গভীর রাতে দুঃস্বপ্নে নিতার ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তিনটা বাজে। নিতা দুঃস্বপ্নটা দেখেছে স্বামী আসিফকে নিয়ে। যে কিনা হাসপাতালের বেডে শুয়ে জীবনের শেষ সময় কাটাচ্ছে। দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় নিতা ঘামাচ্ছে ও থর থর করে কাঁপছে।
আসিফের সাথে নিতার সংসার জীবনের বয়স মাত্র ১১ বছর। তাদের দুটো বাচ্চা একজনের বয়স ৯ আরেক জনের ৬। নিতা পার্শ্বে শোয়া বাচ্চাদের গায়ে হাত দিয়ে দেখছে ওরা ঠিকভাবে ঘুমাচ্ছে কিনা। দুঃস্বপ্ন দেখায় নিতার খুব অস্থির লাগছে ও চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। ভাবছে হাসপাতালে গিয়ে স্বামীকে জীবিত দেখে কিনা? নিতার ইচ্ছে করছে এখুনি হাসপাতালে ছুটে যেতে কিন্তু সঙ্গে কেউ না থাকায় ও রাত গভীর হওয়ায় যেতে পারছে না। ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক পায়চারি করছে আর আল্লাহকে ডাকছে। ভোর হতে এখনো দুই ঘন্টা বাকী, নিতার কাছে এই দুই ঘন্টাকে মনে হচ্ছে দুই বছরের চেয়েও বেশী। পাঁচটার দিকে ফজরের আজানের পর তাড়াতাড়ি নামাজ আদায় ও স্বামীর সুস্থতা কামনায় দোয়া করে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়। হাসপাতালে গিয়ে স্বামীর কেবিনের কাছে যেতেও নিতার ভয় করছে। একবার মনে হচ্ছে স্বামী বেঁচে নেই। তবুও মনকে শক্ত করে ভয়ে ভয়ে কেবিনে ঢুকে। কেবিনে ঢুকে দেখে আসিফ ঘুমাচ্ছে। বেডের কাছে গিয়ে আসিফের মাথায় হাত রাখে, সাথে সাথে আসিফ চোখ খুলে তাকায় কিন্তু কিছু বলতে পারে না। কারণ কথা বলার মত শরীরের অবস্থা আসিফের নাই। স্ত্রীর দিকে করুণ চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আসিফের চোখ খোলায় নিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
কিছুক্ষণ আসিফের মাথায় হাত বুলিয়ে পাশের বেডে গিয়ে নিতা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। নিতার ইচ্ছে করছে আসিফকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়, কারণ আসিফের সারা শরীরে নল লাগানো। এক হাতে স্যালাইন অন্যহাতে রক্ত দেয়া হচ্ছে। ডাক্তাররা বলেছে আসিফ আর বেশীদিন বাঁচবে না। বড়জোর ৫-৬ মাস বাঁচবে। এরপর আসিফ এই জগতে থাকবে না, অন্য জগতে চলে যাবে। এটা ভাবতে গেলে নিতা নিজেও অন্যজগতে চলে যায়। মনে মনে ভাবে আসিফের আগে যদি সে মরে যেতো পারতো তাহলে আসিফের মরা মুখ আর ওকে দেখতে হবে না। কিভাবে আসিফকে আরো কিছুদিন বাঁচানো যায় সেজন্য নিতা অনেক ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। সব ডাক্তারের এক কথা আসিফের শরীরের ক্যানসার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। একথা শুনার পর থেকে নিতা নিজেই আস্তে আস্তে বোধ শক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে। নিতা প্রথমে আসিফের ক্যানসারের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়ে। প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতে তার কস্ট হচ্ছিল কারণ কোন উপসর্গ ছাড়া শুধুমাত্র কয়েকদিন টানা জ্বরে ভোগা রুগির কেন ক্যানসার হবে? তবুও মনকে শক্ত করে দেশের নামকরা সব ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছে এবং ডাক্তারের পরামর্শ মত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করেছে। গত কয়েক মাসে জমানো যে টাকা ছিলো তা প্রায় শেষ হয়ে আসছে তবু নিতা হাল ছাড়ছে না। তার বিশ্বাস আসিফ শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে ওর কাছে ফিরে আসবে। নিতার সবচেয়ে কষ্ট হয় যখন আসিফ ব্যথায় কাতরাতে থাকে। আসিফের শরীর তখন ব্যথায় কালো হয়ে যায়। নিতা সামনে থাকলে শক্ত করে আসিফের হাত ধরে রাখে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিতারও তখন খুব কষ্ট হয় কিন্তু কিছুই করার থাকে না, আনমনা হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া। ব্যথার ওষধ খেলে অনেকক্ষণ পর আস্তে আস্তে ব্যাথা কমে।বাচ্চারা বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন করলে নিতা ওদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়।বলে খুব দ্রুত ওদের বাবা সুস্থ হয়ে বাসায় চলে আসবে। যদিও মিথ্যা বলতে নিতার খুব কষ্ট হয় তবুও সে এই মিথ্যাটা বলে। প্রতিদিন বিকালে বাচ্চারা বাবাকে দেখতে আসলে আসিফ একটু স্বস্তি অনুভব করে।বাচ্চাদের দিকে ফেলফেল করে এক দৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকে। বাচ্চাদের হাত ধরে রাখে, মাথা ও শরীরে হাত বুলিয়ে দেয়। এই দৃশ্য দেখে নিতার খুব কস্ট হয় ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। তবুও নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করে। নিতা চায় সামনের কয়মাস সার্বক্ষণিকভাবে আসিফের সাথে থাকতে ও কথা বলতে। কিন্তু সেটাও পারছে না ডাক্তারের বারণের জন্য। অন্যদিকে স্বামী অসুস্থ হওয়ায় নিতার ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না শেষ করে বাচ্চাদের রেডি করে স্কুলে পাঠিয়ে তারপর নিজে রেডি হয়ে হাসপাতালে যায়। কিছুক্ষণ হাসপাতালে থেকে অফিসে চলে যায়। অফিসে গেলেও নিতার মন পড়ে থাকে হাসপাতালের বিছানায়। সবসময় আতংকে থাকে,এই বুঝি খারাপ কোন খবর আসে। মোবাইলে ফোন আসলে ভয়ে ভয়ে ধরে। গত ছয় মাস নিতা ঠিকমত ঘুমাতে পারে না, প্রতি মুহূর্তে আসিফের চেহারা ভেসে উঠে। ঘুমাতে গেলে, বাসায় আসলে বা অফিসে গেলে মনে হয় আসিফের সাথে আর দেখা হবে না। সেজন্য সারাক্ষণ মনে মনে আল্লাহকে ডাকে।আসিফের ক্যানসার ধরা পরার পর থেকে নিতা একবারও হাসে নাই। অথচ স্টুডেন্ট লাইফে নিতা সারাক্ষণ শুধু হাসতো।এই হাসির জন্যই আসিফ নিতাকে পছন্দ করেছিলো। এতো হাসিখুশি একটা মেয়ে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ নিস্তব্ধ। বিয়ের পর আসিফ অফিসের কাজে কোথাও গেলে নিতাকে সঙ্গে নিয়ে যেতো। আবার নিতা কোথাও বেড়াতে গেলে আসিফও চলে যেতো।একবার অফিসের কাজে নিতা কক্সবাজার যায়। সারাদিন কাজ শেষে হোটেলে ফিরে দেখে আসিফ হোটেলের রিসেপশনে বসে আছে।নিতা রাগ করে আসিফকে জিজ্ঞেস করে, কেন সে কক্সবাজার এসেছে তখন আসিফ বলে তোমাকে ছাড়া একা কিভাবে থাকবো বলো? একথা শুনার পর নিতার চোখে পানি এসেছিলো। আসিফ চাইতো সবসময় নিতা ওর কাছাকাছি থাকুক। সুখের দিনগুলো নিতার এখন খুব বেশী মনে পড়ে। মনে পড়ে দুজন একজন আরেক জনকে লোকমা তুলে খাইয়ে দেওয়ার কথা। কোন পার্কে বা মেলায় গেলে দুজনে কাড়াকাড়ি করে আইসক্রিম খাওয়ার কথা। নিতা কোন পানীয় খেতে চাইলে সেটা আসিফ একটু খেয়ে বাকিটা নিতাকে খেতে দেওয়ার কথা।মনে পড়ে ইচ্ছে করে নিতাকে রাগিয়ে আবার জড়িয়ে ধরে রাগ ভাঙানোর কথা। মনে পড়ে আসিফ বাসায় থাকলে নিতাকে না দেখার ভান করে আড় চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার কথা। আসিফ এসব করলে নিতা বাইরে খুব রাগ দেখালেও ভিতরে ভিতরে খুশি হতো। এখন নিতার খুব ইচ্ছে করে আসিফ আবার ঐ কাজগুলো করুক। আবার তার সেই সুখের দিনগুলো ফিরে আসুক। তখন সে নিজেই আসিফকে জড়িয়ে ধরবে যদিও তা আর হওয়ার নয়। নিতা এটাও জানে তার জীবনের সেই স্বর্ণালী দিনগুলো আর কখনো ফিরে আসবে না। সে জন্য এখন থেকে সে একাকীভাবে চলার চেষ্টা করছে। আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবরা সবসময় ফোন করে ওকে সাহস দেয়। বলে ধৈর্য ধরতে, সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু নিতা জানে ওর জীবনের সবচেয়ে দামী জিনিসটি ওর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে এবং অচিরেই তা চিরতরে হারিয়ে যাবে। সেজন্য নিতা এখন আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া করে যেন আসিফ শেষ সময়ে কষ্ট কম পায় এবং নিতার সামনেই যেন আসিফের অন্তিম যাত্রা শুরু হয়।