মাকে হারিয়েছি আজ চল্লিশ দিন। গত ২৯ জুন ২০২০, সোমবার সকাল ৮টায় আমার মা মোসাম্মৎ হালিমা বেগম (৭০) মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না-লিল্লাহ ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজিউন।
কঠিন দুঃখের কোন সান্ত¡না নেই। পৃথিবীতে মাতৃহীন এতিমের চেয়ে বড় অভাগা কে?
বাবাকে হারিয়েছি সেই দূর শৈশবে। পরম করুণাময় মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে মা দীর্ঘ হায়াতই পেয়েছিলেন বাবার তুলনায়। আল্লাহ সত্যিই পরম দয়ালু নারীদের প্রতি। আমার মায়ের বড় ও ছোটবোনও প্রয়াত হয়েছেন অনেক আগেই।আমার তিন তিনটি ভাইও দুনিয়া ছেড়েছে বড্ড অকালে।সেই ভয়াবহ শোক বুকে বেঁধেও মা বেঁচেছিলেন।হৃদয়ে রক্তক্ষরণ যদিও তাকে রিক্ত ও নিঃস্ব করেছে।
অমর একুশে বইমেলায় মা আমার স্টলে এসেছিলেন। প্রায় সারাদিনই মা ছিলেন।আমাদের সদ্যপ্রকাশিত বই হাতে ছবিও তুলেছিলেন।সেই ছবি মা বলেছিলেন ফেসবুকে দিতেও।বেঁচে থাকলে জীবনে আরো অনেক বইমেলায় থাকবো।কিন্তু আমার মা আর কোনদিন বইমেলায় যাবে না।
মায়ের মৃত্যু যে কোন সন্তানের জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি। মায়ের দোয়া পৃথিবীতে সবচে বড় পাথেয়। যার মা আছেন তার মত ধনী কে?
যতদিন মা ছিলেন নিজেকে কখনো নিঃস্ব ভাবিনি।আজ যে চোখের জলে মন প্রবোধ মানে না।
ফিরে এসো মা।
মায়ের মৃত্যুর পরদিন থেকে শোক ভুলতে টানা ২০দিন কবিতা লিখেছি।মাকে নিয়ে লেখা ছড়াগুলো দিয়ে একটি ছড়াগ্রন্থের স্বপ্নও ছিল। কিন্তু তা যে এলিজি২ হবে কে জানতো? এ বই মাকে কিভাবে দেব!
মাকে ফোনে ও সাক্ষাতে রোজই বলতাম, দোয়া করো মা। মা বলতেন, দোয়া করছি।এখন কাকে বলবো?
আমি বিশ্বাস করি, সন্তানের জন্য পৃথিবীতে মা ই সবচে বড় পির। মায়ের প্রাণ কি কখনো মরে? মায়ের আত্মা যে চিরঅমর।আমি বিশ্বাস করি আজও আমার মায়ের দোয়া আমার মাথার উপরে ছায়া হয়েই আছে।
প্রতি ভোরে ফজর পড়েই মায়ের কবরে ছুটে যাই।কত কত পির আউলিয়া বুজুর্গদের সাথে শহরের প্রাণকেন্দ্রে নগর বাইশ মহল্লা কবরস্থানে মসজিদের পাশেই শায়িত আছেন মা।আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।আমিন।
এই করোনাকালে প্রিয় অনেকের সাথে আমার মাও হঠাৎ হারিয়ে যাবেন কখনো ভাবিনি।কথা ছিল সেরে উঠে ভালো হয়ে মা ডাক্তারের কাছে যাবেন।আমার বাসায় আসবেন। মা যে ফাঁকি দিয়ে আল্লাহর কাছে তাঁর আপন গৃহেই চলে গেলেন।
আমরা ছয় সন্তান মাকে কিছুই দিতে পারিনি।স্বামীহারা সদ্যবিধবা মা শহরে এসেছিলেন ছেলেদের মানুষ করতে। রিক্ত, নিঃস্ব, অসহায় মা সারা জীবন একাই লড়েছেন অকুতোভয়ে। নির্লোভ, নিঃস্বার্থ মা মরণে ভুবনজয়ী। নিজগৃহে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্ম ও মৃত্যু দিন প্রিয় সোমবারেই মা চলে গেলেন।
বিয়ের পর মায়ের সঙ্গে আর কখনো এক ঘরে থাকা হয়নি। কিন্তু মৃত্যুর আগের দিন মা হঠাৎ আমাকে রাতে থেকে যেতে বলেন।দুপুরে বিদায়কালে মা চিৎকার করে বলেছিলেন ‘না’।মায়ের সেই ডাক আমি যে শুনিনি। তাই পরদিন ভোরে মাকে দেখতে ছুটে আসতে কাছাকাছি পথেই তার মৃত্যু সংবাদ শুনি।
মা,আমার মা।
তুমি এভাবে আমাকে একা ফেলেই চলে গেলে! খুব কি ভালো আছো স্বর্গে? মাগো,আমার যে নিঃশ্বাস আটকে আসছে।চোখে ঝাপসা দেখছি।আমার কে আছে আর?
আমার সাহিতানুরাগী মা কবিতা লিখতেন।বই পড়তেন। পত্রিকা রাখতেন।চট্টগ্রামের কবিসাহিত্যিকদের খুবই ভালোবাসতেন মা। সবাইকে দেখতেই তিনি মেলায় ছুটে আসতেন।সবার কুশল জানতে চাইতেন।সবার জন্য দোয়াও করতেন।
মায়ের দোয়ায় অনেকদূর এসেছি জীবনে।আমার পূণ্যময়ী মাও নিশ্চয় আল্লাহর নৈকট্যে ভালো আছেন।সুখে আছেন।পরম কষ্টে সেটাই সান্ত¡না।
তাকে শহরে আমার কাছেই রেখেছি।গ্রামে নিইনি।মসজিদ বায়তুশ শরফে বাদ জোহর জানাজা শেষে এখানেই কবর দিয়েছি। যেখানে আমার ভবিষ্যৎ। যে মা কোনদিন আমাকে চোখের আড়াল করেননি আমি তাঁকে কি করে দূরে ফেলে রাখি?
দীর্ঘ চল্লিশ দিন শোক চেপে আছি বোবাকান্নায়।মৃত্যুর দিন রাতে বুক ফাটা কান্না ধমকে থামাতে চায় আমার শোকাহত রাজকন্যা। কর্তব্য কর্মের টানে রোজই ছুটছি।কিন্তু এক সেকেন্ডও কি মাকে ভুলতে পারছি?
মাকে মনে পড়ে।
ভীষণ মনে পড়ে।
প্রবল মনে পড়ে।
আনমনা হই। নীরবে কাঁদি। নফল পড়ি। বাইরে যতই স্বাভাবিক থাকি না কেন ভেতরে ভেতরে ক্ষয়েই তো যাচ্ছি।
শুধু শুনতে পাই মায়ের শেষ ডাক….
মা,
আমি কতদিন বাঁচব?