Site icon Shaili Tv

চার দেয়ালের মাঝে / রেজাউল করিম স্বপন

রহমান সাহেব রাশভারি একজন মানুষ। সরকারের প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তা ছিলেন। দাপটের সঙ্গে চাকুরি করেছেন কিন্তু নীতির প্রশ্নে কখনো আপোষ করেননি। চাকুরি জীবনে অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন, অনেক মানুষের উপকার করেছেন। সেই জন্য সহকর্মীদের মধ্যে তাঁর আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। অবসর নিয়েছেন প্রায় ২০ বছর হলো, এখনো পুরনো সহকর্মীরা ফোন করে খোঁজখবর নেন ও শ্রদ্ধা করেন। এক সময়ের খুব ব্যস্ত মানুষ হলেও এখন তাঁর অখ- অবসর। শৈশব কৈশোর ও জীবনের নানা স্মৃতি মনে করে এখনো রোমাঞ্চিত হন। ভাবেন কিভাবে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও লেখাপড়া করেছেন। কিভাবে জীবনে এতোটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। মনে পড়ে বয়স যখন ১২- ১৩ বছর, তখন বাবাকে হারিয়েছেন। বাবা থাকতেন রেঙ্গুনে, হঠাৎ কয়েকদিন জ্বরে ভুগে মারা গেছেন। কবরও ওখানে দেওয়া হয়েছে। বিধবা মা অনেক কষ্ট স্বীকার ও ধার দেনা করে তাঁকে লেখাপড়া করিয়েছেন। প্রতিদিন ছয় কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতেন আবার ছয় কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরতেন। খিদে পেট জ্বলে গেলেও টাকার অভাবে কিছু খেতে পারতেন না। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার আগে এক বাড়িতে লজিং থাকতেন। লজিং বাড়ির চার ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে তবেই নিজে পড়তেন। মেট্রিকুলেশন পাস করার পর কলেজে ভর্তি হয়ে এক দোকানে সেলস ম্যানের চাকুরি করে পড়ার খরচ জোগাতেন। সারাদিন দোকানে চাকুরি ও কলেজে ক্লাস করে রাতে ছাত্র ছাত্রী পড়িয়ে তারপর নিজে পড়তেন। এভাবে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে আইএ বিএ পাস করে সরকারি চাকুরিতে জয়েন করেছেন। যা এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে গল্পের মত মনে হবে। প্রতিদিন স্কুল বা কলেজের ক্লাস শেষে লজিং বাড়িতে গিয়ে খেতে বসলে মুরগীর গলা, গিলা, কলিজা বা মাছের লেজ জাতীয় তরকারী ছাড়া অন্য কিছু জুটতো না। তবুও ভালভাবে লেখাপড়া শেষ করে ভাল একটা চাকুরি করবেন, এই আশায় সব কিছু সহ্য করতেন। মনে আছে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফর্ম পূরণের সময় জমি বন্ধক রেখে টাকা নিয়েছিলেন। আর আইএ বিএ পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ করেছিলেন ধার কর্জ করে।এই অসুস্থ অবস্থায় জীবনের এই স্মৃতিগুলো তাঁর বার বার মনে পড়ে। এগুলো মনে করে তিনি নিজে নিজে হাসেন ও কাঁদেন। প্রায় আট বছর আগে ব্রেন স্ট্রোক করে শরীরের বাম অংশ অবশ হয়ে গেছে। অনেক চিকিৎসা করেছেন, অনেক থ্যারাপি দিয়েছেন কিন্তু শরীরের অবশ অংশ ঠিক হয় নি। সেজন্য নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারেন না। স্ট্রোক করার পর থেকে একটা ছেলে রেখেছেন তাঁকে হাঁটানো, বাথরুমে আনা নেওয়া ও যাবতীয় কাজকর্ম করার জন্য।এখন তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ঐ ছেলেটি। তার সাথে তিনি নিজের সুখ দুঃখ শেয়ার করেন। পুরানো দিনের গল্প ও ছেলে মেয়েদের সফলতার গল্প করেন। অন্যদিকে বছর চারেক ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন। সপ্তাহে দুই বার ডায়ালেসিস করতে হয়। সেই জন্য শরীরে সব সময় অস্বস্তি লেগে থাকে। তাঁর স্ত্রী জীবিত আছেন। তবে তাঁর শরীরেও বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ বাসা বেঁধেছে। তাঁদের সাত ছেলে মেয়ে,এর মধ্যে বড় ছেলে, মেঝ মেয়ে ও ছোট ছেলে দেশে থাকেন। বাকীরা আমেরিকা, কানাডা ও ইউকেতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। সন্তানেরা সবাই দেশে বিদেশে খুব ভাল অবস্থানে আছেন। সবার বাড়ি গাড়ি রয়েছে।এরপরেও রহমান সাহেব সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকেন।কারন ওনি চান তাঁর শরীরিক এই অবস্থায় ছেলে মেয়ে সবাই তাঁর কাছে থাকুক। কিন্তু সেটা অসম্ভব। ছেলে মেয়ে সবাই যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সবার ছেলে মেয়ে লেখাপড়া করে। রহমান সাহেব প্রতি দিন ফোনে ছেলে মেয়েদের খোঁজ খবর নেন। ছেলেমেয়েদের সাথে কথা না বললে পাগলের মত হয়ে যান, যদিও সন্তানেরা সেটা বুঝে না। সন্তানেরা তাঁকে দেখতে এলে খুব খুশি হন ও আবেগে কেঁদে ফেলেন। খাওয়া দাওয়ার রেস্টিকশনের জন্য মন চাইলেও পছন্দনীয় খাবার খেতে পারেন না। কিডনির ডাক্তার খাওয়া রুটিন করে দিয়েছেন। সকালে দুইটা রুটি,একটা কুসুম ছাড়া ডিম,এক বাটি সব্জি। দুপুরে দুই কাপ ভাত, কদু বা পেপের তরকারি দুই কাপ, ডালের পাতলা অংশ ও দুই বাই দুই ইঞ্চি একপিস মাছ বা মাংশ। রাতে দুইটা রুটি, সব্জি, মাছ বা মাংস এক পিস, ননিতোলা এককাপ দুধ ও সারাদিনে এক লিটার পানি। যদিও বাসায় প্রতিদিন অনেক রকমারি তরকারি রান্না করা হয় কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয় না। সেজন্য মাঝে মাঝে অভিমান করে খাওয়া বন্ধ করে দেন, অবশ্য শেষ পর্যন্ত সন্তানদের অনুরোধে অভিমান করে থাকতে পারেন না।প্রতি বেলা রান্নার পর ওনার পারসোনাল ছেলেকে দিয়ে খবর নেন কি কি রান্না হয়েছে কিন্তু খাওয়ার সময় ঐ ফিক্সড তরকারী ছাড়া অন্য কিছু পান না। এইজন্য তাঁর অভিযোগের শেষ নেই। কেউ তাঁর সাথে দেখা করতে আসলেই বলেন, বাসায় এতো কিছু রান্না হয় অথচ তাঁকে দেওয়া হয় না। আত্মীয় স্বজন বা পরিচিত কেউ ফোন করলেই বাসায় আসতে বলেন, আবার নিজে থেকেও পরিচিতজনদের ফোন করে বাসায় আনিয়ে নেন। কেউ বাসায় দেখা করতে আসলে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেন এবং না খাওয়াইয়া ছাড়েন না। কথা বললে তিনি খুব স্বস্তি বোধ করেন। মাঝে মধ্যে এক সন্তানের বাসা হতে অন্য সন্তানের বাসায় যান। যে দিন যাবেন সেই দিন সকাল থেকে রেডি হয়ে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে বসে থাকেন, ঐ বাসায় গিয়ে খাবেন সেই জন্য। শত চেষ্টা করেও খাওয়ানো যায় না। সারা বছর তাঁর ব্যাগ গুছানো থাকে। ঐটার মধ্যে কয়েকটা কাপড়চোপড় ছাড়া তেমন কিছু নেই, তবু কেউ সেই ব্যাগে হাত দিতে পারে না। ঈদের সময় ছেলেমেয়েরা অনেক পাঞ্জাবি, পায়জামা, ফতুয়া ও লুঙ্গি দেন। সেগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখেন, তেমন একটা পরেন না। সেই জন্য নতুন কাপড়গুলো নষ্ট হয়ে যায়। অসুস্থতার পর থেকে তাঁর সবসময় গ্রামের আত্মীয় স্বজনদের দেখতে মন চায়, তাই প্রায় বাড়িতে যান। যদিও দিনে গিয়ে দিনেই চলে আসেন। গরীব আত্মীয় স্বজনদেরকে সাধ্যমত সাহায্য করেন। যে দিন পেনশন তুলেন সেই দিন তাঁর মন খুব ভালো থাকে।একসাথে ছয় মাসের পেনশন হিসাবে লাখ টাকার উপর পান। নগদ বিশ হাজার টাকা রেখে বাকি টাকা ব্যাংকে জমা রাখেন।এই বিশ হাজার টাকা আগে তাঁর নিজের কাছে রাখতেন, কাউকে ধরতে দিতেন না। কিন্তু টাকা চুরি হয়ে যাওয়ায় এখন ছেলের বউয়ের কাছে জমা রাখেন। ওখান থেকে দুই একদিন পর পর কিছু কিছু টাকা নেন। তবে মাস শেষে সেই টাকার হিসাব নেন। তখন যদি শুনেন টাকা বিশ হাজারের চেয়ে কম, তাহলে তাঁর মাথা গরম হয়ে যায়। পেনশন তোলার দিন পাওয়া টাকা থেকে নাতিদের জন্য কিছু কেনাকাটা করেন। বাসায় গিয়ে নাতিদের সামনে ডেকে ওগুলো হাতে দেন ও সামনে বসিয়ে খাওয়ান। যাতে অন্য কেউ ঐগুলোতে ভাগ বসাতে না পারে। আবার নাতি নাতনীরা যদি কিছু কেনার জন্য টাকা পয়সা চান, সেটা সাথে সাথে দিয়ে দেন। রহমান সাহেবের পান খাওয়ার অভ্যাস আছে তবে কিনে খান না। তাঁর স্ত্রীর পানের বাটা থেকে কাজের ছেলেকে দিয়ে আনিয়ে নেন। এটা আবার রহমান সাহেবের স্ত্রীর পছন্দ হয় না। তাই মাঝেমধ্যে পান খাওয়া নিয়ে স্ত্রীর সাথে তুমুল ঝগড়া হয়। ঝগড়ার পর দুইজনেই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেন। পরে অবশ্য ছেলে/মেয়েরা গিয়ে মিটমাট করেন। প্রতিদিন ছেলেরা অফিসে গেলে ১-২ ঘন্টা পর পর ফোন করে খবর নেন। এতে ছেলেরা বিরক্ত হয়। কিন্তু এর পরেও তিনি প্রতিদিন একই কাজ করেন। ছেলেরা বাসায় থাকলে ডেকে কিছুক্ষণ সামনে বসিয়ে রাখেন কিন্তু কিছু বলেন না। ছেলে মেয়েরা সামনে বসে থাকলে তিনি স্বস্তি অনুভব করেন। যে দিন নাতি নাতনীরা তাঁর রুমে গিয়ে তাঁর টিভি রিমোর্ট নিয়ে টানাটানি বা তাঁর জিনিসপত্র তছনছ না করবে বা তাঁর কাছে থেকে টাকা পয়সা না নিবে সেই দিন তাঁর মন খুব খারাপ থাকে। ঐদিন তাঁর মনে হয় পরিবারে তাঁর গুরুত্ব কমে গেছে। প্রতিদিন কাজের ছেলেকে নিয়ে এ রুমে ঐ রুমে হাঁটাহাঁটি করেন। স্ত্রীর রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ বসেন ও স্ত্রীর সাথে মনের কথা বলেন। কিছুদিন হলো তাঁর শরীরটা বেশ খারাপ। শ্বাসকষ্টের জন্য কয়েকদিন হাসপাতালে ছিলেন। দুই দিন আগে হাসপাতাল থেকে বাসায় এসেছেন। বাসায় আসার পর থেকে ওনার মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। এরিমধ্যে একদিন তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বললেন, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলো হঠাৎ এই কথা কেন? তিনি বললেন জীবনে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে গিয়ে আর্থিক টানাপোড়েনের জন্য তোমার কোন স্বাদ আহ্লাদ পূরণ করতে পারিনি। তোমাকে একটা ভাল কাপড় চোপড় কিনে দিতে পারিনি। কোথায়ও গিয়ে তোমাকে নিয়ে আলাদা ভাবে বেড়াতে পারি নি। অথচ এগুলো তোমার পাওনা ছিলো। একথা বলে রহমান সাহেব অঝোরে কেঁদে দিলেন। তাঁর কান্না দেখে তাঁর স্ত্রীও কেঁদে দিলেন। বললেন তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ বা অনুযোগ কোনটাই নেই। তবু রহমান সাহেব বললেন, দেখ মনে হয় আমি আর বেশী দিন বাঁচবো না -তোমাকে জীবনে অনেক কষ্ট দিয়েছি, তাই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।এই কথা বলে রহমান সাহেব আনমনা হয়ে বসে রইলেন। ভাবেন এটাই বোধ হয় জীবন, আর এভাবেই হয়ত চার দেয়ালের মাঝে তাঁকে বাকী জীবন কাটাতে হবে!

Exit mobile version