Site icon Shaili Tv

রমজান আলী মামুন : তোমারে পারিনি ভুলিতে

রমজান আলী মামুনকে নিয়ে আসন্ন জন্মদিনে একটি স্মারকগ্রন্থ বের হচ্ছে জেনে মন খারাপ হলো খুব। তিন যুগ ধরে যাকে খুব চিনি তাকে নিয়ে আমি কিছু লিখব না? অন্তর্যামী তখনই জানিয়ে দিলেন কবিকে। সে রাতেই ফোন পাই তার। বলেন তাড়াতাড়ি আমাকে নিয়ে একটি গদ্য দাও। সময় খুব কম। সেলিমাকেও বলো। বউ পাশেই ছিল। ফোন রেখেই দুজনেই লিখতে বসে যাই। গভীর রাতে দুই দুটি ছড়া তাকে পাঠাই। পরদিন ফোনেই কনফার্ম করি। তবু বলেন পারলে একটা গদ্য দিও। সেই বই আজও প্রকাশের পথে। মামুন ভাই চলে গেলেন।

আশির দশকের শেষ দিকে লেখালেখিতে এসে সর্বপ্রথম যে কজন মহৎপ্রাণ শিশু সাহিত্যিকের দেখা পেয়েছিলাম রমজান আলী মামুন তাদের অন্যতম। দিনে দিনে ঘনিষ্ঠতা কেবলই বেড়েছে। এইচ এস সি পড়াকালীন একদিন তার ছড়া নিতে বদরপাতির বাড়িতে গিয়েছিলাম। শিল্পী আবদুল মান্নান রানার ভাইপো জ্যোতি ছড়াগানের ক্যাসেটে আমার তিনটি এবং মামুন ভাইয়ের দুইটি ছড়া স্থান পেয়েছিলো। ক্যাসেটটা দেখে বন্ধুরা বলেছিলো, ‘গোফরান সঙ্গীত’। জীবনে সেই প্রথম গীতিকার হওয়া। মামুন ভাইয়ের ‘ইলিশ মাছের তিরিশ কাটা’ ছড়া গানটি আজও কানে বাজে।
বন্ধু ডাক্তার সরওয়ার কামাল পাশার বগুড়া মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রাবস্থায় টিউশনির টাকায় জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জীবন নক্ষত্র ছুয়ে ছুয়ে দেখেছি’ আমাকে উৎসর্গ করলে একুশের বইমেলায় সেই বিশাল সুসংবাদ মামুন ভাইই আমাকে প্রথম দেন। সেদিন সবাই মিলে আমার থেকে ট্রিটও আদায় করেছিলেন মামুন ভাইয়ের নেতৃত্বে।
দুই বছর আগে মামুন ভাইয়ের ‘আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ’ বইটি প্রকাশিত হলে বইমেলায় রাদিয়া প্রকাশনে এসে আমাকে একা দেখে তিনি তখনই সেলিমাকে আনতে পাঠান। সেলিমা মেলায় এলে বইটি অটোগ্রাফ সহ তার হাতে তুলে দেন। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট্য বারো জন নারীকে উৎসর্গীকৃত বইটিতে সেলিমাও তাদের একজন। নিজের নাম দেখে খুবই অভিভূত হয় সে।
তার জীবনের শেষ তিনটি দিন ছিল অত্যন্ত বর্ণাঢ্য। প্রথমদিন উদ্বোধনীতে গুণী ছড়াশিল্পীদের সাথে আমরাও দাড়িয়ে যাই। প্রথমে স্ত্রী কন্যার কাছে থাকলেও পরে মামুন ভাইয়ের পাশেই চলে যাই ও তার সঙ্গে জীবনের শেষ ছবিটি তুলি। শেষ দিন তার বক্তব্যও মনপ্রাণ ছুয়ে যায় আমাদের।
ত্রিশ আগস্ট ওয়ার্ল্ড লিটারেচার ফোরামের বঙ্গবন্ধু স্মরণে ছড়াপাঠ শেষে কবি মানজুর মুহাম্মদ ভাইয়ের বাসায়, ছাদে, লাইব্রেরিতে মামুন ভাইয়ের জীবন্ত স্মৃতি ভুলতে পারছি না। আমরা সেদিন একই গাড়িতে মামুন ভাইয়ের পাশে বসে ঘরে ফিরেছিলাম।
গত বছর ছেলে আলীরাজকে ভর্তি করাতে তিনি আমার কলেজে এসেছিলেন সেদিন আমার বেশ কিছু বই মামুন ভাই কিনে নিয়ে ছিলেন। মৃত্যুর পর জেনেছি তিনিও ওমরগণি এম ই এস কলেজের ছাত্র ছিলেন।
সব সময়ই আমি তার পাশে ছিলাম বা তিনিই আমার পাশে। লেখালেখিতে কোন আপোস করতেন না। কথনের নির্বাহী সম্পাদকের পদ আমি ছেড়ে আসার পর থেকে আমৃত্যু তিনিই দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কথন সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের প্রতিটি অনুষ্ঠানেই তিনি আমাকে ফোন করতেন। সম্প্রতি ফারুক হাসান ভাইয়ের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণের সৌভাগ্য হয় মামুন ভাইয়েরই প্রচেষ্টায়।
চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত শিশু সাহিত্যের প্রতিটি অনুষ্ঠানে আমাদের যাওয়া উচিত। কাকে কখন হারিয়ে ফেলি। মৃত্যুর পরদিনই চট্টগ্রাম একাডেমির স্মরণ সভায় আমরা সবাই যে ভাবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদেছি তাতে আমিও আমার আপন ভাই হারানোরও অধিক বেদনানুভব করেছি। একজন শিশু সাহিত্যিকের জন্য এত মানুষের কান্না অভাবনীয়। সত্যিকার নিবদিত প্রাণ শিশু সাহিত্যিক রমজান আলী মামুন কখনও ভোলার নয়। তার মিলাদে তার কবরস্থানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বিশাল উপস্থিতিই বলে দেয় তিনি কত আপন ছিলেন আমাদের। প্রতিটি মামুষের সাথেই তার ছিল আন্তরিক হৃদ্যতা। যাই করেছেন মন প্রাণ ঢেলেই করেছেন। অনুষ্ঠানে স্মৃতি থেকে মুখস্ত ছড়া পাঠ এবং গান আজও মনে পরে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘যদিও তার দল করি না’ ছড়াটি অত্যন্ত কালজয়ি শিল্পকর্ম। জাতির জনককে অস্বীকার করে এমন বুকের পাঠা কার? মামুন ভাই তা সকৃতজ্ঞতায় জানিয়ে গেছেন বার বার। তাকেও শ্রদ্ধা।
রমজান আলী মামুনের অপ্রকাশিত সাহিত্যকর্ম প্রকাশের দাবি জানাই একই সাথে তার তিন সন্তানের লেখাপড়া যেন হয় সেই ব্যবস্থাও জরুরি। অমর একুশে বই মেলায় তার বই গুলোর জন্য একটা আলাদা স্টল বরাদ্দেরও অনুরোধ রইল।

Exit mobile version