Site icon Shaili Tv

‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’ / রেজাউল করিম স্বপন

কখনো মন খারাপ বা টেনশনে থাকলে ক্লাবের সুইমিং পুলের পাশে আলো আঁধারিতে বসে একটার পর একটা সিগারেট ফুকা আমার পুরানো অভ্যাস। বদ অভ্যাস হলেও এভাবে কয়েক ঘন্টা বসে থাকলে মনটা একটু হালকা ও টেনশন মুক্ত হয় এবং রাতেও ভালো ঘুম হয়। কয়েক দিন আগে ব্যবসায়িক একটা সমস্যা হওয়ায় মনটা খুব খারাপ হয়। যথারীতি ক্লাবের সুইমিংপুলের পাশে একাকী বসে একটার পর একটা সিগারেট ফুকছিলাম। ঘন্টাখানেক পর ক্লাবের স্মার্ট সুন্দরী এক সদস্যা আমার পাশে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন?
হঠাৎ এ রকম সুন্দরী ও স্মার্ট একজন মহিলার প্রশ্নে বিব্রত হয়ে নিচু স্বরে বললাম, ভাল আছি।
মহিলা বললো,আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি? আমি আরো বেশী বিব্রত হয়ে বললাম, হ্যাঁ পারেন। মহিলা এবার বললো আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
বললাম চিনবো না কেন আপনি ক্লাবের একজন সম্মানিত সদস্য।
বললো ক্লাবের মেম্বার ছাড়া অন্য কোনভাবে কি আমাকে চিনেন?
এবার ধন্ধে পড়ে গেলাম। কারণ উনাকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় থেকে আমি চিনি কিন্তু কখনো কথা হয় নাই। কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে মহিলার দিকে ভালোভাবে খেয়াল করলাম। দেখলাম বয়স হলেও মহিলা এখনো অনেক সুন্দর, স্মার্ট, ববকার্ট চুল, ম্যাচিং করে পিংক কালারের জর্জেট শাড়ি পরেছে এবং কথা বার্তায়ও যথেষ্ট রুচিশীল। এবার মহিলা বললো থাক কষ্ট করে আর আমাকে মনে করতে হবে না।
মহিলা বললো আপনি একাকী বসে আছেন কেন?
আমি : এমনিই।
মহিলা : আমি আগেও কয়েকবার আপনাকে এখানে একাকী বসে থাকতে দেখেছি। প্রতিবারই ভেবেছি জিজ্ঞেস করবো, কিন্তু কাছাকাছি লোক থাকায় জিজ্ঞেস করতে পারি নাই। আজ দেখলাম আপনি ফাঁকায় বসে আছেন তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলি। তাঁর কথা শুনে আমি একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে সুইমিংপুলের পানির দিকে তাকিয়ে সিগারেটে লম্বা লম্বা টান দিচ্ছিলাম।
মহিলা : আপনি কি আসলেই আমাকে চিনতে পারেন নি।
এবার আমি তাঁর চোখের দিকে সরাসরি তাকালাম, তবু না চিনার ভান করে বললাম, ঠিক মনে করতে পারছি না।
মহিলা : এটা কি সত্যি সত্যি বলছেন?
এবার আমি বললাম আপনি কি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন?
মহিলা : হ্যাঁ।
আমি : আপনি কি ইংরেজির রেখার ক্লাসমেট ও বিবিএ প্রথম ব্যাচের ছাত্রী?
মহিলা : হ্যা।
আমি : আপনার নাম কি কেয়া?
মহিলা: আপনি এখনো এতোকিছু মনে রেখেছেন।
বললাম আপনাকে কি ভোলা যায়।
বললো কেন বলুন তো?
আমি : কিভাবে ভুলবো বলেন। হয়ত আপনার সাথে আমার কখনো কথা হয় নি, কিন্তু আপনি সারা বছর ম্যাচিং করে জামা কাপড় থেকে শুরু করে ব্যাগ ও ছাতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের ম্যাচিং করে আসা মেয়ে ছিলো হাতে গোনা কয়েকজন, যার মধ্যে আপনি ছিলেন অন্যতম।
এবার আমি বললাম আপনি কেমন আছেন?
বললো এই চলে যাচ্ছে।
আমি: এভাবে বলছেন কেন? মহিলা চুপ করে রইলেন। মনে হলো মহিলা হতাশায় আছে তাই পাল্টা প্রশ্ন করলাম আপনার মনে কি অনেক কষ্ট?
মহিলা : কেন বলুন তো?
বললাম যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা প্রশ্ন করবো?
মহিলা: করতে পারেন।
আমি: আপনার সংসারে কে কে আছে?
মহিলা: দুই ছেলে এক মেয়ে। তার মধ্যে এক ছেলে এক মেয়ে বিদেশে লেখা পড়ার করে। আর ছোট ছেলে দেশে আছে।
আমি: সাহেব?
মহিলা এবার আনমনা হয়ে সুইমিংপুলের পানির দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
বললাম দুঃখিত না বলতে চাইলে থাক।
মহিলা বললো সাহেব প্রায় পাঁচ বছর আগে রোড এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে। সে থেকে আমি তার স্মৃতি বয়ে চলেছি।
মহিলা বললো থাক আমার কথা, আপনার কথা বলেন। বললাম কেন?
বললো স্বামীর কথা মনে হলে খুব কষ্ট হয়, চোখে পানি চলে আসে তাই সে ভারটা আমি একাকী বহন করি। কাউকে বুঝতে দেই না।
বললাম আমার কথা কি বলবো বলেন?
মহিলা বললো অনেক দিন থেকে আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো বলে ভেবেছি কিন্তু সময় সুযোগ হয় না বলে করা হয় নাই ?
বললাম কি প্রশ্ন।
মহিলা :আচ্ছা আপনি এতো ভীতু কেন?
বললাম কেন।
মহিলা : বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় রেখার মাধ্যমে আপনার সাথে আমার পরিচয়। কিন্তু আপনি আমার সাথে কখনো কথা বলতেন না কেন?
বললাম কেন সেটা আমি নিজেও জানি না।
মহিলা : আমি ও আমার বান্ধবীরা বুঝতাম আপনি আমাকে পছন্দ করেন কিন্তু কখনো বলেননি কেন?
এই প্রশ্নে আমার মাথা পুরো ঘুরে গেল।
বললাম ভয়ে।
মহিলা: কিসের ভয়।
আমি : বলার পর যদি আপনি নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া দেখান সে ভয়ে।
এবার আমি বললাম আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে,আমি আপনাকে পছন্দ করতাম।
বললো আপনার চাহনি। আপনি আমার সামনে আসলে কেমন যেন বোকার মত ও উল্টাপাল্টা আচরণ করতেন।
বললাম আর কিছু!
বললো আপনি প্রতিদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেন। সাথে আপনার দুই বন্ধু থাকতো। দুপুর ১.৩০ এর ট্রেন ধরার জন্য কাটা পাহাড় দিয়ে হেটে আসার সময় আপনি আমাদের পিছনে জোরে জোরে আমাকে শুনিয়ে অনেক কথা বলতেন। অনেক সময় ঝুপড়ি দোকানে বসে আমাদের আসার জন্য অপেক্ষা করতেন। ট্রেনে উঠে সিট না পেলে আপনি সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে যেতেন। এগুলো দেখে আমি নিশ্চিত ছিলাম আপনি আমাকে পছন্দ করতেন। তবে আপনার উপর খুব রাগ ছিলো আমার কারণ আপনি আমাকে সরাসরি কিছু বলতেন না।
বললাম, যদি বলতাম তাহলে কি হতো?
মহিলা : কি হতো সেটা বলতে পারবো না। তবে ভালোলাগার একটা অনুভূতি হতো এটা বলা যায়।
আমি বললাম, বললে আমার কষ্ট বাড়তো কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম আপনি না বলতেন।
মহিলা : কিভাবে নিশ্চিত হলেন?
বললাম আমি একদিন ষোলশহর রেল স্টেশন থেকে আপনার পিছুপিছু জামালখান পর্যন্ত গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি আপনার বাড়ীর গেইটে লেখা “বিওয়ার অফ ডগ” এটা দেখার পর একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম আপনি অনেক ধনবান পরিবারের মেয়ে। বুঝলাম আপনাকে অযথা প্রপোজ করে লাভ নেই। কারণ আপনার পরিবার কখনো আমার মত ছেলেকে মেনে নেবে না। তাই কখনো কিছু বলিনি।
এবার আমি বললাম আচ্ছা বলতে পারেন, মানুষের সব চাওয়া কি পূরণ হয়! বা মানুষ যা চায় তা কি পায়? উনি কোন উত্তর করলো না।
আমি : বলতে পারেন কাউকে ভালো লাগলে বা পছন্দ হলেই কি পেতেই হবে? আরো বললাম, আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের শিক্ষাজীবনের ভালোলাগা বা ভালোবাসা পরিপূর্ণতা পায় না এবং অংকুরে নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আমার ভালোলাগাটাও হয়ত পূর্ণতা পেল না কিন্তু এতে আমার কোন দুঃখ বা আক্ষেপ নেই। কারণ ঐ অবস্থায় কোন বাবা মা তার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিত না
মহিলা কোন উত্তর করলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণালী স্মৃতি মনে করে যখন স্মৃতিকাতর হয়ে গেলাম ঠিক সে সময় উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি এখন চলে যাবো।
বললাম আর একটু থাকলে কি আপনার খুব ক্ষতি হবে?
মহিলা : দেখেন আমি আর একটু থাকলে কি আপনার কোন লাভ হবে?
বললাম হয়ত কোন লাভ হবে না, তবে থাকলে আপনাকে আরো কিছু মনের অব্যক্ত কথা বলতে পারবো। এতে হয়ত আমি একটু হালকা অনুভব করবো। আমি আরো বললাম দেখেন আজ আমি একই ক্লাবে আছি বলে আপনি আমার সাথে কথা বলছেন। না হলে বহু আগে আমাকে ভুলে যেতেন।
কোন উত্তর না দিয়ে মহিলা বললেন, বাসায় ছেলে একা, চলে যেতে হবে। এ কথা বলে তিনি উঠে হাঁটা শুরু করলেন আর আমি তখনো সেখানে বসে সিগারেট হাতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর ভাবলাম, এটা কি স্বপ্ন না বাস্তব!

Exit mobile version