ছেলেবেলায় মায়ের কোলে বসে পরী দিঘির কথা অনেক শুনেছি। তখন আমার বুঝার বয়স হয় নি। কেবল গল্প শুনতাম। যখন বুঝতে শিখেছি, তখন বাইনা ধরতাম পরী দিঘি দেখতে যাবো। মা আমাকে বলতেন পরী দিঘি দেখতে আরও বড় হতে হবে। আমি কেবল বড় হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। রাতে ঘুমানোর সময় সেই লাল পরী, নীল পরীর ছবি আঁকতাম মনের ক্যানভাসে। কখনও গায়ের লোম কাটা দিয়ে উঠতো। তারপর স্কুলে পড়ার সময় আমি নিজেই গিয়েছিলাম পরীর দিঘি দেখতে। সম্প্রতি আরেক বার গেলাম স্মৃতিময় ঐ দিঘির পাড়ে।
নানা বাড়ি গিয়ে বহুবার রাতে ঘুমাবার সময় নানীর কাছে পরীদের গল্প শুনতাম। নানী একদিন বললেন তাঁদের ছাদে ভরা পূর্ণিমায় পরীর দল এসে নাচ গান করে। বাড়ির গাঁ বেয়ে ওঠা চিলেকোঠা পর্যন্ত একটি কাঠ-বাদাম গাছ। ঐ গাছের ডালে পরীরা দোলনা বানিয়ে দুলত। তারা যে রাতে নাচ গান করত সে রাতে গাছের বাদাম খেয়ে নিতো। তারপর পুকুরে নেমে সাঁতার কাটত। ছোট পরীরা পানিতে নেমে মুখে পানি নিয়ে বুঁদবুঁদ করত। এভাবে চলতো তাদের পানি খেলা। আমার শফিক মামাকে একবার এই ছোট পরীর দল পুকুরের মাঝখানে টেনে নিয়ে যায়। তিনি পরীদের সাথে খেলা করে। খেলা শেষে ঘরে ফিরলে মামা শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। আজও শফিক মামা পরীদের সেই খেলার ভার বয়ে বেড়াচ্ছেন।
আমাদের স্কুলে ছগির স্যারের কাছে শুনেছি সেই পরীর গল্প। এমন কি পটিয়া মাদ্রাসায় সে সময় নাকি জিন-পরীর শিশুরা লেখা-পড়া করত। তাদেরকে দেখতে পেতো না। ছায়া স্পর্শ করা যেতো না। স্যার বলেছেনÑতারা যেদিন হাট-বাজারে যাবে সেদিন নাকি প্রচুর মাছ মাংস আর তরকারি বিক্রি হয়ে যেত। লোকজন বুঝে নিতে পরীর পাল নেমেছে তাই সবকিছু তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। এক পরীর ছেলে নাকি পটিয়া মাদ্রাসার পাশের বাড়িতে টিউশনি করত। সে দেখতে নাকি অনেক সুন্দর ছিল। ছিল মেধাবী। কিন্তু কেউ জানত না সে পরীর ছেলে। এক বৃষ্টির দিনে পরীর ছেলে তার ছাত্রকে নিয়ে পড়াতে বসলেন।ছাত্রের মা তালের রসের পিঠা তৈরি করছিলেন। তাল পিঠা তৈরি করতে কলা বা কাঁঠাল পাতার প্রয়োজন হয়। সন্ধ্যায় আকাশ ঝাঁকিয়ে বৃষ্টি নামল সাথে বজ্রপাত বিজলী পাতার খেলা। অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি। ঠিক সে সময় মা ডেকে তার ছেলেকে বলল ক’টা কাঁঠাল পাতা পেড়ে আনার জন্য। বাহিরে মুষল ধারে বৃষ্টি কিভাবে কাঁঠাল পাতা ছিড়বে চিন্তা করতে লাগল। শিক্ষক বিষয়টা টের পেয়ে তাকে বলে ঠিক আছে তুমি পড় আমি ব্যবস্থা করব। ঐ পড়ার কক্ষের পাশে কাঁঠাল গাছ ছিল। ছাত্রকে বলল কাউকে বলা যাবে নাÑএ শর্তে কাঁঠাল পাতা পেড়ে দিবে। ছাত্র শর্তে রাজি হল। ছাত্র দেখতে পেল তার শিক্ষক জানালা দিয়ে বিশাল লম্বা আকারের হাত বের করে গাছ থেকে কাঁঠাল পাতা ছিড়তে লাগল। ছাত্রের মা রান্না ঘর থেকে দেখল লম্বা একটা হাত গাছ থেকে পাতা ছিড়ছে। ভয়ে চিৎকার দিল। ছাত্র ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। সবাই দৌড়ে আসল। শিক্ষক উধাও।
সেদিন থেকে আর ঐ শিক্ষক পড়াতে আসেনি। তাকে মাদ্রাসায়ও খুঁজে পাওয়া যায় নি। পটিয়ার পরীর দিঘিতেও পরী বাস করতো। পরীর দিঘি নাকি পরীরা এক রাতে খনন করেছিল। পটিয়া সদর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ১৪ নং বোর্ড কার্যালয়ের পাশে পরীর দিঘি অবস্থান। এখন আর সেই বোর্ড নেই। পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডে পাইক পাড়া এলাকায় গেলে দেখা মিলবে পটিয়া পরীর দিঘি। দিঘির পাড়ে রেইনট্রি। গাছের ছায়া জলের ওপর জলছবির মতো ভাসছে। একটু সামনে পাইক পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাস্তার পাশে চায়ের দোকান। সেখানে বসে চা পান করছিলাম। কাপে লিকারের ওম ধোঁয়া উড়ছিল। এলাকার আড্ডাবাজ তরুনরা এই দোকানে ভিড় করে। চা ওয়ালা বেশ রসিক। তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সে জানালো এলাকার বড় জ্যাঠা পরীর গল্প জানে। সে নিজেই নাকি বার কয়েক পরী দেখেছে। আমরা কজন মিলে আড্ডা দিচ্ছি এরমধ্যে পাইক পাড়া এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি ছালেহ আহমেদ হাজির। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।
ছালেহ চাচা আমাদেরকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন পরীর দিঘির গল্প শোনাতে। চাচার বয়স প্রায় নব্বই। ইংরেজ আমলের লোক। আহ্ কত গল্প জানে রে। বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন তিনি। বয়সের ভার তাঁকে সেভাবে কাবু করতে পারেনি। সারাদিন চায়ের দোকানে নতুবা বাড়িতে বসে গল্প-স্বল্প করে সময় কাটায়। অত্যন্ত রহস্য করে কথা বলেন। তার কথা শুনলে মনে হবে, আসলেই ঘটনা এইতো কিছুক্ষণ আগেই ঘটে গেছে। বললেইÑএই পরী দিঘিতো এক রাতে খনন হয়েছে এটা সত্যি। এক রাতে! হ্যঁ। বাপ রে। আর যে রাতে দিঘি খনন হয়Ñসেদিন ছিল অমাবস্যার রাত। গভীর অন্ধকার। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। মানুষজনের কোন সাড়া শব্দ নেই। সারা রাত একটি বাড়িতে ঢেঁকিতে চাল ভাঙা হয়। অমনি চলে খনন। তারপর খপ খপ করে মাটিগুলো সরিয়ে ফেলা হয় অন্য খানে। রাত ফর্সা হতে থাকে। ভোর হয়। দিঘি খনন শেষ। দিঘিতে পানি উঠে গেলো। পরীরা যেÑ কোথায় গেল, কেউ জানে না। সকাল বেলা দেখা গেলো বিশাল দিঘি। এটিই পরীর দিঘি।
ছালেহ চাচা আরও বলেনÑপরীরা নাকি ঢেঁকির শব্দ শুনে পালিয়ে যায়। কিন্তু পর রাতে সেই ঢেঁকিটি দিঘিতে পুতে রেখেছিল পরীরা। এক সময় ভয়ে মানুষ দিঘিতে নামতো না। সবাই জানতো ওখানে পরীদের বাস। পুকুরে নামলে হয়তো কোনো ক্ষতি হবে। সে সময় অলৌকিকভাবে কোনো বিয়ে শাদি কিংবা মেজবানে পরীর দিঘিতে মাঠির হাঁড়ি, পাতিল, থালা বাসন পাওয়া যেতো। সেগুলো মানুষ ব্যবহার করতো। কাজ ফুরালে আবার দিঘির পাড়ে রেখে আসতো। দিঘি সেগুলো টেনে নিতো তার গভীরে। সেসময় নাকি কে বা কারা একটি থালা গোপনে চুরি করে রেখে দেয়। সেই থেকে পাড়ার মানুষ আর থালা পাতিল পেতো না। কখনও থালা বাসন ভেসে উঠেনি।