কেউ বলে পৃথিবী কমলার মতো গোল।
যে যাই বলুক, পৃথিবী পৃথিবীর মতই। ঠিক হিরালাল ও তার মতই, এইরূপে দ্বিতীয়জন নেই। সে চন্ডাল পুত্র। জাতের একেবারই নীচু ওরা। সমাজে দৃষ্টিনন্দিত চোখে কেউ দেখেনা।
পৃথিবীতে সাড়েসাতশ কুটি মানুষ। দুইজন একইরকম হয় না। সবাই ভিন্ন। তবে যমজ সন্তানের অনেককিছু মিল থাকে।চেহারা,হাত,পায়ে। কন্ঠে হয়তো মিল থাকেনা, ভিন্ন হয়।
নয়নপুরের মানুষ হিরালাল। ওরা যমজ দুইভাই। দশ মিনিট আগে পিছে ওদের জন্ম। অন্যজন ধীরলাল। ওরা দেখতে একই। গায়ের রঙ ফর্সা, উজ্বল। কেউ লেখাপড়া করেনি। বাবার উত্তরাধীকার সুত্রে ওদের কাজ স্মশানে মরা মানুষ পোঁড়া। এটা ওদের বাপদাদার কাজ।
মানুষ পোড়ার কাঠ,টায়ার, কেরোসিন যা লাগে সব স্বজনের। ওদের নির্দিষ্ট পাঁচশটাকা দিতে হয়। দুইভাই লাশ পোড়া শেষ হলেই বাড়ি ফিরে।
একদিন ওদের মা হিরালালের বিয়ে দেয়। মা’র এক কথা। বাড়ি ফাঁকা, একাএকা ভালো লাগেনা। বউ পেয়ে মায়ের সেকি আনন্দ।
সারাদিন বউ নিয়ে ঘরের কাজ, গল্প, আনন্দ সবই। চার বছর না যেতেই বউমার উপর চরম রাগ শাশুড়ীর। আগের মতো ভালোবাসে না। কড়া কথা শোনায়,
– কি হলো বউমা ? আর কতদিন! নাতির সখ নেই আমার। একা ভালো লাগেনা, বলে দিলাম।
তখনও হিরালাল, ধীরলাল বাড়ি ফিরেনি। আজ দু’জন মানুষ মারা গেছে। পরপর পুড়তে হবে। অনেক রাতে দুইভাই আসে। ওদের চোখেমুখে হাসি। মাকে হিরালাল বলে,
– মা, আজ ভালো আয় হলো। লাশ পোড়াবার জন্য বাড়তি টাকা দিয়েছে।
– ঠিক আছে বাবা। শোন, আমার আর একা থাকতে ভালো লাগেনা।আমার নাতি চাই। নাতির সাথে খেলতে চাই বলে দিলাম।
ততক্ষণে প্রিয়বালা দুই ভাইকে খেতে দেয়।

শাশুড়ীর কথা প্রিয়বালার কানে বাজে। দুঃখ পায়।
রান্নাঘরের কাজ শেষে প্রিয়বালা শোবার ঘরে আসে। হিরালাল বিছানায় শুয়েশুয়ে বলে,
– প্রিয়বালা এলে?
বউতো অবাক, যাতে স্বামীর ঘুম না ভাঙে, ধীরে শব্দ ছাড়া ঘরে ঢুকে।তারপরও কিভাবে বুঝলো, আমি এলাম। প্রিয়বালা নরম গলায় বলে,
– হ্যাঁগো, এতো আস্তে ঘরে ঢুকলাম, টের পেলে কিভাবে?
– অভ্যাস, তোমার গায়ের গন্ধে।
– ওমা, সেকি কথা!
– আজ চার বছরেরও বেশি হলো আমার ঘরে এসেছো। দীর্ঘদিন কাছাকাছি থাকি। গায়ের গন্ধ বুঝবো না?
– যা, কিযে বলো!
– সত্যি কি জানো! তোমার গায়ের গন্ধটা মিষ্টি। আমার ভীষণ পছন্দ।
প্রিয়বালা মাথায় চিরুণী চালাতে বলে,
– ছাড়ো ওসব কথা। মা নাতি চায়। আমার উপর প্রচন্ড রেগে আছে।
কি করি।
– সবতো ভগবানের ইচ্ছে। মা সেটা বোঝেনা?
– চলো ডাক্তার দেখায়।
– ঠিক আছে তাই হবে।
ওরা ডাক্তার দেখায়।
কিছুদিন পর ধীরলালকেও মা বিয়ে দেয়।
এখন সব আদর-মমতা ছোটবউ নয়নতারার কাছে। বড় বউমার খবর রাখেনা। এটা কি সংসারের নিয়ম! কি জানি?
দিন যায়। কারো ঘরে সন্তান আসেনা। মায়ের রাগ দুই পুত্র বধুর উপর। বাড়িতে অশান্তি, হইচই। বড়ো গলায় মা বলে, একেতো আমরা নীচু জাতের। কেউ সম্পর্ক রাখেনা। আমাদের কাজ লাশ পোড়ানো। ছিঃছিঃ কোন জাতে আমাদের জন্ম হলো? লোকে বলে,
আমরা চন্ডাল। সমাজের নিগৃহীত জাত। আচ্ছা বাপু, আমরা না হলে মানুষ কে পুঁড়তো, একটু ভেবেছো কোনওদিন! ঘরে পুঁছতো। নাতিনাতনি নিয়ে সুখ পেতে চাই, তা’ও কপালে নেই। হায় ভগবান, কি অভাগ্য কপাল নিয়ে জন্ম আমার।
সকালসকাল মা দুইছেলেকে ডাকে।
দুই ভাই মাকে ভয় পায়। শ্রদ্ধা করে। মায়ের মুখের উপর কথা বলার সাহস পায়না। এই শিক্ষা তাদের বাবার দেয়া। বাবা বলতো,
– দেখ খোকারা, আমরা সমাজের খুবই নীচু জাত। আহামরি কিছুই নেই। আমরা আমাদের নিয়ে। আমাদের সমাজ ছোট। তোদের পড়াতে পারিনি। কারণ আমাদের ইশকুলে যেতে নেই। তা’ অবশ্য এখন নেই। যুগের পরিবর্তন হয়েছে। তোদের ছেলেমেয়েদের ইশকুলে পড়াবি। লেখাপড়া ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। আরেকটা কথা মনে রাখবি। মায়ের উপর পৃথিবীতো দ্বিতীয় কিছুই নেই। আমি আজ আছি , কাল থাকবোনা। মাকে কোনদিনও অশ্রদ্ধা করবিনা। মায়ের মুখের উপর কথা বলবিনা।
তখন থেকে মায়ের উপর শ্রদ্ধাশীল ওরা।
মা বলে,
– হিরা তোকে আবার বিয়ে দিতে চাই।
হিরা কিছু বলেনা।
তখন খবর আসে মানুষ মরার। পরপর তিনজন মরার খবর আসে। এরকম মাঝেমাঝে হয়। সপ্তায় সাতজনও মারা যায়। একটা প্রবাদ আছে এই শ্মশানের। মানুষ মারা গেলে একজনও যায়। তিনজনও যায়, সাতজনও যায়।
এটা হয়তো ওদের বিশ্বাস, না হয় অন্ধ ধারণা। মানুষ বয়স,অসুখেই মারা যায়। এখানে শ্মশানের দোষ কি?
মায়ের সাথে আর কথা হয়না। দুই ভাই লাশপোড়ার বিষয় নিয়ে আলাপের জন্য মানুষের বাড়ি চলে যায়।
দুই ভাইয়ের আজ বাড়ি ফিরতে মাঝ রাত হয়। তিনটি লাশের দাহ। কম নয়।
রাতের বিছানায় প্রিয়বালা কাঁদে। হিরালাল মুখহাত ধুয়ে শুতে আসে। তখনও প্রিয়বালা কাঁদছে। হিরা প্রিয়বালার মাথায়। হাত রেখে বলে,
– কি হয়েছে, তুমি কাঁদছো কেন?
স্বামীর চোখের উপর চোখ রেখে প্রিয়বালা বলে,
– তোমার মা তোমার জন্য মেয়ে ঠিক করেছে। তাড়াতাড়ি নতুন বউ আসবে ঘরে।
– কি বলছো, মা কি তাই বলেছে?
– আচ্ছা তুমিই বলো, অরুণাদয়ের অগ্নি সাক্ষী রেখে সিঁথিতে সিঁদুর পরে সামাজিকতায় তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়। এই বিয়ে এতই কি ঠুনকো, সহজে ভেঙে যাবে?
– বিয়ে ভাঙার কথা কে বললো? হিরালাল উত্তর দেয়।
– মা, তোমার জন্য দ্বিতীয় বউ আনবে, আমার দোষটা কোথায়, বলো!
আমি কোথায় যাবো এখন? ডাক্তার দেখালে,ডাক্তার আমার দোষ দেখেনি,তোমার দোষ দেখেনি। তা’ হলে আমার শাস্তি হবে কেন?
হিরালাল নির্বাক। কথা বেরুয়না মুখে।
ঐদিকেও তাই।
ধীরলালের বউ নরম নয়, কঠিন। নয়নতারা উঁচু গলায় বলে,
– আবার বিয়ে করবে?
ধীরলাল বউয়ের থেকে দূরে দাঁড়ায়। কথার উত্তর দেয়না। বউকে ভয় পায় ধীরলাল। বউ বলে,
-বিয়ে করবে আবার?
– তুমি বললে করবো। ধীরলাল উত্তর দেয়।
নয়নতারা আগুণের মতো জ্বলে উঠে। চেঁছিয়ে বলে,
– কি বললে, আমি বললে বিয়ে করবে! এক্কেবারে চুপ। এত্তো সাহসী হলে কখন? লাশ পুড়তে পুড়তে পেয়েছো?
হইচইএ ছুটে আসে শাশুড়ী।
ধীরলাল, নয়নতারা ভয়ে কাঁপে।
দরাজা খোলা ছিলো। শাশুড়ীকে দেখে নয়নতারা চুপ। ধীরলাল চুপ।
কারো মুখে কোনও কথা নেই। হিরালাল, প্রিয়বালা আসে।
শাশুড়ি উঁচু গলায় বলো,
– সবাইকে বলছি শোনো, আমার নাতি চাই। বংশধর চাই। বাজে কথা শুনতে চাইনা। এতো রাতে ঘরে উঁচু গলায় কথা বলতে লজ্জা হয়না ছোট বউমা। দোষ করবে,গলা উঁচু থাকবে সেটা হবেনা। আমাকে নাতি দাও। ব্যস আর কিচ্ছু চাইনা। হিরালাল তোর নতুন বউ ঠিক করেছি। ক’ দিনের মধ্যে নিয়ে আসবো।
ঐটুকু বলে শাশুড়ী নিজের ঘরে চলে য়ায়।
ঠিকঠিক হিরার নতুন বউ আসে ঘরে।
সুন্দরী নয়। মোটামুটি। কোন মা-বাবা চায়না এক বউ থাকতে তার মেয়ে বিয়ে দেবার। সুন্দরী নাহউক, তাতেই শাশুড়ী সন্তুষ্ট। তার একটি নাতি চাই। বেশি কিছু নয়।
হিরা, প্রিয়বালা, ধীরলাল, নয়নতারা, কারো মুখে হাসি নেই। কেমন যেন বাড়ির মাঝখানে প্রাচীর উঠেছে। একটি ঘরে দু’ দল মানুষ।
একদিকে শাশুড়ী, নতুন বউ। অন্যদিকে হিরা,ধীর, প্রিয়, নয়ন।
কিছুদিন যায়। বছর যায়।
তারপরও হেমলতার ঘরে নাতি আসেনা।
মা’র রাগ হয়না আর। মা এবার চুপ। হয়তো মা বুঝতে পারে এটাই ভাগ্য!
সত্যিসত্যি ভাগ্য প্রসন্ন হয় প্রিয়বালার। কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে ছেলে। ঘর ভরে যায় আনন্দ। নাতিকে বুকে তুলে সেকি আদর! চুমোয়চুমোয় ভরিয়েে দেয় নাতির নরম গাল। শাশুড়ী প্রিয়বালাকে জড়িয়ে ধরে।
হায়রে মানুষের স্বার্থ। লাভের দিকে শুধু ছুটে।
নয়নতারা, হেমলতা এক্কেবারে অনাথ, অসহায় এখন।
হিরালাল, ধীরলাল মায়ের কান্ড দেখে অবাক, স্তব্ধ।
নির্বাক নয়নতারা, হেমলতা।
ওরা দু’জন স্বপ্নচোখে দেখে, ভাবে, হয়তো ভাগ্য তাদের একদিন সুপ্রসন্ন হবেই। ওদের কোলে আসবে টুকটুকে সন্তান।
সত্যিই তাই।
এটাই মানুষের চরিত্র। স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বভাব। মানুষতো মানুষই।
কে উঁচু, কে নীচু মানুষের তৈরি।
শেষ কথা, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।