পঁয়ষট্টি উর্ধ্ব লতিফ সাহেবের চোখে আনন্দাশ্রু। আজ তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখের দিনগুলোর মধ্যে একটি। একটু আগে তিনি দুই দুইটা মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েদের বিদায় দিয়ে নিজের ঘরে বসে স্ত্রীর সাথে বিয়ের খুঁটিনাটি নিয়ে আলাপ করছেন। বিয়ে উপলক্ষে কেনাকাটা থেকে শুরু করে রান্না বান্না সব কিছু নিজে তদারক করছেন। গতরাতে গায়ে হলুদে তিনি অনেক মজা করেছেন। মেয়েদের সাথে মিলিয়ে তিনি ও তাঁর স্ত্রী একই রংয়ের জামা কাপড় পরেছেন। সাথে সব কিছু দেখভালও করেছেন। মেহমানদের জন্য আয়োজনে কোন কিছুর কমতি করেননি। এর আগেও তিনি শ্বশুর হয়েছেন তবে আজকের মত অনুভুতি কখনো হয়নি। আগে শ্বশুর হয়েছিলেন নিজের সন্তান বিয়ে দিয়ে আর আজ শ্বশুর হয়েছেন অন্যের সন্তান বিয়ে দিয়ে। যাদের কোন জন্ম পরিচয় নেই বা কেউ জানে না। তাই আজকের বিয়েতে তিনি অনেক বেশী টেনশনে ছিলেন। আজকে যাদেরকে বিয়ে দিয়েছেন এই রকম আরো বাইশটা বিভিন্ন বয়সের মেয়ে এখনো বিয়ের বাকি আছে। মেয়েগুলোকে উনি জন্ম না দিলেও ওরা তাঁর নিজের সন্তানের মতই প্রিয়। মেয়েগুলোর জন্য এই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি স্বপ্ন দেখেন ও আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে চান। এই মেয়েগুলোর থাকার জন্য আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি আশ্রয়কেন্দ্র। যেখানে সমাজের পরিচয়হীন ও অনিরাপত্তায় থাকা মেয়েদের থাকা,খাওয়া ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে লতিফ সাহেব একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, জীবনে অনেক সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।এখনো প্রতিদিন সময়মত অফিসে করেন। অনেক টাকা পয়সা আয় করেছেন। শহরে তিন তিনটা বাড়ী করেছেন। গ্রামেও অনেক জায়গা সম্পত্তি কিনেছেন। ছেলেমেয়েদেরকে উচ্চতর লেখাপড়া জন্য উন্নত বিশ্বে পাঠিয়েছেন। ভেবেছিলেন লেখাপড়া শেষ করে সন্তানেরা দেশে চলে আসবে। কিন্তু তাঁর তিন সন্তানই স্ত্রী/স্বামী ও সন্তান নিয়ে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখে দেশে ফিরে আসুক কিন্তু তারা লেখাপড়া শেষ করে কানাডা/আমেরিকায় স্হায়ীভাবে থেকে গেছে। ১-২ বছর পর পর দেশে আসে, এসে ১৫-২১ দিন থেকে আবার চলে যায়। লতিফ সাহেব ওদেরকে বলেছেন স্থায়ীভাবে দেশে চলে আসতে কিন্তু তারা কেউ স্থায়ী ভাবে আসতে রাজি নয় বরঞ্চ তারা চায় লতিফ সাহেবও যেন ওদের সাথে গিয়ে বিদেশে স্থায়ীভাবে থাকেন। কিন্তু ওসব দেশের কালচার লতিফ সাহেবের পছন্দ নয়। গত দশ পনের বছরে অনেকবার ছেলেমেয়েদের দেশে ফেরত আসার জন্য বুঝিয়েছেন কিন্তু তারা ঐ সব দেশ ছেড়ে আসবে না।একবার কথা প্রসঙ্গে ছেলে ওনাকে বলেছিলো “ব্লাডি ওল্ডম্যান”। এটা শুনার পর তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। মনে মনে পন করেছিলেন জীবনে কখনো ওসব দেশে গিয়ে স্থায়ী ভাবে থাকবেন না।দেশে এসে শেষবারের মত সন্তানদের মনোভাব জানতে চেয়েছিলেন, ওরা দেশে স্থায়ীভাবে আসবে কিনা। তারা বলেছে, তারা দেশে স্থায়ীভাবে আসবে না। কারণ তারা ঐ সব দেশে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা লতিফ সাহেবকে আরো বলেছেন, দেশের সব সম্পদ বিক্রি করে তিনি ও তাঁর স্ত্রী যেন ওখানে চলে যান। ছেলে মেয়েদের থেকে এটা শোনার পর তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন, সারা জীবনের কষ্টার্জিত এই সম্পদ দিয়ে তিনি কী করবেন, কার জন্য রাখবেন কিংবা সন্তানদের অবর্তমানে কিভাবে বৃদ্ধ বয়সে স্বামী স্ত্রী একাকী থাকবেন। চিন্তা করে দেখলেন, তাঁরা মারা গেলে সন্তানেরা এইসব সম্পদ বিক্রি করে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাবে। হয়ত এক সময় মৃত পিতা মাতাকে আর মনেও রাখবে না।এভাবে অনেকদিন ধরে চিন্তা করার পর সিদ্ধান্ত নিলেন সমাজের অসহায় মানুষ বিশেষ করে রাস্তা ঘাটে থাকা অসহায় ও অনিরাপত্তায় ভোগা মেয়েদের জন্য একটা আশ্রয় কেন্দ্র করবেন। যেন তিনি মারা গেলেও কেউ না কেউ তাঁদেরকে মনে রাখে বা তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখে। তাই দশ বছর আগে শহর থেকে একটু দূরে কম দামে কিছু জমি কিনে ওখানে একটা পুকুর, চারিদিকে ফলেরসহ কিছু গাছ গাছালি ও অবহেলিত মেয়েদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র করেছিলেন। প্রথম প্রথম ঐ কাজটি করতে গিয়ে ছেলে মেয়েদের প্রচন্ড বাধার মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর দৃঢতার জন্য ওদের বাধা সফল হয়নি। এতে ছেলে মেয়েরা এখনো তাঁর উপর চরম অসন্তুষ্ট। পরে স্থানীয় আরো অনেকের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছিলেন।কিন্তু তাাঁর মানসিক দৃঢ়তার জন্য শেষ পর্যন্ত তিনি আশ্রয় কেন্দ্র করতে পেরেছিলেন।এই কেন্দ্রটির জন্য তিনি শহরের একটা বাড়ী উইল করে দিয়েছেন, যেন তিনি মারা গেলেও ঐ বাড়ীর ভাড়া দিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রটির খরচ চলে। বাকী বাড়ীও সম্পদগুলো সন্তানদের জন্য রেখে দিয়েছেন, যদি কখনো তারা দেশে আসে এই আশায়। বর্তমানে ওনার আশ্রয়কেন্দ্রে ২৪ জন বিভিন্ন বয়সের মেয়ে থাকে, যার মধ্যে দুই জনকে আজ বিয়ে দিয়েছেন।এখন তিনি আশ্রয়কেন্দ্রের পাশেই ডুপ্লেক্স একটা বাড়ী করে থাকেন। আগে শহরের বাড়ীতে থাকতেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে অনেক দিন বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। তাঁর অসুস্থতার খবর শোনার পর আত্মীয়স্বজন বা ছেলেমেয়েরা দুই একটা ফোন করে খোঁজ খবর নিয়েছে কিন্তু কেউ দেশে আসে নাই বা তাঁর কাছে থাকে নাই। অথচ ওনার অসুস্থতার খবর শুনার পর আশ্রয় কেন্দ্রের ৩-৪ জন মেয়ে গিয়ে রাত দিন পালা করে তাঁর সেবা যতœ ও নিরলস পরিশ্রম করে ওনাকে সুস্থ করে তুলেছেন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি আশ্রয় কেন্দ্রের পাশে বাড়ী করে চলে আসেন।এখন প্রতিদিন বিকালে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে বাগানে সময় কাটান।এই পরিচয়হীন বাচ্চা গুলোর সাথে হাঁটেন, গল্প করেন ও খুনসুটিতে মেতে ওঠেন। তারাও তাঁকে খুব সম্মান করে ও ভালোবাসে। তারা যে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসে তা আজ তিনি অনুধাবন করতে পেরেছেন। মেয়ে দুটোকে স্বামীর বাড়ীতে বিদায়ের সময় একটা মেয়ে তাঁদেরকে কেঁদে কেঁদে বললো, আমরা জীবনে বাবা মা দেখি নাই। বাবা মায়ের আদর কেমন সেটাও জানি না। জীবনে ফেরেস্তা বা বিধাতাকে দেখি নাই। কিন্তু আপনাদেরকে গত দশ বছর ধরে দেখেছি। মনে হয়েছে আপনারাই আমাদের বাবা মা, যারা আমাদের জীবনে বিধাতার মত হয়ে এসেছেন। মেয়েটা আরো বললো, বাবা মাকে কাছে না পাওয়াটা আমার জন্য আশীর্বাদ কারণ আমরা আপনাদের মত মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। যেটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। মেয়েটি আরো বললো, আমাদের সমাজ আজো টিকে আছে আপনাদের মত মানুষ আছে বলে।এই কথা বলে মেয়েটি তাঁদেরকে জড়িয়ে ধরেছিলো। তিনি তাঁর স্ত্রী দুইজনই তখন আবেগপ্রবণ হয়ে কেঁদেছেন।
ভেবেছেন এতদিন ধরে তাঁরা এই আশ্রয়কেন্দ্রটি নিয়ে যে কষ্ট করেছেন তার প্রতিদান আজ মেয়েটির কান্না ও ভালবাসা পেয়ে গেছেন। যার রেশ এখনো রয়ে গেছে।