এক অক্ষম আক্রোশের যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল আমার সর্বাঙ্গে। টের পাচ্ছিলাম , পতঙ্গ যেমন অমোঘ আকর্ষণে ছুটে যায় আলোর দিকে, ঠিক তেমনি চরম সর্বনাশের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে আমার অবুঝ মেয়েটি। কিন্তু কি অসহায় আমি, কিচ্ছু করার ছিল না আমার। আমি যে তার গর্ভধারিণী নই । কেবলি বাৎসল্যের তীব্র তাপে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিলাম।
রাত ঠিক ১২:২০। আমার নিঃশব্দ মোবাইলে আলো জ্বলতে দেখে উদ্ভিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম।
এতো রাতে তারিনের ফোন! কোন দুঃসংবাদের বার্তা বয়ে আনেনি তো , এমনটি ভাবতে ভাবতে অস্বস্থির সাথে “হ্যালো” বলতেই তারিনের উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর। আবেগের রাশ টেনে ধরতে ব্যর্থ সেই শব্দাবলী এখনো আমার কানে বাজে, “মিস, আপনাকে ঠিক কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা। আসলে কিছুই ঠিক ছিল না। এক অসম্ভবের আগাম সতর্ক বার্তার মতো আমার ইন্দ্রিয়ের কোথায় যেন “ঠং” করে বেজে উঠেছিল। বললাম, “কি বলছ, আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।” আমার স্পষ্টতা হয়তো তাকে বিব্রত করে তুলেছিল। তাই সে মোবাইলটা তার মায়ের হাতে ধরিয়ে দিল। পরদিন সন্ধ্যায় তারিনের গায়ে হলুদের খবরটা তার মা এমনভাবে জানালেন, যেন তিনি কোন আগাম মৃত্যুসংবাদ পরিবেশন করছেন। আর আমি বজ্রাহতের মতো মোবাইল হাতে বসে রইলাম কয়েক মূহুর্ত।
কি করে সম্ভব? সেই ছোট্ট তারিন, ক্লাশ ফোরের তারিন কোত্থেকে যেন ছুটে এলো আমার চোখের সামনে। মিষ্টি চেহারার চুপচাপ তারিন। পড়া শিখতে পারার আনন্দে উজ্জ্বল তারিন। পড়া ফাঁকি দেয়া দুষ্টু তারিন। জুলজুল করে তাকিয়ে থাকা আমার সেই কচি শিশু আজ এত বড় হয়ে গেছে যে স্বাধীনতার নামে ডুবতে বসেছে? কম বয়সে পিতৃহারা মেয়েটি অগাধ সম্পদের মাঝেও কেমন নিঃসঙ্গ থাকতো! তার পড়াশুনার বিষয়টি যখন আমার দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত হলো, পরম যতেœ আমি তাকে আগলে নিয়েছিলাম।
তারিনের সঙ্গীহীন একঘেঁেয় জীবনে এক সুনীল আকাশের মতোই ছিল আমার উপস্থিতি। স্কুল আর বাসার মধ্যে যার গন্ডী নির্ধারিত ছিল, তাকে একটু একটু করে আশা ও আনন্দের সোনালী রোদ এনে দিয়েছিলাম আমি মুঠোয় পুরে। ছোট ছোট বিষয় থেকে আনন্দ কুড়িয়ে নেয়ার এক নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছিলাম তাকে।
স্নেহ-মমতা আর ভালবাসার সবটুকু ওম দিয়ে তাকে আমি জড়িয়ে রাখতে চাইতাম। এ যেন তাকে আশ্বস্থ করা যে ‘আমি তো আছি।’ তার মায়ের সাথে চমৎকার এক সম্পর্কের কারণেই আমি জানতে পেরেছিলাম যে অদূর ভবিষ্যতে সে কোটি টাকার স্বত্বাধিকারী হবে। সে কারণে আমি যেন প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম তার জন্য। পাছে কেউ তার কোনে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়! তাই যতদুর সম্ভব জীবনের বিচিত্র রূপ-রস-গন্ধ স্পর্শের প্রকৃত স্বরূপ শেখানোর চেষ্টা করতাম। আর মেধাবী তারিন সম¯ Íকিছু খুব সহজে শিখে নিত। কিন্তু হায়, যদি জানতাম এত সহজে সে প্রলুদ্ধ হবে কুহেলিকার মায়াজালে! সমস্ত রাত নিষ্ফল আক্রোশে জেগে রইলাম বিছানায়।
তারিনের গায়ে হলুদ। ঘর জুড়ে মাত্র ১০/১২ জন্ মানুষ। আমার প্রিয় ছাত্রী, স্কুলের গন্ধ যার শরীর থেকে মুছে যায়নি, সে হাত রেখেছে এক কলেজ পড়–য়ার হাতে, যার বাবার নাকি একটি গ্যারেজ রয়েছে। বুকের ভেতরে এক অদম্য কষ্ট তোলপাড় করছিল নীরবে। আমার চোখের সামনে সর্বনাশা এক লেলিহান শিখা ছুটে আসছিল তারিনকে গিলে খেতে। টের পাচ্ছিলাম সমস্তই, কিন্তু প্রতিরোধ করার কোন সুযোগই রাখেনি সে। এক পর্যায়ে লজ্জা বিসর্জন দিয়ে মেয়েকে ডেকে বললাম “মামণি, আমার একটি অনুরোধ তুমি রাখবে?” সে প্রবল উৎসাহে আমাকে জানালো-“ইয়েস মিস্।”
বললাম-“কোন রকম পার্সোনাল ভিডিও করবেনা তুমি।” বিস্মিত সেই দৃষ্টি আজো ভুলবার নয়। তারিন জানতে চাইলো-“কেন?” শুধু বললাম-“আমি নিষেধ করেছি বলে।”
তারিনের বিয়েতে যাওয়ার আগ্রহ জাগেনি আমার। এক অদ্ভুত বিষন্নতাবোধ গ্রাস করেছিল আমকে। নিজেকে প্রচন্ড রকম ব্যর্থ মনে হচ্ছিল। সেই ব্যর্থতার জ্বালা নিজের মধ্যে রেখে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। প্রায় মাস ছয়েক পর এক মেয়েকে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলাম। এ কি! তারিন এখানে কি করছে? তার গাড়ি বা ড্রাইভার গেল কোথায়? এগিয়ে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখতে সে চমকে ফিরে তাকালো । উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে এত বেদনাও যে থাকতে পারে! নির্বাক মোমের পুতুলের মতো সে তাকিয়ে রইলো কয়েক কেসেন্ড। এরপর আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
কথা রাখেনি তারিন। এক লম্পটের মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়ে প্রতিটি রাতের চিত্র ধারণ করেছিল ল্যাপটপে। আর পার্সোনাল ক্লিপ্স্ নেট’এ ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তার কোটি টাকার সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে চলে গেছে তার বর। আর সেই শোকের চরম ধাক্কায় তার মা’ও টিকতে পারেনি। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে তারিনকে একা ফেলে রেখে তিনিও পরপারে ঠাঁই নিয়েছেন।
সেই ব্যস্ত জনবহুল বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে নিজেকে চরম স্বার্থপর বলে মনে হল আমার। মনে হল নিজের অভিমানে ডুবে থেকে সর্বনাশের সেই কালোছায়ার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমিতো জানতাম ঠিক এমনটিই হবে। অথচ কৈশোরিক ভুলের বেদীতে তারিনকে বিসর্জন দিয়ে আমি কত দুরে সরে গিয়েছিলাম। ঝাপসা হয়ে এলো আমার চোখজোড়া। চারপাশের সমস্ত কোলাহল আর কৌতুহলকে অগ্রাহ্য করে আমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আমার অবুঝ তারিনকে যতক্ষণ না তার কান্না ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল।