শেষ বিকেল। বেলা তিনটা বাজে।
শীতটা আগেভাগেই ঝাঁকিয়ে বসেছে। করিমন বিবি বাড়ীর পেছনের বিলে পিটটা একটু তাতিয়ে নিতে বসেছে। রোদটা ভালোই লাগছে। খোলা পিট। সারাদিন সময় হয় না। সেই সকালে উঠে সংসারের খাটাখাটুনি। গরু ছাগল গুলোকে বার করে বিলে খুটা গেড়ে বেঁধে দিয়ে আসতে হয়। তারপর মাটির ভিটার সাথে গর্ত করা দু’টো বাসা থেকে হাস-মুরগীগুলোকে বের করে। আয়—আয়—থৈ—থৈ—থৈ—কৎ—কৎ—কৎ—করে ডাকতে ডাকতে হাঁস মুরগীগুলোকে বের করে। শীতের দিন। হাঁস-মুরগীগুলো সহজে বের হতে চায় না। খুব সাবধানে কোনটার গলা ধরে টেনে বের করে আনতে হয়। তারপর অন্ধকার গর্তে প্রায় মাথার অর্ধেকটা ঢুকিয়ে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয়। আজ দুটো মুরগী ও তিনটা হাঁসের ডিম পেয়েছে। ডিমগুলো শাড়ির এককোণায় বেঁধে রাখে। হাঁস-মুরগীগুলো করিমনের আসে পাশে ঘুর ঘুর করে। পুকুরের দিকে তাড়িয়ে দিলেও যায় না। কৎ—কৎ—কৎ করে গোঁ ধরে বসে থাকে। মুরগিগুলোও তাই। করিমন চেঁচিয়ে উঠে। বুজ্জি খ’অন ছাড়া লড়তি’ন। উডা’নত আঁ’ডি আঁ’ডি ধান পরি রই’য়ি। হে’গুন খা’গুইছেনা। না, নবাব’র বাইচ্ছা’অল হিয়ুন খাইত’ন। কঁত্তে আঁই খুদ-কুড়া দু’আ মাখি দিইয়ুম। হি’য়ুন খাইয়েরে বাইর হইবু। আঁর ক্যান সোনার রাজপুত’রে!
করিমন হাসে। বারান্দার চালের বস্তা থেকে দুই মালা কুড়া আর অল্প খুদ গামলায় নিয়ে জল দিয়ে মেখে দেয়। তাই হাঁস-মুরগিগুলো পরম আনন্দে টক—টক—করে খেয়ে নেয়। তারপর আর তাড়াতে হয় না। কেউ পানিতে কেউ খড়ের গাদায় মুখ চুবিয়ে ইচ্ছে মতো খাবার খুটে খুটে খায়। এখন ধান কাটার মৌসুম। তাই দুপুরে আলাদা করে খাবার দিতে হয় না। করিমন ডিমগুলো ঘরের মধ্যে একটা বেতের ঝুড়িতে সাবধানে বসিয়ে রাখে। আজ সোহেলিকে হাটে পাঠাবে বিক্রি করার জন্য। হাটে দেশি ডিমের কদরটাও বেশী। দামও একটু বাড়তি। এই শীতে ধান খাওয়া হাঁসের ডিমগুলো খেতে যেমন স্বাদ তেমনি বেশ একটু বড়ও।
কেরামত ততক্ষনে কাঁচি নিয়ে তৈরি। সকালে ঘুম থেকে উঠে। হাতে নিমের কালো মাজনটা নেয়। নাকে মুখে উলের কম্বলটা জড়িয়ে জমির পাড় থেকে ঘুরে আসে। মসজিদে ফজরের নামাজ পড়েছে। বাড়ি এসে ধানের গাদার পাশে বসে করিমনকে বলছে, অ’বউ, খাইবার কিছু থাই’লি দে’অ। রইদ উডি যারগ’ই ত। করিমন হাত মুখ ধুয়ে আসে। রান্না ঘরে ঢুকে। কেরামতকে একথালা পানিভাতের সাথে দু’টো শুকনো মরিচ আর লবন খেতে দেয়।
প্রতিদিন শুকনো মরিচ দিয়ে পানিভাত আর ভালো লাগনো। ভালো না লাগলেও খেতে হয়। আজ তবুও একটা ডিম ভেজে দেওয়ার কথা বলছিল। তাতে করিমন রাজি হয়নি। বলেছে, এই মাস’ত ছোড মায়াওয়া নোয়া কেলাস’ত যাইবু, ঠ্যায়া পইসা লাগিবু। রেশমি’রে ত পড়াইত ন’পাইরলাম। আল্লাহ আল্লাহ গড়ি বিয়া’আন হই গেইলি বাঁচি। সোহেলি’রে যেন গড়ি পারি লেখাপড়া গরাইয়ুম। হাত’ত ট্যায়া পইসা ন’থাকিলি ত ভর্তি হইত ন’পারিবু।
কেরামত আর কিছু বলেনি। লইট্ট্যা শুকটি পুড়ে পানি ভাত দিয়ে খেতে খুব ইচ্ছা করছিল। ঘরে লইট্ট্যাশুকটি যে নাই, তা কেরামত ভালোই জানে। তাই আর কিছু বলেনি। আজ হাটবার। বিকালে হাট থেকে লইট্ট্যাশুকটি নিয়ে আসবে। খাওয়ার পর কম্বলটা খুলে রেখে বলল-কাঁথা কম্বলগিন এক্কানা রইদ’ত মেলি দিছ। রাতিয়া বেশী ঠান্ডা লাগে। কেঁথা’ত উমে ন’ধরে।
কেরামতের এই একটাই কম্বল। রাতে গায়ে দেয় আবার সকালে চাদর হিসাবে ব্যবহার করে। দুইটা মোটা কাঁথা। একটা মাত্র ঘর। রাত হলে বেড়ার ফাঁক দিয়ে শিড়শিড়ে ঠান্ডা বাতাস শরীরে কাঁপন তুলে। সন্ধ্যা হলেই মোটা চাটাইয়ের উপর কাঁথাগুলো পেতে দেয় রেশমি আর সোহেলি। গেল বর্ষায় শীতের কথা ভেবে করিমন নিজের হাতে সেলাই করেছে। মাঝখানে ছালার ছট রেখে দু’পাশে ছেড়া কাপড়ের টুকরো দিয়ে তালি দিয়েছে। তাও পাড়ার রহিমার মার থেকে ছেঁড়া কাপড়গুলো চাইতে গিয়েছিল। বিনিময়ে একবেলা রহিমার মা’র সাথে ঢেঁকিতে চিড়া ভাঙ্গিয়ে দিতে হয়েছে। সেই সাথে দু’মুঠো চিড়া কাপড়ের আঁচলে বেঁধে দিয়েছে রহিমার মা। সেইদিন নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে একটা ছোট রুই মাছ ধরেছিল কেরামত। বউকে বলেছিল মাথাটা দিয়ে মুড়িঘন্ট রান্না করতে। করিমন নাক সিটকালেও কেরামতের কথা ফেলতে পারেনি। শেষমেষ চুড়া দিয়ে মুড়িঘন্ট রান্না করেছিল। সেই যে মুড়িঘন্ট খাওয়া। এখনও খেতে বসলে কেরামত মাঝে মধ্যে মুড়িঘন্টর কথা বলে। আশ্বাস দেয়, আবার যদি কখনও বড় একটা রুই মাছ পায় তাহলে যেন সেদিনের মত আবার মুড়িঘন্ট রান্না করে।
স্বামী কেরামতের মনটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে। মেয়ে দুটো আড়াল হলেই এক-আধটু আদর সোহাগের কথা বলে। স্বপ্ন দেখে। বউকে স্বপ্ন দেখায়। বড় মেয়েটার বিয়ের কথা বলে। দেখতে দেখতে মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। বিয়ে দিতে হবে। চিন্তারও শেষ নেই। ভাবতে ভাবতে কেরামত নিজের মাথায় হাত বুলাই। মেয়েটার গায়ের রং পেয়েছে ঠিক ওর মার মত। শ্যামলা ঘন কালো লম্বা চুল। মুখের আদলটা শুকনো হলেও চোখগুলো মায়াবি। করিমনের যেমন কথা, মায়াওয়া’ত ঠিক মত’ন খাইত পরিত ন’পাড়ের। গরিব’র ঘর’ত জনম। ক্যান গইজ্জুম। ভালামন্দ দু’আ পেড ভ’রি খাবাই’ত পাইরলে আঁ’র মায়াঅ’ত রাজার মায়াপোয়ার’নান হইতু। বিয়া হইলি, পেড ভরি দু’আ খাইত পাইরলি বেয়াক ঠিক অই যাইবু’গই।
অঘ্রাণের ধান কাটা চলছে। আজকের সুরেন ঠাকুরের পশ্চিমের জমিটার ধান কাটা হলে শেষ হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি পানিভাত খেয়ে সোহেলিকে নিয়ে বের হয়েছে কেরামত। সুরেন ঠাকুরের ডোবার পাশে অনেকগুলো কলমিশাক লিক লিক করে বেড়ে উঠেছে। কী সুন্দর কচি কচি পাতা! করিমনের কলমিলতা খুব পছন্দ। চালের গুড়া মিশিয়ে কাচামরিচ দিয়ে খুব সুন্দর করে বড়া বানাতে পারে। খেতেও বেশ। সকালে কলমিলতাগুলো দেখে এসে বৌকে বলেছে।
জমিতে এখনও চার আঙ্গুল পানি। ধানও ভালো হয় না। বর্গা জমি। বীজতলার জন্য জমিটা রেখে দিয়েছে। কয়েক আড়ি ধান পেলেও মন্দ কী? আউশটা ভালো হয়। মেয়েগুলো দু’টো আউশ ধানের খই খেতে পারবে। ধান কাটতে গিয়ে দেখে তাতে কিছু পুটি, টাকি, কৈয়া মাছ খিলবিল করছে। কেরামতের ধান কাটা শেষ। এখনও আঁটি করেনি। কাটা ধানগুলো আলের উপর বিছিয়ে রেখেছে। পানিটা ঝড়ে গেলে আঁটি বাঁধতে সুবিধা হবে। তার আগে ডোবার পাশে নরম মাটির বাঁধ দিয়ে সুরেন ঠাকুরের বৌ-এর কাছ থেকে একটা গামলা নিয়ে পানিটা সেচ করেছে। বেশিক্ষণ লাগেনি। দুপুরের রোদ চড়ার আগেই কিছু পুটি, টাকি ও কৈ মাছ ধরেছে। সারা গায়ে কাঁদা লেগে একাকার। গামলাটা ফেরত দিতে গিয়ে একটা অংশ সুরেন ঠাকুরের বৌ-কে দিতে হলো। বাকি মাছটা ঘরে নিয়ে এসেছে। বেশ খুশি খুশি লাগছে। টাটকা কৈ মাছ। বউকে বলছে, পুটি মাছগুলো কলমির ডাটা দিয়ে ভাজা করতে। কৈ আর টাকি মাছগুলো একটা হাড়িতে জিঁইয়ে রাখতে বলে আবার মাঠে চলে গেছে।
করিমন মনে মনে বলছে, গরীবের আবার খাওয়া! অল্প অল্প করে জিঁওল মাছ খাওয়া যাবে। সীমের বীচি দিয়ে বিলের কৈ মাছগুলো খেতে পারলে বেশ হয়। কয়েক থালা সীম গাছ বিলের ধারে লাগিয়েছে করিমন। তেমন ভালো হয়নি। বীচিগুলোও এখনও পোক্ত হয়নি। বাজারে সীমের বিচির দাম বেশি। গাছে যে ক’টা সীম আছে করিমন ভাবছে তাই দিয়ে কাল কৈ মাছ রান্না করবে।
গোলায় কিছু ধান রেখে পিটটা একটু তাতিয়ে নিচ্ছে করিমন। এই শীতে গা’টা কেমন খসখসে হয়ে গেছে। পায়ের গোড়ালিগুলো ফেটে গেছে। এই সংসারে আসার পর সাজগোজ করার আর সময় কোথায়? বিয়ের সময় যে প্রসাধনি দেওয়া হয়েছে ওটুকুই। নতুন করে কিছু কেনা হয়নি। গ্রামের হাট থেকে মাঝে মধ্যে একটা স্নো কিনে আনে কেরামত। বৌ-এর হাতে দিয়ে বলে, বৌ বেশী কিছু ত দিত ন’পারির। পত্ত্যইন সেয়ান গড়ি একখানা স্নো মাখিলি তোয়ারে খুব সুন্দর লাগে। এখন মেয়েদের আবদার রক্ষা করার জন্য কালে ভদ্রে একটু ম্নো পাউডার কিনে দেয়। তাতেই মা মেয়ের চলে যায়।
আজ বিলের মধ্যে পড়ন্ত বিকেলের রোদটা গায়ে মাখার জন্য মা মেয়ে দু’জনেই বসেছে। করিমন রেশমির দিকে এখন একটু বাড়তি খেয়াল রাখছে। ক’দিন আগে হাজী বাড়ীর মতি মোল্লা এসে রেশমিকে দেখে গেছে। মতি মোল্লার ছেলে ফরহাদের সাথে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ছেলে ভালোই। রসুলপুর বাজারে বাবার সাথে মুদি দোকানে বসে। এক খানির মত ধানি জমিও আছে। চাষবাস করে। মতি মোল্লা দেখে যাওয়ার সময় বলে গেছে, এখন তো ছেলেমেয়েদের যুগ। আমার ফরহাদ একবার মায়া দেইখা লউক। অর পছন্দ হইলেই সামনের মাসেই বিয়া। এর পর একদিন ছেলে এসে রেশমিকে দেখে গেলো। সেদিন করিমন মেয়েকে সুন্দর করে সাজিয়েছিল। হাতে ডিম বিক্রির জমানো ক’টা টাকা ছিল। তাই দিয়ে বাজার থেকে দু’গাছি হাতের চুড়ি, লাল ফিতা, স্নাে পাউডার, লিপষ্টিক এসব কিনে এনেছে। রেশমিকে ছেলের পছন্দও হয়েছে। মতি মোল্লার হিসাব মতে বিয়েটাও পাকা। সামনের মাসে। আর বেশিদিন হাতে নাই। এ নিয়ে করিমনেরও চিন্তার শেষ নেই। একমাত্র ভরসা করিমনের হাতের দু’খানা চূড়ি। আর এই খোন্দে পাওয়া বিশ তিরিশ আড়ি ধান। একমাত্র ভরসা গোলার ধান। কিন্তু ধান বিক্রি করে দিলে খাবে কী? ধান থাকলে একটু শাক কুড়িয়ে নিয়ে খাওয়া যায়। দু’কুলে এমন সামর্থ্যবান আত্মীয় নাই যে, কেউ একজন দাড়িয়ে আট দশ হাজার টাকা খরচ করে রেশমির বিয়ে দেবে। অবশ্য ছেলে পক্ষ থেকেও তেমন কোন দাবি দাওয়া করেনি। শুধু দোকানের পূঁজি বাড়ানোর জন্য হাজার দশেক টাকা নগদে চেয়েছে মতি মোল্লা। এমন ছেলের তুলনায় এ টাকা খুব একটা বেশী কিছু নয়। সব ভেবেও ছেলেটাকে হাতছাড়া করতে রাজী নয় কেরামত এবং করিমন দু’জনেই। এখন একটু সময় পেলেই রেশমিকে নিয়ে বসে। মাথায় বীনি কাটতে কাটতে দু’চারটা শলা পরামর্শ দেয়। মাথাটা আঁচড়িয়ে দেয়। রেশমিও একটা নতুন সংসারের হাল ধরার জন্য প্রস্তুতি নেয়। একটা নতুন দিনের স্বপ্ন দেখে।
রেশমির চুলগুলো এলোমেলো। উসকো খুসকো, রুক্ষ। মোটা দাঁতের চিরুনী দিয়েও চুল ধরে না। কোনভাবে আঁচড়ানো যাচ্ছে না। জোড়ে চিরুনি চালাতে গেলে চুল উঠে আসে। পাশে নারকেল তেলের শিশির তলায় যেটুকু তেল আছে তা ডালডা ঘি-এর মত জমে আছে। রেশমিকে বোতলটা কোমড়ে গুজে রাখতে বলেছে করিমন। তাতেও বোতলের তেলগুলো গলছে না। রোদ পড়ে এসেছে। অবশেষে একটা শুকনো কাটি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বোতলের তলায় জমাট বাঁধা তেলগুলো হাতের তালুতে ঘষে ঘষে রেশমির মাথায় দিয়ে চিরুনি চালানোর চেষ্টা করছে। আর মনে মনে বলছে, গরিবের এত লম্বা চুল থাকতে নেই। মানুষের নজর লাগে। তেল মাখতে মাখতে রেশমির চুলে বিনি কাটে করিমন। কয়েকটা উকুন খুঁজে নেয়। বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের পিঠে উকুন রেখে, ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের পিঠ দিয়ে পিষে মারে। পিঠিস করে একটা শব্দ হয়। করিমন ভাবে, আজিয়া বড় ঘর’অত জন্ম হইলি কত সুগন্ধি তেল, সাবান, শ্যাম্পু মাখি’ত পাইর’তু। চুল’গিন চাইবার মত হইতু। মায়াওয়ারে কত’অ সোন্দর লাইগ’তু। এই ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে করিমন। রেশমি জিজ্ঞাসা করল, মা তুমি তেল দিবা না। করিমনের চুলে দেওয়ার মত আর তেল নেই। বোতলটা রেশমির হাতে দিয়ে বলল, তোর বাপ বাজার’ত যাইবার সম’ত দিস। শীতকালে গা’আতে একখানা তেল নদিলি শরীর’আন টান টান হই থাকে। কিছু ভালা ন’লাগে।
ওদিকে বাড়ির ভিতর থেকে সোহেলি সমানে মাকে ডাকছে। ও মা তাড়াতাড়ি আস, দেখ কি নিয়া আসছি। এত বড় আলু আমি জীবনে দেখি নাই। বাড়িতে সাড়া না পেয়ে ছোট মাটির ঢেলার মত মেটে আলুটা নিয়ে বিলের মাঝে হাজির। দৌঁড়ে এসে হাফাচ্ছে মেয়েটা। ছোট নরম তুলতুলে হাত দু’টো টকটকে লাল হয়ে গেছে। আলুটা মাটিতে রেখে হাত দু’টো জামার কাঁচায় মুছে বলল, শরীফার নানী আলু তুলতেছিল। আমি আর শরীফা দাড়িয়ে দেখছিলাম। খুন্তিটা আমার হাতে দিয়ে বলল মাটিটা খুঁড়ে দে। তোরেও একটুকরা আলু দেব। ও মা, না দেখলে বিশ্বাস করবা না, এত্ত বড় আলু। আমার খুব কষ্ট হইছে। দ্যাখনা হাত দুইটা লাল হইয়া গেছে। এই আলুটা আমারে খুন্তি দিয়ে কেটে দিল। আর বলল, তোর মারে কইছ, জিওল মাছ দিয়া রান্না করতে। মেয়ের হাত দু’টো দেখে করিমন কী যেন ভাবল।
সংসারের টানাপোড়েনের কথা ভেবে চোখে জল এলো করিমনের। এই অবুজ শিশুটিও যেন সংসারের কষ্ট বুঝে। এই বয়সে দুঃখ কষ্টগুলো ভাগ করে নিতে শিখেছে। যে বয়সে আবদার করে স্নো পাউডার লিপষ্টিক কেনার কথা সেই বয়সে বাবার উপর বাড়তি বোঝা চাপাতে চায় না। আগে তো পেটে ভাত। তারপর স্নো পাউডার। পেটের ক্ষুধার সাথে যেন আর কিছুর তুলনা চলে না। স্নো পাউডার না থাকলেও জীবন চলবে। ক্ষুধার কষ্ট জীবনকে যে কোন সময় থামিয়ে দিতে পারে। গরীবের ক্ষুধা বেশী, তাই খাওয়াও বেশী। আর ঘরের বৌ হচ্ছে একমাত্র বিনোদন। ওদের ঘরে ডিস নাই, টিভি নাই। সন্ধ্যা হলে কেরোসিন বাঁচানোর জন্য বাতি নিভিয়ে বৌকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বলে।
করিমন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হাত দুটো ধরে আদর করল। তারপর হাতের তালুতে লেগে থাকা তেলটুকু সোহেলির মাথায় মাখিয়ে পরম মমতায় মাথায় চিরুনি টানতে টানতে বলল, আলু আইন্নুস ভালা হইয়ি। জিঁয়াল মাছ’অ আছে। কালিয়া আঁর মাইয়ারে ভালা গ’ড়ি জিঁয়াল মাছ’দি মাইট্ট্যা আলু’দি রাঁধি দিইয়ুম। এতে সোহেলি খুশি হয়। হাতের কষ্টটা মুহূর্তে ভূলে যায়। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ও’মা, বা’জান বাজারে যাবে না। বাজার ত শেষ হয়ে যাচ্ছে। করিমন মেয়েকে বলল, তুই ডিম’উন লই বাজার’ত যা। পইল্ল্যা বাজার’ত দাম পাবি। তোর বাপে ধান কা’ডি যাইতে যাইতে আঁ’জ হই যাইবু। তুই যাই ব’গই। বেচা হইলি চলি আইছ। হাঁসর ডিমা দশ টেঁয়া আর মুরগীর ডিমা বার টেঁয়া ক’বি। এয়ার কমে ন’দিস।
করিমনের আর মাথা আঁচড়ানো হয়নি। পিটের কাপড়টা টেনে দিয়ে উঠে গেল। মেয়েকে ডিমগুলো একটা কাপড়ে বেঁধে দিয়ে বলল, সাবধানে রাস্তা চাই হাঁ’ডিবি। উঁচুঠ খায় ডিম’উন ন’ভাঙ্গিছ। ডিম বেচি তুই দুই টেঁয়ার শনপাপড়ি খাবি, আর তোর আপার’লাই দুই টেঁয়ার আনিবি।
বেলা পড়ে আসতে দেখে আবার ব্যাস্ততা বাড়ে করিমনের। নিজের মনে বলতে থাকে, মরার শীত কাইল্ল্যা বেল, এই আছে এই নাই। দিন কইন্দি যাই’গই বুঝা ন’যাই। রেশমিকে ডেকে বলল, আঁই গরু ছ’অলগুন লই আই। তুই রইদ’ত তুন কেঁথা খানিগিন তুলি লই ঘর’গান ফুঁড়ি ল। এখন তোর বাপ আইয়িরে হাড’ত যাইবু। পাইরলি এক’খানা চা বানায় দিস।
সুর্যটা রক্তিম আভা ছড়িয়ে আস্তে আস্তে পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। কেরামত আবারও হাতে করে ক’টা টাকি মাছ নিয়ে এসেছে। পানি না পেয়ে নরম মাটির ভিতর লুকিয়েছিল। রোদের তেজ পেয়ে মাটি ফুঁড়ে উপরে উঠে এসেছে। রেশমিকে বলল, মাছ’গুন কুডি ফেলা। নইলি পঁচি যাইবু। রেশমি বাবাকে চা বানিয়ে দেয়। থলের মধ্যে তেলের শিশিটা দিয়ে বলল, মায়ের জন্য নারকেল তেল নিয়ে আসবা। কেরামত বাজারের দিকে পা বাড়ায়। তেলের শিশিটা হাঁছি ফকিরের দোকানে দিয়ে এক ছটাক নারকেল তেল ভরে রাখতে বলল। শেষ বাজারে জিনিষপত্রের দাম একটু সস্তা থাকে। ঝাড়াঝুড়া কাঁচাবাজারগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়ার চাইতে দোকানীরা সস্তা দামে বেঁচে দেয়। কেরামত সেই সুযোগটা নেওয়ার জন্য সন্ধ্যায় বাজার করে। শীতকালে সব্জির দাম এমনিতেই কম। সাথে অল্প লইট্ট্যা শুটকি কিনে হাঁছি ফকিরের দোকানে গিয়ে বসে। প্লাষ্টিকের পটে এককাপ চা নিয়ে আসে কেরামত। দু’জনে ভাগাভাগি করে খাবে। এমন সময় মোল্লা পাড়ার নবী গায়েন এসে হাজির। ভবিষ্যত সম্মন্ধটা মোল্লা পাড়াতেই। সেই সুবাধে কেরামত একটু খাতির যতœ করে চা খেতে বলল। কেরামতকে দেখে গায়েন আর না করেনি। পশ্চিম পাড়া থেকে এদিকে তোমার কাছেই আসছিলাম। তাছাড়া মাইয়াডার অসুখ। দাবাই নিয়া যাইতে হইবো। গায়েন দোকানের ছোট চৌকিটাতে বসতে বসতে বলল-
– কী কেরামত মিয়া, হুনলাম মতি মোল্লার পোলার লগে মায়ার বিয়া দিতাছ। তয় কোন খোঁজ খবর নিছ। নাকি দোকানদার পোলা দেইখা পাকা কথা দিয়া দিছ।
– কী যে ক’ও না গায়েন, মোল্লা এ’ন গড়ি ক’অর আঁই না গরিত ন’পারি। আঁরা গরিব মানুষ। এত খবর বার্তা লই মায়া বিয়া দিয়ুম ক্যানে। যার চাল চুলা নাই, ইতার মায়ারে ক’নে বিয়া গরিবু?
– চাল চুলা নাই বইলা মায়াডারে পানিতে ভাসাইয়া দিবা?
– ইয়ান কী কইলা গায়েন। ক্যান কী হইয়িযে।
– হেয় জন্যই তো জিগাই, খবর বার্তা নিছ কি না? তুমি কিছু জান না।
– না।
– মোল্লা পাড়ার বেবাকে জানে, আর তুমি কিছু জানলা না।
– ব্যাপার’গান কি একখানা খুলি ক’অত। আঁর ত ক্যান জানি ডর ডর লাগের।
– ডরের কিছু নাই। ঐ মত্যার পোলাডা ভালা না। একটা জ্যাঁতা লম্পট। গেলো সন এমুন সময় বিলের মধ্যে পাড়ার এক মায়ার সাথে জোড় কইরা ফষ্টিনষ্টি কইরা ধরা খাইছে। গ্রামের মানুষ বেবাকে মিইল্যা গণধোলাই দিয়া মাথার চুল কাইটা দিছিল। জরিমানাও দিছে। তারপর গ্রাম ছাইড়া বাপের দোকান ধরল। ঐ খানেও কি সব আকাম কুকাম কইর্যা বেড়ায়। খবরদার ভূলেও এই খবর আমার কাছ থেইক্যা হুনছ এইডা ক’বা না। মেম্বার চেয়ারম্যান বেবাগই হেগো মানুষ।
– আঁর মাথা’ত কিছু ন’আয়ির। ইন বেয়াগগিন কি হাঁছা কতা না গায়েন?
– আমার কী দায় ঠেকছে যে এতদূর পথ হাইট্যা আইস্যা তোমার লগে মিছা কথা কমু। আমরা গরিব। গরিবের মর্ম বুঝি। তোমার মাইয়াডা কষ্ট পাইলে আমারও কষ্ট লাগবো। বিশ্বাস না হয় মোল্লা পাড়ার আরও মাইনষের লগে কথা কইয়া দেখ। কী কও ফকির, তুমিও তো জান। কিছু কও না ক্যান। গায়েন হাঁছি ফকিরের দিকে তাকিয়ে বলল।
সায় দিল হাঁছি ফকির। ছোট মুদি দোকান। এক কান দু’কান করে পাড়ার অনেক কথায় উঠে। দোকানে বসে গ্রামের নানা জনের নানান কথা শুনতে হয়। আবার কথা চালাচালি করলেও বিপদ। কাষ্টমার থাকবে না। কত কথা কানে আসে। ফকির মানুষ। সময় পেলে মাজারে মাজারে জেয়ারত করে বেড়ায়। সব কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিতে হয়। পাড়ার লোকজন আসে। এক আধটু পান বিড়ি খেয়ে গল্প গুজব চলে। বেচাবিক্রি যা হয় এই দোকানি আড্ডার কারণে। এসব কথাবার্তায় সময় কেটে যায়। বয়সও কম হয়নি। তাই সব কথা মনেও রাখতে পারে না। গায়েনের কথার রেশ টেনে বলল, হ এইরকম একখান ঘটনা হুনছিলাম। তখন এই খবরে সাড়া গ্রাম তোলপাড় হইছিল।
নড়েচড়ে বসল কেরামত। আর চা খাওয়া হয়নি। নিজের ভাগের কাপটা গায়েনকে দিয়ে আর আনা হয়নি। মাথাটা ঘুরছে। লুঙ্গির কাঁচাটা হাটু পর্যন্তু টেনে পা দু’টো গুঁজে চৌকির উপর বসল। মনে মনে রাগ হচ্ছিল ফকিরের উপর। এতদিনের উঠাবসা, বাজার সদাই সবই তো এই দোকান থেকেই করে, মাঝে মধ্যে বাকি টাকিও নেয়, মায়ার বিয়ার কতাবার্তা হচ্ছে এও জানে, ফকিরের দোকানে বসে এসব নিয়ে আলাপ আলোচনাও হয়েছে, কেরামতের অভাব অনটনের কথা কোনটায় ফকিরের অজানা নয়, বাজারে এলে এই ফকিরের দোকানে বসেই এক কাপ চা দুই জনে ভাগ করে খায়। অথচ এমন একটা কথা কীভাবে ফকির চেপে গেলো, কিছুই মাথায় আসছে না। ফকিরকে এ খবরটা না বলার কারনও জিজ্ঞাসা করতে পারছে না। যদি বলে বসে তোমার মায়া তুমি যারে খুশী বিয়া দাও, আমার কি ঠেকা পড়ছে? আমি হাঁসের ডিমা কুঁড়ার পোঁন্দে, আর কুঁড়ার ডিমা হাঁসের পোঁন্দে দিতে যাবো কোন দুঃখে। কিন্তু এতদিনের বন্ধুত্বে কেরামত সেরকম কিছু দেখেনি। বরং দু’একটা ভালো শলা পরামর্শ দিয়েছে। কেরামত ফকিরের দোকান থেকে নিজের হাতে আর একটা বিড়ি নিয়ে জ্বালায়। লম্বা টান মেরে আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে। গায়েন আবার জিজ্ঞাসা করে-
– কী কেরামত, কী ভাবছো?
কেরামত কোন কথা বলল না। গায়েন আবার নিজে থেকেই বলল-
– তাইলে আমার কথাগান তোমার বিশ্বাস হইলো না।
– বিশ্বাস হইবো না ক্যান। আমি ভাবছি ফকির আমারে এতদিন কথাটা কইলো না ক্যান।
– তুমি আবার ফকিরের দোষ দেখতাছ ক্যান। মায়া কী ফকিরের না তোমার?
একজন কাষ্টমার দাড়িয়ে আছে। ফকির দুই সের চাউল মেপে দিয়ে টাকাটা বাক্সে রেখে বলল, শেষমেষ তুমি আমারে ভূল বুঝলা কেরামত! আমি কি জানি, যে এই পোলায় সেই পোলা, যার লগে তুমি মায়ার বিয়া ঠিক করছ। হেই কিচ্ছাতো কতদিন হইয়া গেলো। ক্যান তুমিও তো জান হেই ঘটনা। এই দোকানে বইসা কত কানাকানি হইলো। তুমি নিজেই তো বললা, এই দুনিয়াটার দোজখে যাওনের সময় হইছে। হেই যে ঘরজা কাম করে, লেদু মিয়ার বোবা মাইডারে নিয়াই তো এত কান্ড।
বেচারা গরিব বইলা শালিস বিচার পাইলো না। মেম্বার শমশু মাথা মুড়াইয়া দুই হাজার টেহা জরিমানা নিলো। তাও লেদু মিয়া পাইলো না। বোবা মায়ার ইজ্জতের দাম পাইলো এক হাজার। বাকি একহাজার মেম্বারের পকেটে। পরে হুনছি মতি মোল্লার থেইকা আরও তিন হাজার নিছে। তুমিও সব ভুইল্যাা গেলা।
এবার কেরামত লজ্জা পেল। গরিব মানুষের বোকামি যখন নিজে বুঝতে পারে তখন মাথা হেট আসে। মাথা তুলে কোন কথা বলতে পারে না। মাথা নীচু করে বলল-
– অ’ফইর তুঁই আঁরে ভূল ন’বুইজ্জু। আঁর মাথা’ত কিছু ন’আঁয়ির। মায়া বড় হইয়ি। ক্যানে বিয়া দিয়ুম খালি হেয় চিন্তা। আর এই কুত্তা যে সেই কুত্তা হিয়ান আঁর মাথা’ত ন’আয়ি। কালিয়া আঁর য’অনর কথা। অ’ন আঁই কি গইজ্জুম একখান বুদ্ধি দে’অ।
– অহন বাড়ি যাও। বৌ-এর লগে কথা কও। কাইল যাইবার আগে এদিকে হইয়া যাইও। বলল ফকির।
কেরামত আর দেরি করেনি। বাজারের থলেটা নিয়ে বাড়ির দিকে পা পাড়ায়। রাগে মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েও ভেঙ্গে যাচ্ছে। মানুষজন কী বলবে? সমাজে গরীব ঘরের মেয়ে বড় হলে যে কী যন্ত্রণা তা বাবা হিসাবে কেরামত বুঝতে পারে। তার চেয়েও বেশী কষ্ট হবে করিমনের। এসব ভাবতে ভাবতে অন্ধকারে পথ চলে কেরামত। কাঁচির মত একফালি চাদঁ আছে আকাশে। আলো নেই। নিষ্প্রাণ। শুধু কেরামতের বুকের ভেতরটা ঘন মেঘের মত কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে। একটা আন্ধা সাপ পুকুর থেকে উঠে রাস্তা পার হচ্ছিল। কেরামত খেয়াল করেনি। পা পড়ল সাপের গায়ে। সাপের ভয় কেরামতের নেই। তেলের শিশিটা ডান হাতে নিয়ে বাঁ হাতে সাপের লেজ ধরে দু’চক্কর ঘুড়িয়ে ছুঁড়ে মারল অনেক দূরে। মনে সাহস পেল। মতি মোল্লার ছেলের সাথে এই বিয়ে হবে না। বাজারের থলে আর শিশিটা রেশমির হাতে দিয়ে বলল-মা’রে তুই ব’অর পোড়া কোয়াইল্লা। ব’অর অভাগী। আঁই আর’অ ভালা পোয়ার অ’ংগে তোর বিয়া দিয়ুম।
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল কেরামত। রেশমি কিছুই বুঝতে পারছে না। মা কে ডেকে বলল, ও মা, বাজান’অর কি হইয়ে। বা’জান এ’ন গড়ি কান্দের ক্যায়া?
করিমন দৌড়ে আসতেই কিসের একটা ঝনঝন করে শব্দ হলো। ছুটে এসে বলল-
– কি হইয়ি তোঁয়ার? কান্দ’অর ক্যায়া? হা’ডত কনে কি কইয়ি না?
এতসব প্রশ্নের উত্তর শুনে করিমন শুধু শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছল। সে রাতে করিমনের আর কলমিলতার বড়া আর কেরামতের জিওল মাছ খাওয়া হলো না।