আমরা একসাথে বুড়ো হবো।
..লেকের ধারে আমরা দুই বন্ধু। হঠাৎ রঞ্জু বলে উঠে …” রিনি।আমরা দুজন একসাথে বুড়ো হবো। “আমি হেসে বলি–” কিভাবে! তোর ভালোবাসার মানুষ আছে।ওর সাথে জীবন কাটাবি। তো!”
“তাতে কি! তোর সাথে দেখা হওয়ার আগে থেকেই ওর সাথে বলা যায় বাল্যপ্রেম! হ্যাঁ! ওকে ভালোবাসি। বাকি জীবন হয়তো ওর সাথেই। তবে জানিস! আফসোস হয়,কেন যে তোর সাথে আগে দেখা হলো না?”
আমি ওর চুল টেনে দিয়ে বলি–” আমরা ভালো বন্ধু। সুখের দুঃখের আনন্দের ও বেদনার।”
এক শরতের ভোরে শিউলী গাছের নিচে বসে মালা গাঁথছিলাম। দেখি বড়ো রাস্তায় ছেলেটা একেবারে জগিং করে হাঁটছে। ওর লম্বা শরীরটাকে দূর থেকে কি যে ছন্দময় মনে হচ্ছিল।
মাস তিনেক আগে গ্রামের স্কুল থেকে আসা এই মফস্বলে আসা ছেলে।ভর্তি হয়েছে এখানকার স্কুলে আমাদের ক্লাসে মানে নবম শ্রেণিতে। পরিচয় হলেও অনেকটা দায়সারাভাবে। কিন্তু সেই সকালে ওকে খুব ভালো লেগে গেল।এরপর থেকে বেশ গভীর। ক্লাসে মাত্র পাঁচটা মেয়ে,আর সবাই ছেলে। তাই আমরা চমৎকার এক নির্মল সম্পর্কে বড়ো হচ্ছিলাম।
রঞ্জু কিন্তু শহরে বেশ ওলট-পালট করে দিলো। আড্ডায় নিয়ে আসতো রাজনীতি। ও বামপন্থীর আদর্শের বিষয়টা বেশ ভালো ভাবে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল।একদিন তো ক্লাস পালিয়ে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে শহরের এপার ওপার। তবে শাস্তি ও পেতে হলো।
এরি মাঝে এস এস সি পরীক্ষা শেষ। সবাই মফস্বল শহর থেকে প্রায় সবাই নানা জায়গায়। তবে শেষ পরীক্ষার দিন বিকেলে রঞ্জুআবারও বললো–“রিনি! আমরা কিন্তু একসাথে বুড়ো হবো। “আমি শুধু হেসেছি।তবে ভেতরে ওর জন্য এক গভীর মায়া।
কেটে গেছে প্রায় বিশ বছর!মাঝখানে কতকিছু ঘটে গেলো।আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। আমিও স্বামীর সাথে প্রবাস কাটিয়ে আবারও দেশে।
ছেলে ছোটকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় ফিরছি।হঠাৎ চেনা এক কন্ঠ –” রিনি!”।
চেনা চেনা কিন্তু তবুও অচেনা। মধ্য তিরিশের এক ভদ্রলোক। “আমাকে চিনতে পারলে না? আমি ঠিকই তোমায় চিনেছি “। তখনি যেন তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে–” রঞ্জু!”
“তুমি একজায়গায় থির হয়ে আছো রিনি! কিভাবে!”
ওকে নিয়ে বাসায় এলাম। ঢাকায় থাকে ও।ব্যবসার কাজে চট্টগ্রামে।ফিরোজ মানে আমার জীবন সঙ্গী বাসায় না ফেরা পর্যন্ত ওকে আটকে রাখলাম। ও এলে জম্পেশ আড্ডায় রাত প্রায় দশটা।ট্রেনে ওকে তুলে দিয়ে অবশেষে বাসায়। বিদায়ের এক অবকাশে–“রিনি! বলেছিলাম না,আমরা একসাথে বুড়ো হবো। ”
সময়ের প্রবাহে দুই পরিবারে বেশ বন্ধু ত্ব। আসা যাওয়া, ঢাকা ও চট্টগ্রামে। আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে।
আরো একট ঘটনা আকষ্মিক ভাবে ঘটে গেলো।বড়ো ছেলের ভর্তির জন্য ভারতে। আমি আর ছেলে।ওর বাবা জরুরি কাজে আটকে গেছে।অতএব রঞ্জুর পুরো পরিবার।কিন্তু আকষ্মিক ভাবে রঞ্জুর জীবন সঙ্গী ডলির বড়ো বোন হঠাৎ হাসপাতালে। কিন্তু এমন এক পরিস্থিতি, যাওয়া বাতিল করলেই আমার ছেলে শুধু না ওর একমাত্র সন্তানের চিকিৎসকের সাথে দেখা করার সময়সূচি ও বাতিল হয়ে যাবে। দূর্ভাগ্যবশত ছোট বেলায় পোলিও আক্রান্ত হয়ে ভুল চিকিৎসায় অনেকটা প্রতিবন্ধী।
দেশে ফেরার আগের বিকেলে আমরা সবাই ভিক্টোরিয়া মিউজিয়ামে। আমাদর দুই ছেলে ভেতরে তখন, আমরা দুজন বাইরে ঘাসের গালিচায় বসে। মনোরম প্রকৃতি, মৃদুমন্দ হাওয়ায় দু’জনে ভাসছি কৈশোরের ভেলায়।হঠাৎ!
হঠাৎ! রঞ্জু কাতর স্বরে-” রিনি আমরা কিন্তু বুড়ো হচ্ছি একসাথে। তাই না!” তারপর! ” রিনি! শুধু একবার তোমার হাতে আমার হাত রাখতে দেবে!”
আহা! কেন যে হঠাৎ আমি বেশ কঠিন গলায় বললাম -“না –রঞ্জু!”
বড়ো এক ছন্দপতন ঘটে গেল।
রাতে সবাই খেতে এলাম হোটেল আম্বারায়। পরিবেশটা একেবারে অন্যরকম,আমরা অভ্যস্ত নই। খোলামেলা রঙিন পানীয়ের সাথে হালকা পানীয়ও।
অবাক কান্ড! রঞ্জু অবলীলায় রঙিন পানীয়ের ভেতরে! যখন হোটেলের দিকে বড়ো রাস্তায়। আমরা টেক্সির জন্য অপেক্ষায়। বাতাসে ভেসে আসছে চাঁপাফুলের সুবাসে মনের ভেতরে কেমন এক গভীর অনুভূতি। যার কোন ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। আমি যেন সমর্পিত অসহায় ভাবে।ইচ্ছে হচ্ছিল রঞ্জুকে বলি-” বন্ধু!তোমার হাতটা দাও।আমরা একসাথে হাত ধরাধরি করে হাঁটি।”
কিন্তু পারলাম না। পরের দিন চলে এলাম আমি একা ছেলেকে নিয়ে।ও আসবে আরও বেশ কয়েকদিন পরে।
দিন এগিয়ে যায়, বদলে যাও কতকিছু। আমরা দুই পরিবারের সম্পর্কেও কোন চিড় ধরেনি।যেন আগের মতোই সব কিছু। রঞ্জুও স্বাভাবিক।
হঠাৎ পুরো বিশ্বে লন্ডভন্ড করে এলো মহামারি! কোভিড নামে এই ভয়ংকর ভাইরাসে শুধু মৃত্যুর মিছিলে আমরা ঘরবন্দী। ইতিমধ্যে হারিয়েছি অনেক আপনজন।
টেলিফোনে রঞ্জুর ছেলে অমি।আমি ব্যাকুলভাবে সবার কথা জিজ্ঞেস করছি।ও অনেকক্ষণ নিশ্চুপ! এরপরে –“আন্টি! বাবা হাসপাতালে। কিডনি দুটোই প্রায় অকেজো। কলকাতা থেকে আসার পরেই প্রায় ড্রিংক করতো। মাঝেমধ্যে খুব বেশি।অতঃপর কিডনি দুটোই প্রায় শেষ!” গভীর বেদনায় বলি-“আমাকে জানালেনা কেন!”
আবারও নিশ্চুপ! এরপরে –“বাবার নিষেধ! ”
আবারও –“আন্টি! তুমি কি একবার ঢাকা আসতে পারবে! ”
“কেন!” ও এবারে গভীর দীর্ঘশ্বাসে–“বাবা! কেবলই বলছে! আমি রিনিকে শুধু একবার দেখতে যাবো!”
“আহা! অমি! অমি!এখন যে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস!”
ওহ! ওহ! কিভাবে ওকে দেখতে যাই! কিভাবে! আমরা যে মৃত্যুকূপে সবাই।
——-চারদিন পরে –অমির ফোন।”আন্টি! বাবা আর নেই। “নেই। ও আর নেই। কেনরে রঞ্জু! বলেছিলি-” আমরা একসাথে বুড়ো হবো।
সত্যিই তো বলেছিলি। আমরা একসাথে প্রায় বুড়ো হচ্ছিলাম,কিন্তু এতো আাগে তুই চলে গেলি! কেন! কেন!