Site icon Shaili Tv

স্বপনচারিণী / রেজাউল করিম স্বপন

১৯৯০ সালের দিকে আমরা চট্টগ্রামের মেহেদিবাগের শহিদ মির্জা লেইনে থাকতাম। থাকতাম পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায়। সামনে অনার্স পরীক্ষা, তাই রাত দিন পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ছাদে গিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে এসে আবার পড়তে বসতাম। একরাতে ছাদে একা একা হাঁটছি, হঠাৎ খেয়াল করলাম ছাদের এক কোণায় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাইরের দিকে তাকিয়ে। রাতে একটা মেয়েকে একাকী ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ ভয় পেলাম, আবার অবাকও হলাম। দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে বাসায় এসে ভয়ে কাঁপছি। আবার চিন্তায়ও পড়ে গেলাম, মেয়েটি কে? কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবো সেই সাহসও পাচ্ছি না। মনে মনে পণ করলাম আর কখনো রাতে ছাদে যাব না। পরদিন দারোয়ানকে বিল্ডিংয়ের সব ভাড়াটিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু যে মেয়েটিকে ছাদে দেখেছি ঐ ধরনের কোন মেয়ে এই বিল্ডিংয়ে থাকে বলে মনে হলো না। বিষয়টি আমার কাছে রহস্যজনক মনে হলো। এদিকে দুই দিন পর পরীক্ষা তাই পড়ালেখায় মন দিলাম। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর মেয়েটি কে, সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলাম।এরপর থেকে ছাদে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ শুরু হলো। আওয়াজটা অনেকটা রেত দিয়ে পাইপ কাটছে বা ছাদে পানির কানেকক্টিং পাইপ গুলোকে আছড়ে ফেলছে,এই ধরনের। বাসার সবার মধ্যে আতংক শুরু হলো। বাড়িওয়ালাকে জানালাম। প্রথম প্রথম বাড়িওয়ালা বিষয়টা পাত্তা দিলো না কিন্তু অন্যান্য ভাড়াটিয়ারাও একই অভিযোগ করায় বাড়িওয়ালা সন্ধ্যার পর ছাদে তালা লাগিয়ে দিত। পরে আওয়াজ আরো বেড়ে যাওয়ায় সন্ধ্যার পর ছাদে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখতো। কিন্তু বিষয়টির সমাধান হলো না। এদিকে আমি আশে পাশে থাকা বন্ধুদের সাথে বিষয়টি শেয়ার করলাম। শুনলাম বছর খানেক আগে এই বিল্ডিংয়ের তিন তলার একটা মেয়ে সুইসাইড করেছিল। সুইসাইড করা মেয়েটির দৈহিক বর্ণনা শুনে ছাদে এক নজর দেখা মেয়েটার সাথে কেমন যেন একটা সাদৃশ্য আছে বলে মনে হলো। এর কয়েকমাস পর এক রাতে হঠাৎ স্বপ্নে একটা মেয়েকে দেখলাম, ঠিক ছাদে যেমনটি দেখেছিলাম সে ধরনের। দেখলাম মেয়েটি আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ছাদে সে যে কোণায় দাঁড়িয়েছিলো, ঠিক সেই কোণায় নিয়ে গেল। ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে ও সমস্ত শরীর ঠা-া হয়ে আসছে। আমি বোবার মত হয়ে গেলাম মুখে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। গলা ফাটাইয়া কাউকে ডাকতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না। মেয়েটি আমাকে বললো ভয় না পেতে। সে আরো বললো, সে আমার কোন ক্ষতি করবে না। তার অভয় পেয়ে তাকে বললাম, আপনি কে? বললো আমি এই বিল্ডিংয়ের তিন তলায় থাকতাম। আমার নাম রিতা। বললাম আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন? বললো আপনি আমাকে দেখে ফেলেছেন তাই। এবার সে বললো আমি বছর খানেক আগে সুইসাইড করেছি। বললাম কেন? বললো কেউ কি ইচ্ছা করে সুইসাইড করে। বাধ্য হয়ে করেছি। বললাম কে বাধ্য করলো?এবার সে বললো শুনবেন আপনি! আমার সব কথা। বললাম শুনবো। এবার সে বলা শুরু করলো, আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আমার ছোটভাই ও আমাকে রেখে হঠাৎ আমার মা হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়।এরপরে বাবা আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলেন। একদিকে উনার চাকুরী অন্যদিকে আমাদের দেখাশুনা, লেখাপড়া ও ঘরের সমস্ত কাজকর্ম। তাই তিনি সবদিক সামলে উঠতে পারছিলেন না। কিছুদিন যাওয়ার পর আমার ফুফু, চাচা, খালা ও মামারা সহ সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো বাবাকে আবারো বিয়ে করাবেন। প্রথম দিকে আমাদের কথা চিন্তা করে বাবা রাজি ছিলেন না। পরে সবার অনুরোধে ও আমাদের দেখভালের কথা চিন্তা করে বাবা বিয়ে করতে রাজি হলেন। এরি মধ্যে আমি এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হলাম আর আমার ছোটভাই উঠলো ক্লাস এইটে। সবাই দেখে শুনে বাবাকে আবার বিয়ে করালেন। ঘরে নতুন মা আসলো। নতুন মা এসে আমাদের সাথে বেশ মানিয়ে নিল। আমাদের দুই ভাইবোনকে বেশ আদর করতো, আমরাও উনাকে বেশ সম্মান করতাম ও মায়ের মত ভালবাসতাম। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো উনার এক ভাইয়ের ছেলে আমাদের বাসায় আসার পর। ছেলেটি গ্রাম থেকে ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে আমাদের বাসায় এসে উঠলো কিছু একটা করবে এই আশায়। প্রথম প্রথম উনাকে বেশ ভাল মনে হলো এবং উনিও আমাদেরকে বেশ আদর করতো কিন্তু কিছুদিন পর থেকে উনার আচরণ অন্য রকম হয়ে গেল। খেয়াল করে দেখলাম আমার বাবার সম্পত্তির প্রতি তার এক ধরনের লোভ। আরো কিছুদিন পর তার আচরণেও পরিবর্তন আসলো। ফলে তিনি আমাকে নোংরা ও ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলা শুরু করলেন। সময় অসময় আমার রুমে এসে বসে বসে গল্প করতো। একপর্যায়ে আমার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিতে চেষ্টা করতো।এতে করে উনার প্রতি আমার এক ধরনের ঘৃণা জন্ম নিলো এবং আমি উনাকে আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তবুও বেশ কিছুদিন সহ্য করার পর একদিন আমি সৎ মাকে উনার ভাইয়ের ছেলের আচরণ সম্পর্কে বলি। উনি সব শুনে আমাকে বললো চিন্তা না করতে। কিন্তু কয়েকদিন পর থেকে দেখি উনার আচরণও রহস্যজনক হয়ে গেল। উনি আমাকে দোষারোপ করা শুরু করলো। এটা নিয়ে উনার সাথে আমার দূরত্ব তৈরি হতে লাগলো। ঐদিকে আমার সৎ মায়ের ঘরে একটা ছেলে জন্ম নিলো। আমার এই সৎ ভাইটা হওয়ার পর থেকে আমার সৎ মা আমাদের প্রতি আরো রূঢ় আচরণ শুরু করলো। এটা সেটা বলে বাবার কান ভারী করা শুরু করলো। প্রথম প্রথম বাবা নীরবে সব সহ্য করলেও পরবর্তীতে ঘরের এই অশান্তির জন্য আমাকে ও আমার ভাইকে দোষারোপ করা শুরু করলো। দেখলাম, যে বাবা কিছুদিন আগেও আমাকে লোকমা তুলে খাইয়ে দিতো, রাতে রুমে এসে দেখতো আমি ঠিক মত ঘুমাচ্ছি কিনা। খাটের মশারী লাগাইয়া দিতো সে বাবা রাগ করে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। এই ঘটনা আমাকে খুব কষ্ট দিলো এবং নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। মনে হলো এই সংসারে সব অশান্তির মূলে আমি। তাই আমার বেঁচে থাকা অপাংক্তেয় মনে হতে লাগলো।এদিকে আমার সৎ মা আমাকে তার ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলো। দেখলাম এতে আমার বাবারও সায় আছে।এরপরে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। একদিন সরাসরি বাবার মুখোমুখি হলাম। বললাম আমি এখন বিয়ে করবো না। লেখাপড়া শেষ করে তবেই উনাদের পছন্দমত ছেলেকে বিয়ে করবো। এদিকে একদিন বিকালে আমার সৎভাইটার জ্বর আসায় মা ও বাবা দু’জনে মিলে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। এই সুযোগে ছেলেটা আমার ছোটভাইকে দোকানে পাঠায় কিছু জিনিস আনার জন্য। ছোটভাই বের হয়ে যাওয়ার পর ছেলেটি আমার উপর হামলে পড়ে ও জোর করে আমাকে ধর্ষণ করে।এতে করে তার প্রতি আমার ঘৃণা আরো বেড়ে গেল।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই যে ছেলে আমাকে একা পেয়ে জোর করে ধর্ষণ করতে পারে, তাকে জীবন থাকতে বিয়ে করবো না। দরকার হলে আত্মহত্যা করবো। বিষয়টি নিয়ে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। কয়েকজন বন্ধু বান্ধবী ও আমার ফুফু ও খালার সাথে ছেলেটিকে বিয়ের বিষয় নিয়ে আলাপ করলাম। কিন্তু কেউ বাবাকে এই বিয়ে হতে বিরত করতে পারলো না। বাবার এক কথা ঐ ছেলেকে বিয়ে করতে হবে এবং অতি দ্রুত। শেষ চেষ্টা হিসাবে কয়েকদিন খালার বাসায় গিয়ে থাকলাম কিন্তু ওখান থেকে আসার পর আমার প্রতি আক্রমণ আরো বেড়ে গেল।শেষমেশ আর সহ্য করতে না পেরে নিজেই নিজেকে শেষ করে দিলাম।এ কথা বলে মেয়েটি আঝোরে কেঁদে দিলো।মেয়েটির কান্না দেখে আমিও আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম।এদিকে তীব্র অস্বস্তিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল, দেখলাম বিছানায় আমি ঘেমে একাকার। ঘুম থেকে উঠে কতক্ষণ তন্ময় হয়ে বসে রইলাম। ডাইনিং রুমে গিয়ে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ৪.১৫। ভয়ে জড়সড় হয়ে আবার শুয়ে পড়লাম তবে সারা রাত দুই চোখ আর এক করতে পারি নাই। শুধু ভাবলাম এটা আমি কি দেখলাম! এটা কি দুঃস্বপ্ন? পরের দিন বাসার দারোয়ান ও এলাকার বন্ধুদের সাথে মেয়েটির বিষয়ে আলাপ করে বুঝলাম স্বপ্নে যা দেখেছি তা মোটামুটি সঠিক।এরপরেও মেয়েটি মাঝে মধ্যে স্বপ্নে আমার সাথে দেখা করতে আসতো গভীর রাতে। স্বপ্নে মেয়েটি এলে আমি অনেক সময় শোয়া থেকে উঠে বসে কথা বলতাম আবার অনেক সময় বারান্দায় গিয়ে কথা বলতাম। আমার বিয়ের পর বিষয়টি আমার স্ত্রীর নজরে আসে। রাতে আমি বিছানায় বসে কথা বলার সময় আমার স্ত্রী আমাকে ধাক্কা দিলে মেয়েটি চলে যেত এবং আমি আবার ঘুমিয়ে পড়তাম।এভাবে গত ২৫-৩০ বছর ধরে স্বপ্নে মেয়েটি আমার সাথে এসে দেখা করে। একদিন আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম কতদিন সে এভাবে আমার কাছে আসবে, সে বলে যতদিন আমি বেঁচে থাকি ততদিন সে আসবে। এর মধ্যে কিছু অদ্ভুত বিষয় আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে। যেমন আমার জীবনের অনেক ঘটনা দুর্ঘটনা আমি আগে থেকে আন্দাজ করতে পারি। কোন খারাপ বা ভালো খবর পাওয়ার আগে আমি সেটি সম্বন্ধে জানতে পারি। আবার ধরুন কোন মানুষের সাথে দেখা হলে, সে কি বলতে চায় তা আমি আগেই আন্দাজ করতে পারি। আবার অনেক সময় আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করলে সেটি কেমন করে যেন আমার খাওয়ার সময় হাজির হয়ে যায়।এ রকম অনেকগুলো বিষয় আমার জীবনে মিথের মত ফলে গেছে। যা হয়তো আরো অনেকদিন অব্যাহত থাকবে।

Exit mobile version