্থার মধ্যে যাচ্ছি, মাথা তিরিক্ষি হয়ে আছে। তারমধ্যে এরকম ভর সন্ধ্যায় রাতে পরার মালা বিক্রির অনুরোধ কার ভাল লাগে বলুন। বললাম-’না!. লাগবে না’।ছোট মেয়ে বলে এর চেয়ে কড়া ভাষায় কিছু বলতে পারছিনা। ‘নিন না স্যার একটা, দেখুন! কত সুন্দর’ বলে হাত উঁচু করে মালাগুলো আমার চোখের সামনে তুলে ধরলো, দেখলাম, ফুল তো নয়, যেন নিকষ কালো মাকড়সার মতো পোকা কিলবিল করছে।বুকটা ধক্ করে উঠলো। এধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো, কখনও ভাবেনি।নিজকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।মেয়েটি কান্না জুড়ে দিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল- ‘নিন না একটা স্যার,’।চোখে পানির বদলে টকটকে লাল রক্ত টপটপ করে পড়তে লাগল। ভীষণ ভীতিকর এক অবস্থা। ইত্যবসরে রিকশাওয়ালা হাজির। পাশ ফিরে মেয়েটিকে আর কোথাও দেখলাম না।ভোজবাতির মতো উধাও।রিকশাওয়ালাকে বললাম, মেয়েটি কে? তার চোখে রক্ত পড়ছে কেন?, স্যার এখানে চোখের পানি লালই হয়, আমাদের রক্ত সাদা। নিজেকে অসম্ভব বিপন্ন মনে হতে লাগলো। আচ্ছা এক ঝামেলায় পড়লাম দেখছি।রিকশাওয়ালা আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো মনে হয়। “স্যার! আমারই দোষ। আমি ভুল করে ভুল পেসেন্জার তুলে এনেছি। মাঝে মাঝে এমন ভুল হয়। আপনার মতো ভুল মানুষকে আমাদের পাড়ায় নিয়ে এসে, নিজেরাই বিপাকে পরে যাই”।” তুমি নীলপাড়া চেনোনা?”- আমি বললাম। চিনি স্যার, প্রত্যেক নীলপাড়ার সাথে আরেকটি নীলপাড়া থাকে, মানুষজন তা দেখেনা। মাঝে মধ্যে আমাদের ভুলের কারণে কেউ কেউ আমাদের দেখে ফেলে। আমরা চাইনা মানুষ আমাদের দেখে ফেলুক।আমরা কোন অশান্তি চাইনা। কী আর করা আমাকে সর্দারের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। হয়তো শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে”।

ক্রমেই পরিচিত গলির মুখে রিকশা এসে দাঁড়াল।রিকশা থেকে নেমেই মানিবেগ থেকে টাকা বের করেই দেখলাম, রিকশা সমেত রিকশাওয়ালা হাওয়া। সাথে সাথে পকেটে থাকা মোবাইলের রিং বেজে উঠল। আমার স্ত্রীর কল। ফোন ধরে কিছু বলার আগে, ও পাশে স্ত্রীর রাগত কন্ঠ স্বরে বলতে লাগলো – ‘এক ঘন্টার উপর ফোন বন্ধ করে কোন চুলোয় মরছো। বাসায় চিটাগাং থেকে মেহমান এসেছে, হোয়াটসআপে লিস্ট পাঠিয়েছি, কিনে দ্রুত বাসায় এসো’

Exit mobile version