Site icon Shaili Tv

রোকনুজ্জামান খান : ছায়া ফেরি করে ফিরেছিলেন যিনি / রাশেদ রউফ

রোকনুজ্জামান খান (১৯২৫-১৯৯৯)। দাদাভাই হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত ও খ্যাত। শিশুসাহিত্যের এক কিংবদন্তি, সফল শিশুসংগঠক ও অন্যন্যসাধারণ সম্পাদক। তিনি শুধু একজন লেখক ছিলেন না, ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানও। তাঁর জাদুহাতের স্পর্শে ও নিবিড় পৃষ্ঠপোষকতায় আজ আমদের অনেকের হাতেই কলম। যখন “বাক বা কুম পায়রা/ মাথায় দিয়ে টায়রা/ বউ সাজবে পাল্কি? চড়বে সোনার পাল্কি”- ছড়াটা আবৃত্তি করি, তখন দাদাভাই- এর হাস্যময় চেহারাটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে। কিংবদন্তিতুল্য এই ব্যক্তিত্বের যখন জীবনাবসান হয়, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যিকগণ। তাঁরা হারিয়েছেন তাঁদের অত্যন্ত দরদি বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষককে। ‘মাথার ওপর ছাতা’র মতো যেই মানুষটি ছায়া ফেরি করে ফিরেছিলেন।

২.
‘আজব হলেও গুজব নয়’, ‘হাট্ টিমা টিম্’ ও ‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি’- তিনটি গ্রন্থ রোকনুজ্জামান খানের। ‘আজব হলেও গুজব নয়’ নানারকম পশুপাখির বিচিত্র কথার অপূর্ব গ্রন্থ। এটি তাঁর মৌলিক রচনা নয়, অনুবাদ। মূল লেখক ফান্সেন এন. ক্রিস্টি। ‘হাট্ টিমা টিম’ ও ‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি’র দু‘টি ছড়াগ্রন্থ। প্রথমটি বের হয় ১৯৬৩ সালে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৯৬ সালে। এই দুটি গ্রন্থ ছাড়াও তাঁর রয়েছে অসংখ্য অগ্রন্থিত ছড়া।
তাঁর ছড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য শিশুদের আনন্দ দান। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁকে রাশভারী মনে হলেও তাঁর ছড়া- কবিতাগুলোতে তাঁকে মনে হয়েছে উল্টো। একটা গল্পবাজ মন সব সময়ে তাঁর ভেতরে কাজ করতো। ছড়ার মধ্যে গল্প বলার কৌশল রপ্ত করেছিলেন তিনি। ফলে ছন্দে ছন্দে তিনি ছোটদের আজগুবি ও কৌতুকমিশ্রিত গল্প শোনাতেন। মৃদু হাসি ও কৌতুকমিশ্রিত ছড়াই তিনি বেশি উপহার দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, কষ্ট, দুঃখ থেকে ছোটদের দূরে রাখা উচিত। তাদের ভুবন আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের। তারা সব সময় হাসি খুশিতে দিন কাটাবে। তাঁর ছড়ায় কৌতুকের সাথে থাকে সামান্য ব্যঙ্গ। রোকনুজ্জামান খানের অসাধারণ এক ছড়া ‘ক্যামেল সাহেব’। এ ছড়ায় আরব দেশের এক উট গেছে বিলেতে। সেখানে সে ‘সাহেব’ সেজে চলতে থাকে। পথের মানুষ তাকে দেখে এদিক ওদিক ছুটে পালায়। এই সুযোগে উট সাহেব নিজেকে সাহেব হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে চান। মানুষ জনকে পালাতে দেখলেই-
অমনি সাহেব আসেন তেড়ে
ইংরেজি কন চার-পা নেড়ে।
বলেন: ছিলাম উটের দেশে,
‘ক্যামেল’ হলাম বিলাত এসে।
সেই থেকে কেউ দেখলে তাকে
‘ক্যামেল সাহেব’ বলেই ডাকে।
এই লেখার মাধ্যমে দাদভাই কিছু মানুষের চরিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। আমাদের দেশে এরকম বহু মানুষ আছে, যারা নিজেদের যা নয়, তা সাজাবার চেষ্টা করে।
একটা ব্যাপার খুব লক্ষণীয়। ‘হাট্ টিমা টিম’ গ্রন্থে তিনি যে ক‘টি ছড়া অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তার সবক’টিই যুক্তাক্ষর বর্জিত। যুক্তাক্ষর – শব্দ বর্জন ক’রে ছড়া বানানো তো কম কষ্টের কথা নয়। কিন্তু ছোটদের দিকে তাকিয়ে রোকনুজ্জামান খান সেই কষ্টটি করেছেন। কঠিন, কঠোর ও দুর্গমের দিকে ছোটোদের তিনি ঠেলে দিতে চান না ব’লেই যুক্তাক্ষরের মুখোমুখি করতে চান নি।
‘হাসি’ রোকনুজ্জামান খানের অন্য এক অসাধারণ ছড়া। পাঠ্যবইতে অন্তর্ভুক্ত ব’লে বাক বা কুম পায়রা’-র মতো এটিও খুবই জনপ্রিয়।
হাসতে নাকি জানে না কেউ
কে বলেছে ভাই?
এই শোন না,কত হাসির
খবর দিয়ে যাই।
রোকনুজ্জামান খান দেখিয়েছেন যে, এখানে সবাই হাসে। চাঁদ, শাপলা, ঘাস, মাছ, পাতিহাঁস, টিয়ে, ফিঙে,দোয়েল-কোয়েল-ময়না-শ্যামা, বানর, জিরাফ, গাধা ইত্যাদি। তারপরে তিনি বলেছেন-
এত হাসি দেখেও যারা
গোমড়া মুখে চায়
তাদের দেখে পেঁচার মুখেও
কেবল হাসি পায়।
আসলে, দাদাভাই যে সবার মুখে হাসি ফোটাতে চাইতেন, তারই বর্ণনা দিয়েছেন এ লেখায়। গোমড়ামুখো মানুষের পরিবর্তে হাসিমুখ তিনি পছন্দ করতেন।
‘চিঠি বলি’এক মজার ছড়া। এই ছড়ার মধ্যে একটা গল্প বলতে চেয়েছেন লেখক। গল্পের নায়ক একটি ব্যাঙ। সে একদিন চিঠি বিলি করতে করতে বেরিয়েছে, মাথায় আছে ছাতা। ছাতা দেখে নানা জনের নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। তাই আগে থেকেই জবাব তৈরি করে রাখে ব্যাঙ। ভেটকি মাছের নাতনি বিদেশে গেছে। সে চিঠি লিখে জানাচ্ছে, দেশে খুব বৃষ্টি হবে এবার।
“তাই তো নিলাম ছাতা কিনে
আসুক এবার বরষা,
চিংড়ি মাছের খেয়া না’ আর
ছাতাই আমার ভরসা।”
রোকনুজ্জামান খান মাটিঘেঁষা লৌকিক শ্রেণির ছড়া রচনায় স্বচ্ছন্দ। ছড়ার শিল্প সৌষ্ঠবে তিনি যেমন অনন্য, তাঁর ছড়াও তেমনি ছন্দ-নৈপুণ্যে আকর্ষণীয়।

নীল আকাশে কাক চিলেরা পাখনা মেলেছে
দিঘির কালো জলে খোকন ছাকনা ফেলেছে
রুই কাতলা তুলবে ছেঁকে কুটবে বলো কে?
খোকার বাড়ি বিয়ের দাওয়াত সবাই চলো হে।

ময়না শালিক টিয়ে
ফিঙে রাজার বিয়ে
নোলক নেড়ে ঢোলক বাজাও
ঝুমকো কানে দিয়ে।
একটি ঢোলক ফুটো
সবজি আনাজ কুটো
কুটুম পাখি কাটুস কুটুস
বিয়ের মউজ লুটো।

‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি’ গ্রন্থের ছড়া- কবিতাগুলোতেও আছে কৌতুক, ব্যঙ্গ, হাসি-ঠাট্টা। ‘গাধার কান’, ‘দা’, ‘লং বাহাদুর জং’, ‘প্যাঁচার হাসি’,‘গুজব’, ‘সেগুন বনাম বেগুন, ইত্যাদি কবিতা হচ্ছে আজগুবি ঘটনা বা হাস্যরসাত্মক আনন্দমিশ্রিত ছড়া। রোকনুজ্জামান খান সে এই কবিতাগুলোর বিষয় হিসাবে কখনো নিয়েছেন প্রচলিত গল্পকে, কখনো নিজেই কৌতুক তৈরি করেছেন। ‘গুজব’টা তাঁর বানানো গল্প। হঠাৎ এক আজগুবি জাহাজ এসে জুড়ে বসেছে মাঠ-ঘাট। সে হুংকার দেয়, তার হুংকারে বাঘ পালায়, পদ্ম নদীর চরে ঝড় ওঠে। জাহাজটা সবই খেতে শুরু করে। এমনকি ঘরবাড়ি পর্যন্ত গিলে খায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সেই জাহাজের খবর শুনে তালপাতার এক সেপাই ঢাল- তলোয়ার নিয়ে ছুটলো পদ্মাপাড়ে।
গিয়েই দ্যাখে সেপাইজি বিস্ময়ে,
পানকৌড়ি সাঁতরে ভয়ে ভয়ে
মাছ ধরে খায় ছোট্ট খালের বুকে,
সে খবরই লোখের মুখে মুখে
গুজব হয়ে ছুটলো দেশান্তরে,
মাঠ-ঘাট সব পেরিয়ে ঘরে ঘরে।
এই ‘গুজব’ ছড়াটির মতো আরেকটি চমৎকার হাসির কবিতা হচ্ছে ‘ভূগোলের গোল’। এই ছড়াই একটি শব্দ এক জায়গায় ভালো, অন্য জায়গায় মন্দের অর্থে পরিচয়
কালো আঁখি, কালো ভুরু, কোয়েলাও কালো,
ফাগুন মাসে তার গান লাগে ভালো।
কালোবাজারের নামে কাঁটা দেয় গায় –
হায় রে এ দুনিয়ার খেলা বোঝা দায়।
এখানে সব যে দেখি এলোমেলো ধাঁধা,
তাই তো ভূগোল নাম হল বুঝি দাদা!

‘গাধার কান’ রোকনুজ্জামান খানের জনপ্রিয় একটি কবিতা। গাধারা যে বাস্তবিক অর্থে গাধা, তা সুন্দর ছন্দে, চমৎকার গল্পে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। কবিতাটি পাঠ করা যাক :

একটা দড়ির দুদিক থেকে টানছে দুদল ছেলে
তাই না দেখে বনের বানর লাফায় খেলা ফেলে
সকল বানর ফন্দি আঁটে জবর মজার খেলা
এমন খেলা খেলেই সবাই কাটিয়ে দেব বেলা।

কিন্তু দড়ি মিলবে কোথায়? ঘাবড়ে গেল মাথা
পালের সেরা বানর বলে মগজ তোমার যা তা।
নেইকো দড়ি বয়েই গেলো ভাবিস মিছে হাবা
লেজে লেজে ধরব টেনে হবে দড়ির বাবা।
যেই না বলা দু’দল বানর দুদিক থেকে বসে
একের লেজটি ধরল টেনে জোরসে চেপে কষে।

বনের গাধা দাঁড়ায় মাঝে উঁচিয়ে দুটি কান
বলে, আমার দু’দিক থেকে কান ধরে দে টান
কান ধরে এই মাথা নিবি আপন দলে টেনে
জিতবি তবে এই খেলাতে, রাখিস সবাই জেনে।

অমনি দুদল হেঁইয়ো টানে গাধার বিপদ ভারি
কান ছিঁড়ে সব হুমড়ি খেয়ে পড়ল সারি সারি।
সাঙ্গ হল দড়ির খেলা বানররা সব হাসে
কান হারিয়ে গাধার শুধুই চোখের জলে ভাসে।

রোকনুজ্জামান খানের চোখে ছিল নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন। শিশুদের ধীরে ধীরে গড়ে তুলে সমাজ প্রতিষ্ঠায় নেমেছিলেন তিনি। এ স্বপ্নও তাঁর ছড়ায় এসেছে এভাবে –
‘অনাচারের গোড়ায় আগুন জে¦লে
নতুন সমাজ গড়তে হেসে-খেলে
ঝাঁপিয়ে প’ড়ে করবে লড়াই কারা?
কারা কারা কারা?
ডানপিটে সব তরুণ-কিশোর যারা।

Exit mobile version