রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের কাছে ভালোলাগার ভালোবাসার কবি,রোমান্টিক ছোট গল্পের লেখক, মুগ্ধ প্রেমের গানের ঢালি ,কখনওবা তিনি স্বদেশপ্রেমিক কখনওবা স্বাধীন নারী চরিত্রের সফল নির্মাতা। মোটামুটিভাবে তিনি শিল্পসংস্কৃতির বটবৃক্ষ। বাঙালি সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। তাঁর সাহিত্যের মূল বিষয় মানুষ। মানুষের সাথে মানুষের, সমাজের এবং প্রকৃতির সম্পর্ক ফুটিয়ে তুলেছেন গভীর মমতায় এবং ভালোবাসায়।
জীবনের শুরুর দিকে গ্রামের সাথে তাঁর পরিচয় ছিল খুবই কম। কলকাতায় জমিদারি কাছারিতে বসে পিতার সাথে সাধারণ মানুষের বিবিধ সমস্যার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। পিতার নির্দেশে ১৮৮৩ সাল থেকে প্রায়ই পূর্ববঙ্গে আসতেন জমিদারি কাজ তদারকি করার জন্য। তখন থেকেই গ্রামের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটে। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে অর্থাৎ ১৮৯১ সালে জমিদারি দেখার জন্য তিনি সপরিবারে শিলাইদহে কুঠিবাড়িতে অবস্থানকালীন সময়ে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন প্রচেষ্টার মাধ্যমেই তিনি পল্লীউন্নয়ন কর্মসূচী শুরু করেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন এদেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক গ্রামে বাস করেন। তাই তিনি গ্রামকে সার্বিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।
শিলাইদহে থাকাকালীন পল্লীপ্রকৃতি তাঁকে মুগ্ধ করেছিল ভীষণভাবে। পল্লীর সকাল সন্ধ্যার রূপ, বর্ষার মুষলধারে বৃষ্টি, নদীর শান্ত উন্মত্ত রূপ এবং নদীর দুধারে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্গতি তিনি দেখেছেন। গ্রাম এবং শহরের মানুষের জীবনযাত্রার বৈষম্য তাঁর অন্তর্দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি।
তিনি সর্বপ্রথম কৃষি ও পল্লীর জনজীবনের কথা ভেবেছেন। যেহেতু পল্লীর অধিকাংশ লোক কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে সেহেতু কৃষির উন্নয়ন মানে পল্লীউন্নয়ন। তিনি খুব কাছে থেকে অবলোকন করেছেন যারা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের ক্ষুধার অন্ন যোগায় তারাই থাকেন অনাহারে অর্ধাহারে। তারা মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নেয় চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ প্রদানের অঙ্গীকারে। যার কারণে সারাজীবন কৃষকেরা মহাজনদের ঋণের ফাঁদে আটকে থাকেন। তাই তিনি কৃষি উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তন ও পুনর্গঠনের কথা চিন্তা করেন। “রাশিয়ার চিঠি”তে তিনি লিখেছেন,“জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, চাষির”।
পতিসর ও সাজাদপুরে জমিদারি দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্তির পর কৃষকদের ভালোমন্দের ভাবনায়, গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিন্তায় ,প্রান্তিক মানুষকে সুসংগঠিত করার চিন্তায় কবিমনকে বিষন্ন করে তোলে। তিনি বলেছেন, কেবলমাত্র খেয়ে-পরে টিকে থাকতে পারে এতটুকুমাত্র ব্যবস্থা কোনো মানুষের পক্ষেই শ্রেয় নয়, তাতে তার অপমান। তাই তাদের জন্য কিছু একটা করার জন্য তাঁর মন সবসময় ছটফট করত। তিনি জানতেন গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দরকার কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। দরকার বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ। এজন্য গ্রামীণ সমাজের উন্নয়নে তিনি নানামাত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যান্ত্রিক চাষপদ্ধতির মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদন ও আয় বাড়ানো সম্ভব। খন্ডিত জমি একত্রে চাষাবাদের জন্য তিনি সমবায়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। নিজের সন্তান ও জামাতাকে কৃষিবিষয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে এনেছিলেন গ্রামের দুঃখী মানুষগুলোর ভাগ্য বদলানোর জন্য। আমেরিকা থেকে কৃষি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি শেষে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ পতিসরে আসেন। তিনি ক্ষেতে ট্রাক্টর চালান। উন্নত প্রজাতির শস্যবীজ, কেমিক্যাল সার ইত্যাদি ব্যবহার করে চাষাবাদ শুরু করলেন। সেই দৃশ্য দেখে স্থানীয় চাষিরা বিস্ময়ে হতবাক হন। তিনি বিশ্বাস করতেন শুধুমাত্র উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলেই গ্রামীণ মানুষের ভাগ্য বদলানো যাবে না। তাই তিনি যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তনের পাশাপাশি কৃষির বহুমুখীকরণের জন্য নানাবিধ অকৃষিজ পণ্যের উৎপাদনে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যেমন তাঁত শিল্প, বয়নশিল্প, রেশনশিল্প ইত্যাদি। এভাবে তিনি কৃষকদের বিকল্প আয়ের সুযোগ তৈরি করেন।
তিনি পল্লী পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন পতিসরে। সেখানে হিতৈষী সভার মাধ্যমে ১২৫ টি গ্রামের ৬০-৭০ হাজার মানুষকে একত্রিত করেন। এই সভা গ্রামের স্কুল ,হাসপাতাল পরিচালনা ছাড়াও রাস্তাঘাট মেরামত, জঙ্গল পরিষ্কার ও ছোটখাটো বিচার আচারের দায়িত্ব নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বিশাল অংকের অনুদানের মাধ্যমে এই সভা চলত। কালিগ্রামের আশিভাগ লোক ছিল কৃষক। বিজ্ঞানসম্মতভাবে চাষাবাদ করতে গেলে বেশি মূলধনের প্রয়োজন। কিন্তু দরিদ্র কৃষকদের কাছে অর্থতো দুরের কথা ,তারা সুদখোর মহাজনদের কবলে পড়ে সহায় সম্বলহীন। মানবদরদী রবীন্দ্রনাথ প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা বুঝতে পারতেন। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের মহাজনী ঋণের শেকল থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এই উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম ছিল, ১। কৃষকদের মধ্যে সমবায়ভিত্তিক সমিতি গঠন করা ২। শস্য গোলা স্থাপন ৩। কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা।
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন একটি কৃষিব্যাংক স্থাপনের। ১৮৯৪ সালে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। এটিই ছিল উপমহাদেশে প্রথম গ্রামীণ কৃষি ব্যাংক। পরবর্তীতে শুধুমাত্র কৃষিকাজে ঋণ দেয়ার জন্য ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন “পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক”। এই ব্যাংক স্বল্প সুদে গ্রামের গরীব চাষিদের মধ্যে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে মহাজনদের কাছ থেকে চাষিদের মুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ এসকল ব্যাংকের মূলধন সংগ্রহ করেন তাঁর ধনী বন্ধুদের থেকে ধার করে। ১৯১৩ সালে তাঁর নোবেল প্রাইজের ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা এই ব্যাংকে বিনিয়োগ করেন। এতে করে ব্যাংকের মূলধন বৃদ্ধি পায়, কৃষকদের বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাদের জন্য ঋণ প্রদান সুনিশ্চিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের অবদান অসামান্য এবং অনুসরণীয়। কৃষি উন্নয়ন তথা কৃষির আধুনিকায়নে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা চিরস্মরণীয়। বর্তমান অর্থনীতিবিদরা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যে কৃষিব্যবস্থার প্রবর্তন করে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ সে ভাবনা করেছেন অনেক আগেই। তিনিই সর্বপ্রথম যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের প্রবর্তন করেন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয়ের স্মৃতি, উপমহাদেশে প্রথম কৃষি ব্যাংক স্থাপন, পতিসরে কৃষি সমবায় ব্যাংক স্থাপন, এবং নোবেল পুরস্কারের অর্থ ওই ব্যাংকে বিনিয়োগ এই সমস্ত নথিপত্র নিয়ে এখনও কোন গবেষণা ও পর্যালোচনা হয়নি বলে জানান রবীন্দ্রনাথের কৃষিভাবনা বিষয়ক গবেষকরা। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুমাত্র সাহিত্য সৃষ্টি করেন নাই, তিনি একজন অর্থনীতিবিদ এবং আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক ( অর্থনীতি), বোয়ালখালী হাজী মো: নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।