রাত বাড়তে বাড়তে বসনলালের ঝুপড়ি ঘরের চারপাশে যেনো ভৌতিক ছায়া নেমে আসে। বসনলালের ভাঙাচোরা ঝুপড়িতে সেই সন্ধ্যা হতে মদ গিলছে জিন্নাত। বসনলালের ঘরণী বলে ‘জিনু ওস্তাদ’। হাসে বসনলালের ঘরণী সাগরি খিল খিল করে। সে হাসির তোড়ে জিন্নাতের পৃথিবীও যেনো দুলে উঠে। ‘তুই, ওস্তাদ, এতো দারু পিয়াস কী করে? তুই চউখ খুলতে পারিস না-উঠে দাঁড়াতে পারিসনা-আবার গিলাস হাতে লস্’-সাগরি আড় চোখে মেপে দেখে জিন্নাতকে। জিন্নাতকে সমানে শাসিয়ে যায় সাগরি।
চার গেলাস টানার পর জিন্নাতের মাথা যেনো একেবারে সাফসুতরো হয়ে যায়। কোথায় কী ভুলে যাবে-অথচ সব কিছু যেনো ঠিক ঠিক ফিরে আসে তার কাছে।
আধো আলো-আঁধারে বসনলাল-সাগরির শ্রীছাঁদহীন ঝুপড়ির সব কিছু যেনো তার চোখে পড়ে। বেড়ায় সাঁটা আছে সিনেমার নায়িকার ঝলমলে পোস্টার। কাপড় চোপড়ের বালাই বলতে নেই। পেছনে মাটির লেপানো দেয়ালে মোষের দারুণ ছবি এঁকেছে বসনলাল। কী এমন জিনিস পত্তর-একটা ঢুলো আলমিরা-সামনে তারের জাল-তার উপর ফুলের নকশা আঁকা ঢাউস টিনের ট্রাঙ্ক।
সেই কবে থেকে অতসব দেখতে দেখতে মুখস্থ হয়ে গেছে জিন্নাতের। চোখ বন্ধ করে যেনো ঠিক ঠিক বলে দিতে পারে-সাগরিদের ডেরায় কোথায় কী আছে।
‘ওস্তাদ’। কে ডাকে মাথাটা নেড়েচেড়ে শুনতে চায় জিন্নাত। হ্যাঁ-তাইতো-কে ডাকে।
জিন্নাত ঠিকঠাক মতো উঠে দাঁড়াতে পারে না। পা জড়িয়ে যায় অগোছালোভাবে। ঝিম মারা চোখে বাইরে দেখে। ‘লে বাবু-মইনা ডাকতে লিছে।’ সাগরি হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে। ‘রাইত বাইড়ছে ঘর যাবি না বাবু? ঘর যা…।’ জিন্নাত কী শোনে ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তবে আধো আধো বোঝে-সাগরি কথা বলছে। ঘর-আরো কী কী যেনো বলছে। নেশার মৌতাতে বেশ ভালোই লাগে জিন্নাতের। জিন্নাতের মনে পড়ে যায় সাগরির কথা-বসনলালের ঘরণী বৌ। হাসে ম্লান জিন্নাত। বসনলালের সাগরিকা তার কাছে সাগরি। লম্বা চওড়া নাম জিন্নাতের ভারি অপছন্দ।
ঘুরে ফিরে জিন্নাতের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় সাগরি। বেঁটে খাটো এক হারা দোহাতি মেয়ে সাগরি। কানে-গলায় রূপার জমকালো অলঙ্কার? হাতে রূপোর হালকা বালা। পায়ে নূপুরও পরে সাগরি। আঁটসাট ফুলের নকশার কাপড়।যত্ন করা বাঁধা খোঁপা। চোখে মোটা কাজলটানা। ঠোঁটে মোটা লিপস্টিক। চটুল চাউনি। দিশি আতরের ভুরভুর গন্ধ। বসনলালের ঘরণী সাগরি।
বসনলাল কোনো দিন কাজে যায় তো-কোনো দিন যায়ও না। দারু টেনে টেনে ডেরায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে। সাগরি একাই যায় সুইপারের কাজে। আর রাত নামার সাথে সাথে তাদের ঘিঞ্জি ডেরায় চলে দারুর বিকিকিনি। মোটা গেলাসের টুং টাং শব্দে জেগে উঠে বসনলালের ঝুপড়ি ডেরা। সেই বসনলালের ডেরায় অনেকেই আসে। জিন্নাতও আসে। না এসে পারে না।
কে কী বলবে জিন্নাতকে! কুদরত, মইনা, এদের সাথে এই সুইপার কলোনিতে আসতে আসতে একসময় সাগরির ঘরের মানুষ হয়ে গেছে জিন্নাত। সাগরি বেশ আদর করে ডাকে জিনু বাবু। জিন্নাত যেনো অপেক্ষায় থাকে সাগরির সেই আদুরে ডাকের।
জিন্নাত কিন্তু এমনটা ছিলো না। বাবার ছোটখাটো চাকরি। মার ঘর সামলানো। তার ছিলো স্কুল-পড়াশোনা। কিন্তু মা’র সাথে বাবার হঠাৎ হঠাৎ খিটিমিটি-ঝগড়াঝাটি। তারপর সে এক সময় বাবার সাথে মার ভারি দ্বন্দ্ব লেগে গেলে মা যে কোথায় চলে যায় কেউ জানেনি। আশপাশের লোকজন ইশারা ইঙ্গিতে বলে-মা নাকি কার হাত ধরে পালিয়েছে…। তারপর মা জিন্নাতের কাছে শুধু মৃত অতীত।
সেই হতে ওলোটপালট জিন্নাতদের ঘরদোর। বাবা ভীষণ চুপচাপ। জিন্নাত পড়ালেখা ছেড়েছে। নেমে গেছে মিনাজদের সাথে আড্ডাবাজি-দু’নম্বরি কাজে। কার কার বেহুদা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া-ভাগবাঁটোয়ারার মোটা টাকা হাতে। তারপর অনেক অজায়গা-কুজায়গায় যেতে যেতে সন্ধ্যার পর পর বসনলাল সাগরির ডেরায় দারুতে ডুবে থাকা।
মাঝে মাঝে দিন দু’দিন কোথায় উধাও। বাবা প্রথম প্রথম চেঁচামেচি করলেও জিন্নাতের মেজাজ দেখে-আর বড়ো একটা ঘাঁটায় না। ব্যস্, জিন্নাতের এখন হাত-পা ঝাড়া। ঘরে ফিরলো তো ফিরলো না। রাত কেটে যায় এখানে ওখানে…।
তার বাবা-মা কেউ না থাক তো কী হয়েছে? তার তো সাগরি আছে। সাগরির দারুর গেলাস আছে। সাগরির খিল খিল মাতাল করা হাসি আছে। আর এ কাজ সে কাজ করে জলের মতো তো টাকা কামাই আছে। তাইতো জিন্নাত এখন সাগরির জিনুবাবু।
মাঝে মাঝে কুদরত ধরে বসে জিন্নাতকে। ‘ওস্তাদ চলেন নতুন খবরাখবর আছে। ফুর্তি-ফার্তি করবেন। আমোদ পাইবেন।’ হাসে জিন্নাত বোঝে। কুদরত তাকে নিয়ে খেলতে চায়। জিন্নাত কুদরতের ফাঁদে পা দেয় না। সে কোনো ফাঁদে পা দিতে চায় না। জিন্নাতের খুব মনে পড়ে-কদিন আগে সাহানা নামের মেয়েটিকে নিয়ে ভারি বিপাকে পড়তে হয়েছিলো জিন্নাতকে। প্রায় খুনোখুনির কা- হতে চলছিলো মঠবাড়ির কানা সাত্তারের সাথে। পরে সামাল দিতে এগিয়ে আসে পার্টির আলফাজ মিয়া, শালার লুচ্ছা?
জিন্নাত এখন আর নাচে না কুদরত, জাফুর কথায়। নিজে নিজে হিসাব করে চলে। আজ সাগরির ডেরায় আসার আগেই সাহানা কল দিয়েছিলো। মোবাইলে নাম দেখে রিসিভ করেনি জিন্নাত। জিন্নাত ভাবে-সত্যি এসব মেয়েমানুষগুলো অদ্ভুত ধরনের। যখন যার তখন তার। চারদিকেই হাত রেখেই চলে। তার কাছে কানা সাত্তার যা আবার জিন্নাতও তা। বোঝে এসব জিন্নাত। সাগরি কাছে এসে হাত ধরে জিন্নাতের। ‘জিনুবাবু কী ভাব ছিলিস বাবু-ল্ ঘর যাবিক না। ঘর যা বাবু। রাত বহুত হইয়া গেছে শুনিস। আজ আর দারু না পিয়াস বাবু…।’
গেলাস সরিয়ে নিতেই আলুথালু সাগরিকে আঁকড়ে ধরে জিন্নাত। জিন্নাতের কা- দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে সাগরি। দুলে উঠে জিন্নাতের চারপাশ। ঝুপড়ি ঘরের ম্লান আলো। কড়া দিশির ঝাঁজালো মৌতাত দারুণভাবে পেয়ে বসে জিন্নাতকে। সাগরি তাকে কোথায় যেনো ডেকে নিয়ে যায়। সাগরির কথা মনে পড়ে আবছায়া। খিল খিল হাসে সাগরি। ঘরের কথা বলে সাগরি। ঘর-কিসের ঘর, কোথাকার ঘর?
অনেকদিন পর আজ মার কথা মনে পড়ে জিন্নাতের। দুঃখিনী মা-সংসারের টানাপড়েনের জন্য বাবার সাথে দিনরাত ঝগড়া করতো। বাবার রগচটা স্বভাব। মাঝে সাঝে দু’ঘা বসিয়েও দিতো মাকে। মনে পড়ে-স্কুলপড়ুয়া জিন্নাত দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখতো ভয়ে ভয়ে। কখনো দু’জনের অশ্লীল গালিগালাজ…।
সেসব দৃশ্য-দৃশ্যপট আজ কতো দূরে। সে ঘর-সে স্বস্তি কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে জিন্নাতের জীবন থেকে। বাবারও খোঁজ-খবর তেমন একটা নেয় না আজকাল জিন্নাত। সেজো খালা বাবার দেখাশোনা করে বাসায়।
মাঝেসাঝে বাসায় গেলেও হুটহাট ফিরে আসে। বাবা কিছু বলে না-সেজো খালাও না। সাগরির কথায় আজ আবার কেনো যেনো ঘরের কথা খুব মনে পড়ে জিন্নাতের। বাবার শুকনো মুখ-হারিয়ে ফেলা মায়ের করুণ আর্তি জিন্নাতকে আজ বড়ো বেশি ডাকে। কাছে পেতে চায়। কিন্তু কী করবে জিন্নাত।
নেতা আলফাজ মিয়াদের হাতের পুতুল হয়ে জিন্নাত আজ ঘর-সংসারের চৌহদ্দি হতে দূরে অনেক দূরে অপরাধের পেশাদার জীবন হতে সে কী করে ফিরবে ফেলে আসা চেনাজানা ফুরফুরে আনন্দের জীবনে। তাদের এক চিলতে সংসারে।
‘বাবু ঘরে যা মইনা আছছে। বসনলাল সিনেমার ব্ল্যাকের টিকিট বেইচা ফিরবার টাইম হছছে। আইলে গুলমাল হইবেক বাবু-যা বাবু ঘর যা লা বাবু…। বসনলাল মিজাজ ভি দেখাবে।’
টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় জিন্নাত। ভারী জিনসের প্যান্টের পকেটে পিস্তলটা হাতড়ে ভারি নিশ্চিন্ত হয় জিন্নাত। এক ধরনের বেপরোয়া ভাব পেয়ে বসে জিন্নাতকে। কাউকে আর পরোয়া করে না জিন্নাত হ্যাঁ-ঘর-ঘরেই যাবে জিন্নাত। তার মা-সাহানা-সাগরি সবাই তাকে ডাকছে সে ঘরেই ফিরবে-তার এখন শুধু একটা ঘর চাই।
ঘর। ঘরে তাকেই ফিরতেই হবে। রাস্তায় নামে জিন্নাত। কূটিল অন্ধকার চারদিকে হায়নার হাসি হাসে। আর জিন্নাত সেই ঘরের খোঁজে অনিশ্চিত পথে পা বাড়ায়।