Site icon Shaili Tv

জুতা সমাচার: ফ্যাশনে, আভিজাত্যে, প্রতিবাদে / ড. আনোয়ারা আলম

একটা সময়ে আমরা বাঙালিরা কি জুতো পড়তাম! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত জুতো আবিষ্কার কবিতায় পড়ি-‘চামার কূলপতি বলছেন নিজের চরণ দুটি ঢাকো – তবে ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে’। বাংলাদেশে জুতো সংস্কৃতি ব্রিটিশ শাসনের অবদান। আগে ছিল খড়ম। এমনকি পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া খড়ম পড়তেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাঙালির পাম্প স্যু পড়া শুরু। তবে ব্রিটিশ আমলে নেটিভদের অফিসে জুতো পড়ে ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল।
তখন আত্মমর্যাদার লড়াই নিয়ে ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগররের কলম হয়ে উঠলো তলোয়ার। কারণ১৮৭৪ সালের ১৪ জানুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটির এক সভায় চটি জুতো পায়ে ছিল বিধায় ঢুকতে পারলেন না।তিনি প্রতিবাদে লিখলেন যে ঘরে ফরাশে বসতে হয় সেখানে বাইরে জুতো রাখা রেওয়াজ, চেয়ার থাকলে বুট জুতো নিয়ে যদি ঢোকা যায় তবে চটি জুতো কেন নয়।শেষ পর্যন্ত সাহেবরা তাঁর যুক্তি মেনে নেন।তিনি তখন লিখলেন– ” স্বদেশে পূজ্যতে বিদ্যা জুতা সর্বত্র পূজ্যতে” মানে স্বদেশে বিদ্যার পূজা চলে জুতোর পূজা নয়।
একুশ শতকে জুতো মর্যাদার প্রতীক নয় আবার স্বদেশী বা বিদেশি জুতো বলে কোন কথা নেই। বরং কোন কোন সময় জুতো হয়ে ওঠে অপমান আর প্রতিরোধের অস্ত্র মানে জুতোর রাজনীতি।
আবার বলা হয়ে থাকে যার পায়ে জুতা সেই জানে কোথায় খোঁচা। এই জুতার ইতিহাস অতি প্রাচীন। গরম আবহাওয়ার জন্য মিশরীয়রা প্রথমে স্যান্ডেল আবিষ্কার করেন আবার ঠাণ্ডা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন পশুর চামড়া দিয়ে জুতো তৈরি করা হতো। মধ্যযুগে ব্রিটিশরা কর্ডওয়েন নামে খুব শক্ত চামড়ার জুতা পড়তো। সে-সময়ে শুধু চর্মকারেরা নতুন জুতো বানাতো সাধারণ মুচিরা পুরনো জুতা সেলাই করতো।
জুতোর ধরনেও ভিন্নতা। যেমন অভিজাত শ্রেণির লোকেরা চৌদ্দদশ ও পঞ্চদশ শতকে লম্বা ও চোখা জুতা পড়তো।তবে ষষ্ঠদশ শতক থেকে জুতার সামনের দিকটা, চোখার পরিবর্তে হয়ে গেল চওড়া। বিংশ শতাব্দীতে হিল জুতার আবিষ্কার। তখন শুধু নারীরা নয় পুরুষেরাও হিল জুতা পড়তো। চিত্র নায়িকা মেরিলিন মনেরো একবার বললেন -“ভাগ্যিস হিল জুতা আবিষ্কার হয়েছিল! অর্থাৎ জুতা কিন্তু ফ্যাশনের প্রতীক। অনেকের জুতা কেনা ও জমিয়ে রাখার অভ্যাস আছে। ফিলিপাইনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মার্কোস এর স্ত্রীর কয়েক হাজার জুতো ছিল।
স্বৈরশাসক এরশাদেরও নাকি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জুতো কেনার শখ ছিল। তা একবার তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী বিদিশার সাথে বিবাদের কারণে বিদিশা নাকি তাঁর প্রায় একশ জুতা নিজ হাতে কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলেছিলেন।
লন্ডনের দ্য সানডে টেলিগ্রাফের মতে মিশরের মুসা বিন শমশেরের জুতা সবচেয়ে বেশি দামি। নানা পশুর চামড়ার তৈরি জুতা শুধু নয়, সিল্কের জুতাও তিনি পড়তেন।
বাটার জুতার প্রতি আকর্ষণ অনেকের মজার ব্যাপার এর দাম নিয়ে। যেমন একহাজার টাকার জুতার দাম রাখা হবে ৯৯৯টাকা ৯৯ পয়সা। এটি বেশ রহস্যময়।
জুতা মারা নিয়েও বহু ইতিহাস। জুতা যেহেতু আবর্জনা বা ময়লা মাড়িয়ে চলে তাই এটি প্রতিবাদের ভাষাও। ২০০৮ সালে ইরাকি সাংবাদিক মুন্তাদার আল জায়েদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের দিকে পরপর দু’বার জুতা নিক্ষেপ করেন। আর ঐ জুতার দাম এখন কোটি ডলারের বেশি। ২০০৮ সালে সিন্ধু প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী আরবাব গোলাম রহিম ও ২০১০ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারি জুতা নিক্ষেপের শিকার হন। ভারতে জুতা নিক্ষেপের শিকার হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী চিদাম্বরম ও বিরোধী দলের নেতা এল কে আদভানি। ২০০৯ সালে ইরানের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমেদ নেজাদকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করা হয়। ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সময় চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াওয়ের দিকে জুতা নিক্ষেপ করা হয়। তবে বেশি আলোচিত হয়েছে বুশকে জুতা নিক্ষেপের ঘটনা।
আবার জুতার মালা পরিয়ে চোর, দুর্নীতিবাজ বা অপরাধীকে পুরো এলাকা ঘুরে আনা হতো একসময়ে আমাদের গ্রামাঞ্চলে। যখন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সরকার ছিল। এখনো বিভিন্ন কারণে ক্ষোভের কারণে জনতা কর্তৃক জুতা নিক্ষেপের শিকার হন অনেক রাজনীতিবিদ। আবারও কারো প্রতি রোষানলেও বসে জুতার তলা দেখানোর ও ঘটনা ঘটে কখনো কখনো।
অর্থাৎ জুতা শুধু আভিজাত্য বা ফ্যাশন বা ক্ষমতার প্রতীক না প্রতিবাদের ভাষাও।
তবে ঐ যে হিল জুতার জনপ্রিয়তা নারীর, এটি আবার বিড়ম্বনার ও হয়েছিল, যখন ২০১২ সালে ভারতে মেমোরিয়াল ভ্রমণে অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড হাই হিলের জুতা ফসকে পড়ে গেলেন।
এরপরে ও মেরেলিন মনেরো বলেছিলেন – ‘নারীকে সঠিক ভাবে হিল জুতা ব্যবহার করতে দিলে ওরা তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করবে’। আসলেই কি তাই? সময়ই তার উত্তর দেবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক

Exit mobile version