গভীর রাত হঠাৎ করে মোবাইলের ম্যসেঞ্জারে রিংটোন বাজছে, ঘুম ভেঙে গেল। ভয়ে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।এতো রাতে ফোন,হয়ত কোন খারাপ খবর।আমার আত্মীয় স্বজনের অনেকে বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকে। তাদের কারো কোন খারাপ খবর নয় তো? চোখ মুছতে মুছতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাইয়া দেখি অপরিচিত এক মেয়ের চেহারা। ফোন কেটে দিয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। দেখলাম আমার স্ত্রীর ও ঘুম ভেংগে গেছে। আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,কে ফোন করেছে? নিচু স্বরে বললাম, চিনি না। ও বললো তুমি অবশ্যই চিনো, আমাকে দেখে ফোন ধরো নাই। এতো রাতে তর্কে না গিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়লাম। খেয়াল করে দেখলাম, স্ত্রী বিড় বিড় করে বলছে, কোথাও কোন আকাম করে এসেছো এখন ফোন ধরছো না।আরো বললো না চিনলে অবশ্যই তার ফোন ধরতা। চামড়ায় কামড় দিয়ে চুপ করে রইলাম। মনে মনে পন করলাম স্ত্রী যাই বলুক কোন উত্তর করবো না।
সকালে উঠে অফিসে গিয়ে ইন্টারনেট ওপেন করে দেখি মেয়েটি আরো দু’বার কল করেছে।ভাবলাম বিকালে ওকে কল করে জিজ্ঞেস করবো,সে কে?বিকালে দেখি ওর ইন্টারনেট বন্ধ।এর পরের চার রাতে আর কোন ফোন আসে নাই। পঞ্চম রাতে আবার সে গভীর রাতে ফোন করলো।ঘুম ভেঙে বিপদের শংকা নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাইয়া দেখি, সেই মেয়ে আবার মেসেঞ্জারে কল করেছে। দেখে কেটে দিলাম। ফিরে দেখি আমার স্ত্রী মশারীর ভিতর বসে রয়েছে। জিজ্ঞেস করলো,কে ফোন করেছে? বললাম চিনি না। বললো নিশ্চয় চিনো, না হলে কল করে কেন? আরো বললো,ঐ দিনও ফোন করলো আমাকে দেখে ধরো নাই। আজও কল করলো আমাকে দেখে ধরো নাই। নিশ্চয় আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছ? নিশ্চয় কারো সাথে পরকীয়া করেছো? কসম করে বললাম, তোমার ধারনা ঠিক না। বিশ্বাস করলো না। বিছানা থেকে উঠে ফোন নিয়ে টানাটানি শুরু করলো। চিন্তা করলাম এতো রাতে বাহির থেকে চেচামেচি শুনা গেলে বা পাশের রুম থেকে ছেলে শুনলে মান ইজ্জত আর থাকবে না। তাই ফোন ওর হাতে দিয়ে দিলাম। ফোনটা নিয়ে স্ক্রিনে মেয়ের ছবি এবং ওর প্রোফাইল দেখে বললো, ছিঃ একটা স্কুল পড়ুয়া মেয়ে তোমাকে ফোন করেছে, নিশ্চয় তুমি তার সাথে সম্পর্ক করেছো।এ কথা বলেই ফোনটাকে ফ্লোরে আছাড় মেরে দুই টুকরা করে দিলো। অতি শোকে পাথর হয়ে গেলাম কিন্ত কোন উত্তর করলাম না। মনে মনে ভাবছি এই ফোনটাতে আমার প্রায় ২০০০ ফোন নাম্বার সেভ করা ছিল সব শেষ। বিভিন্ন অনুস্ঠানের ছবি,লেখা বিভিন্ন আর্টিক্যাল সব শেষ। সারা রাত এপাশ ওপাশ করে কেটে দিলাম,কোন আওয়াজ করলাম না।সকালে উঠে প্রেসার মেপে দেখি,প্রেসার হাই। রেডি হয়ে অফিসে যাওয়ার পথে একটা মোবাইল কিনে অফিসে গেলাম। অফিসে গিয়ে ইন্টারনেটের সব কিছু ইনস্টল করে দেখি শ দুয়েক নাম্বার সেভ আছে যেগুলো সিমে সেভ ছিল। বাকীগুলো সব গেছে।ফেইসবুকে স্টের্টাস দিলাম কাল রাতে আমার মোবাইল নস্ট হয়ে যাওয়াতে বন্ধুদের সব ফোন নং ডিলিট হয়ে গেছে। তাই সবাইকে অনুরোধ করলাম সবার নাম্বার মেসেজে পাঠাতে।সারা দিন মাথা ধরে আছে।বার বার ফোনে খেয়াল রাখলাম মেয়েটা নেট ওপেন করে কিনা।দেখি না,করে না।সন্ধ্যায় তাকে একটা মেসেজ পাঠালাম।ফোন কেন করেছ,তুমি কি আমাকে চিনো?গভীর রাতে সে উত্তর দিলো আপনি তো ফোন ধরলেন না।ধরলে আমাকে দেখতে পেতেন।মাথায় হাজার চিন্তা শুরু হলো, কে সে? চিন্তার মাঝে আবার পুলকিত ও হচ্ছি,কারন বাচ্চা সুন্দরী একটা মেয়ে আমার মত মাঝ বয়সী বুড়া একটা মানুষকে পছন্দ করে ফোন করেছে।নিশ্চয় এখনো মেয়েদের কাছে আমার চাহিদা আছে।যদিও আমার স্ত্রীর কাছে আমি হচ্ছি দুনিয়ার সবচেয়ে কুৎসিত,আনস্মার্ট, আনকালচারাড একজন মানুষ।যাক এভাবে কয়েক দিন চলে গেল।ভেবেছিলাম কয়েকদিন পর বৌয়ের রাগ কমবে। দেখি না রাগ কমছে না,কথা বার্তা বলে না,ইশারায় এটা সেটা বুঝাতে চায়।এই একটি জায়গায় পৃথিবীর সব মহিলা মনে হয় একই রকম। সেটি হলো স্বামীর বিষয়ে ওরা খুব সন্দেহপ্রবণ ও কর্তৃত্বপরায়ন। পরের দিন থেকে আলাদা রুমে থাকা শুরু করলাম।ভাবলাম কয়েকদিন আলাদা রুমে থাকলে ওর রাগ কিছুটা হলেও কমবে।আরো একটা চিন্তা ছিল,যদি মেয়েটা আবার ফোন করে,তবে ধরে ওর সাথে কথা বলবো।প্রায় চার পাচ দিন পর একদিন রাত পৌনে একটায় মেয়েটি ভিডিও কল করলো।চোখ মুছতে মুছতে ফোনে চোখ রেখে দেখি, মেয়েটি ভিডিও কল করেছে। রুমের লাইট দিয়ে ফোন ধরলাম। দেখি মেয়েটি অন্ধকারে বসে আছে,কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমাকে কতক্ষণ দেখে ফোন কেটে দিলো,ওদিকে আমি হ্যালো হ্যালো করছি।কোন আওয়াজ করছে না।মাথা আগুনের মত গরম হয়ে গেল।অনুভব করলাম শরীরের প্রেসারও বেড়ে গেছে।মনে মনে ভাবছি মেয়েটাকে আক্রমন করে কিছু লিখবো।এমন সময় মেয়েটি ম্যসেঞ্জারে লিখলো” আমি যদি আপনাকে বাবা ডাকি মাইন্ড করবেন”। মাথা আরো গরম হয়ে গেল। এবার আমি মেসেঞ্জারে কল করলাম। কয়েকবার করার পর ধরলো, বললাম এতো রাতে ফোন করে ফাজলামো করছো।মেয়েটি বললো প্লিজ! বলেন না আপনার আপত্তি আছে কিনা? আমি বললাম কেন তোমার বাবা নাই। এবার মেয়েটি হঠাৎ করে কাঁদে বললো প্রায় দুই বছর আগে ওর বাবা মারা গেছে। শুনে ভেবাচেকা খেয়ে গেলাম। বললাম সত্যি বলছো। কেঁদে কেঁদে মেয়েটি বললো, আমার কথা শুনে বুঝছেন না আমি সত্যি বলছি না মিথ্যা বলছি। মনে মনে ভাবলাম আমাকে নিয়ে হয়ত মেয়েটি কোন ফাঁদ পাতছে। আরো ভাবলাম মেয়েটি বোধহয় আমাকে ট্রেপে ফেলতে চাচ্ছে। বললাম আমার কাছে তুমি কি চাও? বললো কিছু না। শুধু মাঝে মধ্যে ফোন করে আপনাকে একটু দেখবো। বললাম কেন? মেয়েটি বললো আপনার চেহারা দেখতে আমার বাবার মত তাই। বললাম তুমি কিসে পড়। বললো ক্লাস টেনে। জিজ্ঞেস করলাম ভাইবোন কয়জন? বললো দুইভাই এক বোন। জিজ্ঞেস করলাম ওরা কিসে পড়ে? বললো দুই ভাইয়ের একজন অনার্সে আর একজন ইন্টারে পড়ে। জিজ্ঞেস করলাম, সারাদিন তোমার নেট বন্ধ থাকে কেন? বললো আমার কোন মোবাইল নাই।এটা আমার বাবার ফোন ছিল।বাবার মৃত্যুর পর মা ব্যবহার করে।রাতে মা ঘুমাইলে আমি গোপনে ফেসবুকে ঢুকি।এভাবে একদিন ফেসবুকে ঢুকে আপনাকে দেখে বাবার মত লাগলো। তারপর ফেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম।একদিন দেখি আপনি রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছেন। তারপর থেকে প্রায় রাতে আপনার আইডিতে ঢুকে আপনার ছবি দেখি আর বাবার কথা মনে করে কাঁদি। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যে আমার ছবি দেখ বা আমাকে বাবা ডাকতে চাও এটা কেউ জানে? বললো না।এবার মেয়েটি এ নাগাড়ে বলতে লাগলো, জানেন আমার বাবা কিডনি রোগে মারা গেছেন।
এখন পরিবারের সবাই অর্থাৎ আমার মা ও ভাইয়েরা বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছে কিন্তু আমি রাতে ঘুমাতে পারি না শুধু বাবার কথা মনে পড়ে।আরো বললো,জানেন শেষের দিকে বাবার শরীরে অনেক কস্ট ছিলো। আমাকে ডেকে মাথায় হাত বুলাতে বলতো।আমি মাথায় হাত বুলাইয়া দিলে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হতো এবং এতে নাকি ওনার কস্ট কমতো।মেয়েটি আরো বললো,জীবনের শেষের দিকে বাবা কিছু খেতে পারতো না,আমি লোকমা তুলে দিলে একটু করে খেতো।মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমাকে কাছে ডেকে বললো “মারে আমি তোদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারছি না।চিকিৎসার খরচের জন্য সব শেষ করে দিয়ে গেলাম।তুই আমার একটা মাত্র মেয়ে,তোর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে যাচ্ছি।আল্লাহ যেন তোকে সারাজীবন সুখে শান্তিতে রাখে”।মেয়েটির কথা শুনে থ বনে গেলাম।কথা বলতে বলতে ফজরের আজানের সময় হয়ে গেল।ফোন রেখে ভাবতে লাগলাম বেচারা রোগের যন্ত্রণায় মারা গেছেন কিন্তু এমন একজন সন্তান রেখে গেছে যে বাবার জন্য রাতে ঘুমাতে পারে না।কি ভাগ্যবান বাবা!পরদিন অফিসে এসে সিদ্ধান্ত নিলাম বাসায় গিয়ে বউকে সব কথা বিস্তারিত বলবো।রাতে সব ঘটনা বলে বউকে পুরোপুরি বিশ্বাস করাতে পারলাম না।বললাম আজকে রাতে মেয়েটা নেট ওপেন করলে ফোন করে তোমাকে ধরাইয়া দিবো। রাত ১২.৩০ এর দিকে মেয়েটার নেট ওপেন দেখে ফোন করলাম।কয়েকবার করার পর ফোন ধরলো, বললাম তোমার আন্টি কথা বলবে।বউয়ের সাথে মেয়েটা কথা বলায় এবার বৌয়ের বিশ্বাস হলো। মেয়েটি এখনো রাতে মাঝে মধ্যে ফোন করে।কিছুক্ষণ আমাকে দেখে আবার রেখে দেয়।কিছু বলে না।ভাবী এই মেয়েটির সাথে আমার কি সম্পর্ক?চেনা নাই জানা নাই একটা মেয়ে গভীর রাতে আমার মাঝে তার বাবাকে খুঁজে বেড়ায়।এই সম্পর্কটি বড়ই বিচিত্র। তাই না?