গরীব ঘরের মেয়ে সাথী। অভাবের কারণে প্রাইমারী স্কুল শেষ করে আর পড়া হয়নি সাথীর ।সাথীর বাবা সামান্য পান দোকানদার।পাঁচ মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে বসবাস করে শহর থেকে কিছু দুরে ছায়া সুনিবিড় ছোট একটি গ্রামে। গ্রামের বাজারেই সাথীর বাবার পান দোকান ।সাথী এবং সাথীর বাকী চার বোন দেখতে খুবই সুন্দরী,এ যেন ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের কিরণ সারাক্ষণ ।
সাথী বোনদের মধ্যে মেজ। পাঁচ বোনের সবাই খুব সুন্দর কিন্তু সাথী বেশি সুন্দরী অপরূপা।গ্রামের সবাই বলাবলি করে গরীবের মেয়ে বলে ভালো কাপড়-চোপড় কিনতে পারে না , ভালোভাবে চলতে পারলে মেয়েগুলোকে রাজকন্যাদের মত লাগতো।বাবা-মা সবসময় চিন্তাগ্রস্ত থাকে মেয়েদের নিয়ে ।সব মেয়েগুলো বড় হচ্ছে ,বিয়ে দিতে হবে , গরীব হলেও সব বাবা-মা চায় সন্তানের ভালো কিছু হোক ।সাথী এবং সাথীর বড় বোন দুজনের জন্যই অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব আসতে থাকে ।খুব ভালো পরিবার এবং ছেলেও খুব ভালো দেখে সাথীর বড় বোনের বিয়ে ঠিক করে ফেললো সাথীর বাবা-মা ।ছোটখাটো ভাবে সামর্থ মত সাথীর বড় বোনের বিয়ে দিলো সাথীর বাবা-মা, ছেলে পক্ষেরও তেমন চাওয়া ছিল না ।সাথীর বড় বোনের বিয়ের পর সাথীর জন্য ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু করে কিন্ত সাথী কেন প্রস্তাবে রাজী না ।বাবা-মা জানতে চাইলো কোন পছন্দ আছে নাকি।সাথী হাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললো সামনের মিয়া বাড়ির ছোট ছেলে শিমুলের সাথে দুই বছর ধরে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক ।শিমুল আমাকে কথা দিয়েছে বাড়ির বড়দের রাজি করিয়ে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে।সাথীর বাবা-মা সাথীর কথা শুনে অবাক হয়ে গেল, মেয়েকে বললো মা উনারা অনেক বড় লোক আর শিক্ষিত আমাদের মত গরীবের সাথে সম্পর্ক করতে উনারা কখনও রাজি হবেন না ।সাথীর চাচী আগে থেকে জানতো সাথী আর শিমুলের সম্পর্কের কথা ।কাজ করার সুবাধে সাথীর চাচীর আসা-যাওয়া ছিল শিমুলদের বাড়িতে ।সাথীর চাচীকে অনেক সময় টাকা-পয়সা দেয় শিমুল । শিমুল সাথীর চাচীকে দিয়ে সাথীর জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জিনিস-পত্র পাঠায় । বাবা-মার কাছে সাথী সব কথা স্বীকার করে ফেলে।সাথীর চাচীর উপর সাথীর বাবা-মার খুব রাগ হয়, সাথীর বাবা-মা বলে জেনেশুনে আমাদের বিপদে ফেলে দিলো ।
এদিকে শিমুলের পরিবারেও সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে যায়। শিমুলের পরিবারের কেউ রাজি না পান দোকানদারের মেয়েকে বউ করে আনতে । শিমুলের বড় ভাই লোক মারফত খবর পাঠায় সাথীর বাবাকে মেয়ে যেন অন্য কথাও বিয়ে দিয়ে দেয়, টাকা যা লাগবে শিমুলের ভাই দিবে বলে ।পরিবারকে রাজী করতে না পেরে শিমুল আত্মহত্যা করতে যায় , অনেক কষ্টে শিমুলকে বাঁচাতে সক্ষম হয় শিমুলের পরিবার ।কয়েক দিন ধরে সাথীর কোন খবরাখবর পাচ্ছে না শিমুল, সাথীর চাচীও আর শিমুলদের বাড়িতে কাজে আসে না, সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ।
একদিকে সাথী কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে অন্যদিকে শিমুল বাড়ির কাউকে কোন ভাবেই রাজী করাতে পারছে না ।
একদিন সাথীদের পাশের বাড়ির এক ছেলেকে শিমুল জিজ্ঞেস করলো সাথীর কোন খবর জানে নাকি, কয়েকদিন ধরে দেখছি সাথীর বাবার দোকান বন্ধ । সাথীর পাশের বাড়ির ছেলেটা শিমুলকে বললো, বাড়ির মানুষ বলাবলি করতে শুনলাম সাথীর বাবা নাকি সাথীর নানার বাড়ির ওখানের কোন এক ছেলের সাথে সাথীর বিয়ে ঠিক করেছে ।শুনলাম আজকে বিয়ে, আপনার পরিবারের হুকুমে সাথীর বাবা নাকি বাধ্য হয়ে নানার বাড়িতে নিয়ে সাথীর বিয়ে দিচ্ছে।সাথীর বোনরা কেউ যায়নি, সবার দেখলাম খুব মন খারাপ। শিমুলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো ।শিমুল তৎক্ষণাৎ সাথীর বাড়ির দিকে রওনা হলো।সাথীর বোনরা শিমুলকে দেখে কান্নায় শুরু করে দিলো, বললো সাথী আপু যেতেই চায়নি নানার বাড়ি। যাওয়ার সময় খুব কান্না করেছে, আজ আপুর বিয়ে ।
সাথীর বোনেরা শিমুলকে অনুরোধ করলো নানার বাড়ি গিয়ে যেন কোন বিশৃঙ্খলা না করে ।সাথী বোনেরা বললো, আমরা গরীব আমাদের ভাগ্য নিয়ে আর খেলবেন না প্লীজ , আমার বোনের বিয়ে ভেঙে গেলে অনেক বদনাম হয়ে যাবে। শিমুল বাড়ি এসে নিজেকে রুমে বন্দী করে রাখলো । সাথীর বিয়ের জন্য পরিবারকে দায়ী করে কান্না জুড়ে বললো আমি আর এ দেশে থাকবো না । শিমুলকে মা ও ভাইরা আস্বস্ত করলো বিদেশে পাঠাই দিবে ।বিদেশ পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু হলো। এমন সময় হঠাৎ শিমুলের মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো। শিমুল খুব মা ভক্ত, মায়ের অসুস্থতায় শিমুল আরও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লো। মায়ের ইচ্ছা মৃত্যুর আগে যেন শিমুল বিয়ে করে, শিমুলের বউ দেখে যেন মরতে পারে ।শিমুল কোন রকমে বিয়েতে রাজি হচ্ছে না। মা অনুরোধ করে দিব্যি দিয়ে কোন রকমে ছেলেকে বিয়ের জন্য রাজি করালো। এক আত্মীয়ের মেয়ের সাথে শিমুলের বিয়ে ঠিক করে ফেললো শিমুলের মা আর ভাইরা ।মায়ের কথা রাখতে শিমুল বিয়ে করলো । কিন্তু শিমুলের বিদেশ যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে গেলো না। বিয়ের তিন/চার মাসের মধ্যে শিমুল বিদেশ চলে গেলো। এদিকে বউ দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বিদেশে গিয়েও শিমুলের কোন কাজে মন বসে না । কয়দিন পর পর শুধু বলতে থাকে চলে আসবে।এভাবেই পার করতে থাকে মাসের পর মাস ।এক দিন শিমুল ফোনে শুনলো সে ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছে ।শুনে শিমুলের মনে অন্য রকম এক আনন্দ অনুভব হলো ।দেশে আসার জন্য শিমুলের মন উতলা হয়ে গেলো ।শিমুলের এমন অবস্থা দেখে মা ও ভাইরা বললো দেশে এসে ঘুরে যেতে। শুনে শিমুল দেশে আসার প্রস্তুতি শুরু করে দিলো। টিকেট করে ফেললো দেশে আসার ।শিমুল দেশে আসার তিন দিন আগে শিমুলের মা মারা যান। শিমুলের মা অনেক দিন ধরেই অসুস্থ ছিলো ।মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে শিমুল মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। শিমুল কান্না করে বলতে লাগলো এক এক করে আমার প্রিয় মানুষগুলো আমার থেকে দুরে সরে যাচ্ছে ।শিমুল নিজের ভাগ্যকে নিজে দোষ দিয়ে যাচ্ছে বারেবার । অবশেষে শিমুল দেশে আসলো , মাকে শেষ দেখা হলো না শিমুলের ।শিমুল এসেছে শুনে অনেক আত্মীয় স্বজন শিমুলকে দেখতে আসলো । সাথীর মাও আসলো শিমুলের সাথে দেখা করতে ।সাথীর মা শিমুল ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো,শিমুল বারবার সাথীর মাকে কান্না না করতে অনুরোধ করতে লাগলো ।
কেন এমন কান্না করছে জানতে চাইলে সাথীর মা বললো, তোমার সাথী বিয়ে হলে আমার সাথী এত তাড়াতাড়ি আমাদের ফেলে চলে যেত না । সাথীর মায়ের কথা শিমুল বুঝে উঠতে পারছে না ।সাথীর মাকে শিমুল বললো একটু খুলে বলুন সাথীর কি হয়েছে , সাথী কোথায় চলে গেলো । সাথীর মা কান্না করতে করতে বললো, সাথী মারা গিয়েছে গতকাল একমাস হয়ে গেলো । শুনে শিমুলের অবস্থা যেন পুরানো ক্ষততে হঠাৎ রক্ত ক্ষরণ ।জানতে চাইলো শিমুল সাথীর হয়েছিল? সাথীর মা বললো, তিন দিনের ডায়েরীয়ায় সাথী মারা গেল । হসপিটালে নিয়েও বাঁচানো গেলো না ।শিমুলের দু’চোখ বেয়ে বৃষ্টির মতো জল গড়াতে লাগলো। এত কষ্ট নিতে না পেরে শিমুলের মানসিক অবস্থা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হলো। মন খারাপে কাটতে থাকে শিমুলের দিন ।সাথীর কথা ভুলতে চেয়েও যেন কোন দিন ভুলতে পারবে না শিমুল। অনেক কষ্টে শিমুল স্বাভাবিক হাওয়ার চেষ্টা করে , ছোট শিশু সন্তানটি যেন শিমুলের বেঁচে থাকার আর এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
সময় যেতে যেতে শিমুল বউ আর সন্তানের প্রতি মায়াবী হতে থাকে।এক জীবনে মানুষের ধৈর্য্য ও সহ্যের কোন শেষ নেই, শিমুলের জীবনেও তাই হলো। শিমুল মেনে নিলো হারানো বেদনা আর পাওয়ার আনন্দে বেঁচে থাকাই জীবন ।