রাতের নিস্তব্ধতা হঠাৎ ভেঙে গেল গুলির শব্দে। ট্যাংক নামে রাস্তায়। বাংলার কিছু কুলাঙ্গার রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে। বাংলাদেশকে তারা ক্ষত-বিক্ষত করে। মানচিত্র ছিন্ন-ভিন্ন করতে চেয়েছিল। ওরা কি মানুষ? পারল কীভাবে ওরা? ওদের বুক কি একটুও কাঁপল না? একটুও কি বিবেক দংশাল না? ওদেরকে নির্দয়, নিঠুর, পাষ- কত কিছুতেই তো আখ্যা দেয়া যায়। ওরা মানুষ নয়। তবে হায়েনা? হায়েনাদেরই অপমান হয় তাতে। ওরা নরকের কীট। না, তারচেয়েও অতি জঘন্য কিছু। হবেই না কেন, ওরা যে ওদের পিতাকেই হত্যা করেছে। ওরা সেই পিতাকেই আঠারটি বুলেট ছুঁড়ে হত্যা করেছে, যে পিতার কারণে ওরা পরাধীনতার বিষবাষ্প থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন দেশে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ওরা সেই পিতাকেই হত্যা করেছিল, যে পিতা নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে ওদের মুক্তির জন্য ফাঁসির মঞ্চেও যেতে দ্বিধা করেননি একটুখানির জন্যও। ওরা সেই পিতাকেই সপরিবারে হত্যা করেছিল, যে পিতা ওদেরকে প্রজাপতির রঙিন ডানায় আঁকা নবকিরণের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মন্ত্র শিখিয়েছিল! মীরজাফরের থেকেও ভয়ানক সেই বিশ্বাসঘাতকের দল এতটাই পিশাচতুল্য যে, শিশুর কান্নাও ওদের মনকে একটুও ভেজাতে পারেনি। ওরা জঘন্য বললে কম হবে।
আগস্ট ১৫, ১৯৭৫।
ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাসায় বাংলার ইতিহাস স্তব্ধ হয়ে যায়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকা-ের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধুর শোকের দিন। সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ঘাতকরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিঃশেষ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, সদ্য পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসেরকে সেখানে হত্যা করা হয়। বেইলি রোডে সরকারি বাসায় হত্যা করা হয় জনকের ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টুকে। আরেক বাসায় হত্যা করে তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে। বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলকেও হত্যা করে। এছাড়া বাড়িতে কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও হত্যা করা হয়। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
শিশু রাসেল কতো আকুতি করেছিল-‘আমি মায়ের কাছে যাবো’। কিন্তু সেই আকুতি রাইফলের গুলিতে স্তব্ধ হয়ে যায়। হায়েনারা শিশু রাসেলকে রেহাই দেয়নি। ওরা নরপশু। প্রচ- গোলাগুলির শব্দ শুনে বঙ্গবন্ধু নীচে নামতেই সিড়িঁতে তার বুক বিদীর্ণ হয় রাইফেলের বুলেটে। ‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে/ সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে/ বত্রিশ নম্বর থেকে/ সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/ অমল রক্তের ধারা ব’য়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে/ মাঠময় শস্য তিনি ভালোবাসতেন/ আয়ত দু’চোখ ছিল পাখির পিয়াসী/ পাখি তার খুব প্রিয় ছিলো/ গাছ-গাছালির দিকে প্রিয় তামাকের গন্ধ ভুলে/ চোখ তুলে একটুখানি তাকিয়ে নিতেন/ পাখিদের শব্দে তার, খুব ভোরে, ঘুম ভেঙে যেতো/ স্বপ্ন তার বুক ভ’রে ছিল/ পিতার হৃদয় ছিল, স্নেহে-আর্দ্র চোখ/ এদেশের যা কিছু তা হোক না নগণ্য, ক্ষুদ্র/ তার চোখে মূল্যবান ছিল/ নিজের জীবনই শুধু তার কাছে খুব তুচ্ছ ছিল/ স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে প’ড়ে আছে/ বিশাল শরীর/ তার রক্তে এই মাটি উর্বর হয়েছে/ সবচেয়ে রূপবান দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ/ তার ছায়া দীর্ঘ হতে-হ’তে/ মানচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে,আদরে/ তার রক্তে প্রিয় মাটি উর্বর হয়েছে/ তার রক্তে সবকিছু সবুজ হয়েছে।’
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। ঐ বছর স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। তিনি স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবির উপর ভিত্তি করে একটি দল নিয়ে তাদের কাছে যান। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। ১৯৪২ সনে এন্ট্রান্স পাস করার পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ) আইন পড়ার জন্য ভর্তি হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল। এই কলেজ থেকে সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং অগ্রণী কাশ্মিরী বংশোদ্ভুত বাঙালি মুসলিম নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৪৩ সনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
১৯৪৪ সনে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে শেখ মুজিব বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি কলকাতায় বসবাসকারী ফরিদপুরবাসীদের নিয়ে তৈরি ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী মনোনীত হন। এর দুই বছর পর ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের মহাসচিব নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সনে অর্থাৎ দেশবিভাগের বছর মুজিব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার সময়ে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। এসময় মুজিব মুসলিমদের রক্ষা এবং দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় শরিক হন। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের জানুয়াারি ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যার মাধ্যমে তিনি এ প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন। এ সময় সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জীবনযাত্রার নিম্নমানের উন্নয়নের জন্য এটিকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে মনে করতে থাকেন। ‘বাংলাদেশে জন্ম তোমার, বাংলাদেশ/ তোমার ঘর/ বাংলা তোমার তুমি বাংলার, তুমি/ বাংলার মুজিবর/ তোমার মতো আর কে আছে আপন/ দেশের প্রাণ/ বাঙালির তুমি হৃদয়ে হৃদয়ে/ শেখ মুজিবুর রহমান/ বিশ্বজোড়া তোমার নাম, তোমার/ কীর্তি বিশ্বময়/ পদ্মা- মেঘনা-যমুনা সতত গাইছে জয়/ দেশের মাটিতে মিশে আছ তুমি, দেশের/ মাটিতে হৃদয় পাতা/ তোমার কীর্তি তোমার নাম কোটি কোটি/ হৃদয়ে গাঁথা/ সারা বিশ্ব একনামে চেনে তুমিই/ বাংলার মুজিবর/ তুমি বন্ধু, তুমিই পিতা, তুমি বিশ্বে চির অমর’।
কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বেশ কয়েকবার বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন-নিরাপত্তা বাড়াতে। তিনি বিশ্বাস করতেন-আমি এই বাংলার সন্তান, কোনো বাঙালি তাঁর বুকে রাইফেলের গুলিতে ঝাঁজরা করে দিবে সেটা কখনো কল্পনা করেননি। অথচ সেটা হলো। ইতিহাসের কালো অধ্যায় রচিত হলো। পেছনের দিকে হাঁটতে লাগল বঙ্গবন্ধুর বাংলা। দীর্ঘ একুশ বছর পর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াতে থাকে। ষড়যন্ত্রকারীরা মাঝখানে বাধাগ্রস্ত করে। এরপর বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বীরদর্পে। অনেকের কাছে যা আজ ঈর্ষণীয়। শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের বিস্ময়।