সিদ্দিক আহমেদ ছিলেন এক বহুমাত্রিক মানুষ। সৎ সাংবাদিক হিসেবে, পরিশ্রমী প্রাবন্ধিক হিসেবে, বিশ্বস্ত অনুবাদক হিসেবে এবং নীতিবান শিক্ষক হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল সর্বব্যাপী। তাঁর কথা বলতে গেলেই আমার মনে পড়ে যায় কবি ও সমালোচক মেথু আর্নোল্ড-এর সেই বিখ্যাত পংক্তি :
Sweetness within, Sweetness Without
Perfection Within, and Perfection Without.
সিদ্দিক আহমেদ ছিলেন তেমন মানুষ, যিনি ভেতরে-বাইরে এক। তিনি ভিতরেও মধুর, বাইরেও মধুর; ভিতরেও নিখুঁত, বাইরেও নিখুঁত।
আসলে পরশ্রীকাতর, ধাপ্পাবাজ ও পশুচারিত্রিক মানুষের এই পৃথিবীতে সিদ্দিক আহমেদের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তিনি যেমন জ্ঞানী ছিলেন, তেমনি ছিলেন সহজ, সরল ও উদার। উচ্চকণ্ঠী ছিলেন না কখনো, তবে আপসকামী মনোভাবকে প্রশ্রয় দেন নি জীবনের কোনো পর্যায়ে। আত্মপ্রচার কখনো তাঁকে ঘায়েল করতে পারে নি। সব বয়সের মানুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো তাঁর। তরুণ থেকে আশি ঊর্ধ্ব ব্যক্তিদের কাছে সিদ্দিক আহমেদ ছিলেন বড় ভরসা ও বিশ্বাসের স্থল।
২.
সিদ্দিক আহমেদ তাঁর জীবদ্দশায় পরিণত হয়েছিলেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে। পরিবারের বাইরে আত্মীয় স্বজনের সীমানা ছাড়িয়ে নিজের সমাজের গ-ি পেরিয়ে তিনি জননন্দিত হয়েছেন তাঁর কর্মে ও সৃজনশক্তির গুণে। যতোটা তিনি জানতেন, ধারণ করতেন, ততোটা জাহির করতেন না। অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, মনে হয়, সেটাই ছিলো তাঁর অসাধারণত্ব। মানুষকে বড় করে দেখা ছিলো তাঁর এক বিশেষগুণ। তিনি আড্ডায় বসতেন, অফিসে কাজ করতেন- সব জায়গায় কিন্তু তাঁর অনুরাগীরা তাঁকে ঘিরে থাকতেন। তাঁর কাছে যাঁরাই আসতেন, সবাই যেন বড়, সবাই যেন অনেক কিছু জানেন। তিনি হাসিখুশি থাকতেন। মিষ্টভাষী। বিনয়ী ছিলেন। চিন্তাচেনতায় তিনি ছিলেন প্রগতিশীল। তবে ভিন্ন মতের প্রতিও ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা ছিল অসামান্য। যা বিশ্বাস করতেন, তা’ই বলতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর এ দৃঢ়তা অটুট ছিল।
৩.
সিদ্দিক আহমেদের দর্শন ছিলো মানুষকেন্দ্রিক। জীবনের অনেক মৌল সত্যকে তিনি তাঁর মতো অনুধাবন করেছেন। তিনি তাঁর লেখনির মাধ্যমে এবং আড্ডায় আলাপচারিতায় তাঁর ব্যক্তিক অনুভূতিমালা প্রকাশ করেছেন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে এবং কখনো কখনো কঠিন স্বরে। তাঁর ব্যক্তি চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তিনি তাঁর বিশ্বাসটা স্পষ্ট করতেন নির্ভয়ে। সেখানে যা যেভাবে বলতে হবে, ঠিক সেভাবেই কথা বলেছেন তিনি। মূল্যবোধের নীতিহীনতার এই সমাজে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী পুরুষ। তিনি অতিক্রম করেছেন জ্ঞানের, নৈতিকতার ও শুভবুদ্ধির বিশাল পটভূমি। নিজে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ হওয়ায় আমাদেরকে মুক্তবুদ্ধির মানুষ হবার চেতনা দিয়েছেন, দিয়েছেন মানব সন্তান হওয়ার নির্দেশনা। মানুষকে বিভক্ত করা কিংবা উঁচু নিচু ভাবা থেকে দূরে থাকার যে শিক্ষা তিনি তাঁর অনুরাগীদের দিয়েছেন, তা অতুলনীয়। একজন সৎ, ভালো, শিল্পীত ও সমবেদনায়পূর্ণ মানুষের পক্ষে এমন গুণাবলি অর্জন করা সম্ভব।
৪.
সিদ্দিক আহমেদ। আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। আমি তাঁকে যতই দেখেছি, ততই অবাক না হয়ে পারিনি। আমি অনুভব করতে সক্ষম হয়েছিলাম তাঁর গভীর জীবনবোধ। সংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে মুক্ত মনের মানুষ ছিলেন তিনি। সাহসী ও জীবনবোধ তাঁকে তাড়িত করেছে। ফলে চারপাশের মানুষকে আলোকিত করার প্রয়াস পেয়েছেন নানা সময়ে।
হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, লোভ-লালসা, ঘৃণা-পরশ্রীকাতর-সব ধরনের অশুভ ও অসুন্দরকে দু’হাতে মাড়িয়ে আহ্বান জানিয়েছেন সুন্দর ও শুভবোধকে। প্রেম-সহানুভূতি, সহযোগিতা-ভালোবাসা, সুন্দর ও কল্যাণকে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ উপাদান ভেবেছেন। তাঁর সৌন্দর্যবোধে ছিল আধুনিকতা, মানবতাবোধে ছিল গভীর প্রেম। যখন যেখানে, যেভাবে, যে অবস্থানে তিনি ছিলেন, চেষ্টা করেছেন নিজের আদর্শকে অক্ষুণœ রেখে চলার এবং তাঁর অনুসারীদের জন্য ভাবার। নির্লোভ, নিরহংকারী ও সমাজ সংসার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন এই মানুষটির বড় সম্বল ছিলো তাঁর সততা, নৈতিকতা ও মনুষ্যত্ববোধ। জীবনের বড় দুঃসময়েও আপসকামিতাকে প্রশ্রয় দেননি। হাজারও অপ্রাপ্তির ভেতরেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনোবল ও শক্তি হারানোর ভয় তাঁর কখনো ছিলো না। তিনি ছিলেন তেমন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ।
৫.
সিদ্দিক আহমেদ আমাকে খুব ভালোবাসতেন। বয়সের ব্যবধান অনেক বেশি হলেও আমাকে তিনি বন্ধু ভাবতেন। আমার সহকর্মী হিসেবে নয়, তাঁকে আমি পেয়েছি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে। তাঁর অনেক কর্মের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
প্রচার বিমুখ এই মানষুটিকে আমি নিয়ে আসতে পেরেছি গ্রন্থভুবনে। নিজে বইয়ের মানুষ হলেও এবং প্রচুর লেখা প্রকাশ করলেও নিজের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি তেমন আগ্রহী ছিলেন না। এক প্রকার জোর করেই আমি প্রকাশ করে দিয়েছিলাম তাঁর প্রথম বই ‘কবিতার রাজনীতি’। পরে বের করলাম তাঁর ‘খোলা জানালায় গোপন সুন্দরবন’। এর পর আবির প্রকাশন থেকে তাঁর অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়।
তিনি কখনো বক্তৃতা দিতে চাইতেন না। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সভা-সমাবেশে নিবিষ্ট দর্শকের ভূমিকায় তাঁকে দেখা যেতো। সেই সিদ্দিক আহমেদকে দিয়ে আমি বহুবার আমার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পড়াতে পেরেছিলাম। সেই আনন্দ এখনো আমি বুকে ধারণ করি। পরে প্রিয় সিদ্দিক ভাইকে আমি দেখেছি দারুণ বক্তা হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।
টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কথাও আমি বলতে পারি। তাঁর অনীহা ও ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও আমি তাঁকে বাংলাদেশ টেলিভিশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত করাতে পেরেছিলাম। আমি যদি তাঁকে কোনো অনুরোধ করতাম, তিনি তা রাখতেন। কখনো সেই অনুরোধ উপেক্ষা করেননি। তাঁর মনস্তত্ব, মর্যাদা ও অবস্থান বুঝতাম বলে তিনি আমাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। এরকম সজ্জন মানুষ সমাজে সত্যিই বিরল। [ছবি : কমল রুদ্র]