প্রায় দুই বছর হলো রীতার স্বামী এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তাদের দুই সন্তান, একজনের বয়স ১৩, অন্য জনের ১০। এই দুই বছরে ছোট দুইটা বাচ্চা নিয়ে রীতা বুঝেছে জীবন কত কঠিন। মাত্র চৌদ্দ বছর সংসার করেছে রীতা, স্বামীকে ভাল করে বুঝার আগেই মারা গেছে। এখন প্রতি মুহূর্তে স্বামীর কথা মন পড়ে। বিশেষ করে রাতে ঘুমাতে গেলে বাচ্চারা বাবাকে খুঁজে, তখন বাচ্চাদের সান্ত¦না দিতে গিয়ে নিজের অজান্তে নিজেই কেঁদে ফেলে রীতা কিন্তু সেটা বাচ্চাদের বুঝতে দেয় না। আবার অনেক সময় স্কুল থেকে এসে বাচ্চারা বাবার অভাবের কথা বলে। তখনো এটা সেটা বলে বাচ্চাদের সান্ত¦না দিতে রীতার অনেক কষ্ট হয়।এদিকে রীতার মা বাবা চায় রীতা আবার বিয়ে করে সংসারী হউক কিন্তু স্বামীর কথা মনে পড়লে রীতা আর কাউকে ঐ জায়গায় ভাবতে পারে না। বছর খানেক ধরে মা বাবা রীতাকে আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবীদের মাধ্যমে খুব চাপে রেখেছে। কিন্তু রীতার এক কথা, আবার বিয়ে করবে না। দুই সন্তান ও স্বামীর স্মৃতি নিয়ে বাকী জীবন কাটিয়ে দেবে। স্বামী মারা যাওয়ার পর রীতা বুঝতে পারে জীবন কত কঠিন। স্বামীর কথা মনে করে মাঝে মধ্যে আনমনা হয়ে ভাবে একটা মানুষ ব্যবসা বাণিজ্য, সংসারের সমস্ত বাজার হাট, অফিস/বাসার গ্যাস, ইলেকট্রিক, পানি, টেলিফোন বিল, বাড়ি/জমির খাজনা, বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, বাচ্চাদের স্কুল বেতন সব কিছু সময়মত দিয়েও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে কিভাবে সময় বের করে পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিতো।এটা ভাবলে রীতার কাছে আশ্চর্য লাগে। অথচ স্বামী জীবিত থাকতে রীতা এতোকিছু বুঝতো না, শুধু স্বামীর বিরুদ্ধে রাজ্যের অভিযোগ ছিলো তার। সেজন্য রীতা এখন খুব অনুশোচনায় ভোগে।
কয়েকদিন থেকে রীতা খুব ব্যস্ত। প্রায় আট বছর পর ওর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সোমা আমেরিকা থেকে দেশে এসে দুই দিনের জন্য ওর বাসায় উঠেছে। সে জন্য আগে থেকে ঘরদোর সব পরিস্কার পরিছন্ন করিয়েছেন। দারোয়ানকে দিয়ে হরেক রকমের দেশীয় মাছ ও শুটকী কিনিয়েছেন। দেশীয় ঐতিহ্যবাহী অনেক খাবার কিনে রেখেছেন বান্ধবীকে খাওয়াবেন বলে। বান্ধবী, তার স্বামী ও বাচ্চাদের জন্য অনেক গিফটও কিনে রেখেছেন। আজ সারাদিন ঘরের সব কাজকর্ম শেষ করে সন্ধ্যায় বান্ধবী ও তার স্বামীর সাথে কিছুটা খুনসুঁটি ও গল্প করে রাতে দুই বান্ধবী একসাথে থাকবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর দুই বান্ধবী এক সাথে বিছানায় বসে গল্প করছেন সুখ দুঃখের বিভিন্ন বিষয়ে। গল্প করতে করতে একসময় রীতার স্বামীর প্রসঙ্গ ওঠে। স্বামীর প্রসঙ্গ উঠায় রীতা খুব আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে। কারণ এই একটি জায়গায় রীতা খুব দুর্বল। স্বামীর প্রসঙ্গ উঠায় রীতা আনমনা হয়ে স্মৃতি হাতড়ে বলে, জানিস হাসান আমাকে খুব ভালোবাসতো। অথচ আমি তাকে বিয়ে করতে চাই নি। অনেকটা জোর করে তার সাথে বিয়ে দেয় আমার বাবা। সে দেখতে খুব একটা হ্যন্ডস্যাম বা সুন্দর ছিলো না। কিন্তু তার মনটা ছিল আকাশের মত উদার। বাসর রাতে সে আমাকে বলেছিলো “আমাকে চিনতে তোমার ১০-১৫ বছর সময় লাগবে”। এতো মানবিক একজন পুরুষ আমি জীবনে দেখি নাই। যখন আমাদের বিয়ে হয়, তখন তার আর্থিক অবস্থা এতোটা ভালো ছিলো না। কিন্তু রাতদিন কঠিন পরিশ্রম করে সে ব্যবসায় সফলতা লাভ করে। প্রথম প্রথম কিছুটা হাতটান থাকলেও ৪-৫ বছর পর থেকে সচ্ছলতা চলে আসে। জানিস ছুটি পেলেই সে আমাদেরকে নিয়ে লং ড্রাইভে যেতো। আমাকে সামনে বসাবে শুধু এই কারণে ড্রাইভার রাখতো না। তার জীবদ্দশায় এমন কোন ছুটির দিন যায় নাই, যে দিন সে আমাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যায় নাই। তার কিছু কিছু বিষয়কে আমি পাগলামি বলে মনে করতাম, তবে ভিতরে ভিতরে তা উপভোগও করতাম। অনেক সময় বন্ধের দিনে দুপুরের পর রিক্সায় করে আমাকে নিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়তো রিকশার হুড ফেলে। তারপর সন্ধ্যায় কোন রেস্টুরেন্টে বসে আইসক্রিম বা হালকা কিছু খেয়ে বাসায় চলে আসতো। কোথাও দাওয়াত পেলে আমাকে ছাড়া কখনো যেতে চাইতো না। আবার ছুটির দিনে, দিনের বেলায় বৃষ্টি হলে সে আমাকে জোর করে ছাদে নিয়ে যেতো বৃষ্টিতে ভিজার জন্য।কখনো রাতে বৃষ্টি হলে জানালার গ্রিল দিয়ে আমার হাতটা বের করে বৃষ্টিতে হাত ভিজাতে বলতো। আমি ভিজানোর জন্য হাত বের করলে পিছন দিক দিয়ে জড়িয়ে ধরে ওর হাতটা বের করে আমার হাতের নিচে ধরে রাখতো।এতে করে আমার হাতের তালু থেকে বৃষ্টির পানি চুয়াইয়া ওর হাতে পড়তো। পরে সেই পানি আমার মুখে ছিটিয়ে আমাকে ভিজিয়ে দিতো। পূর্ণিমার দিন গভীর রাতে ছাদে গিয়ে দুইজন পাশাপাশি বসে আমার হাত ধরে জোৎস্না দেখতো ও আকাশের তারার বর্ণনা দিতো। অনেক সময় রাত ১১টার দিকে আমাকে নিয়ে ড্রাইভ করে বীচে চলে যেতো। কিছুক্ষণ সাগরের পাড়ে বসে সাগরের শো শো গর্জন শুনে আবার চলে আসতো। আবার কোন সময় গভীর রাতে আমাকে নিয়ে বের হয়ে কোন কফি শপে কিছুক্ষণ বসে কফি খেয়ে আবার চলে আসতো। আমি মুখে কিছু না বললেও বিষয়গুলো আমার হৃদয় ছুঁয়ে যেত কিন্তু আমি তাকে তা বুঝতে দিতাম না। অনেক সময় আমার অগোচরে পছন্দের সব জিনিস নিয়ে বাসায় হাজির হতো। মার্কেটে কিছু কিনতে গেলে আমি যেটা পছন্দ করতাম প্রথম সেটা কিনে দিতে না চাইলেও পরে ঠিকই কিনে দিতো। একবার আমি অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে একটা অপারেশন করতে হয়। সে সারারাত মশার কামড় খেয়ে হাসপাতালের বারান্দায় বসে ছিলো এবং আমার হুশ আসার পর সে বাসায় গিয়েছিলো। পরে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন সারারাত হাসপাতালে বসে ছিলো। সে বলেছিলো তোমাকে একা রেখে কিভাবে যাই বলো।এটা শুনে আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরেছিলো। মাঝে মধ্যে তাকে ব্যবসায়ে বেশী পরিশ্রম না করতে বললে, সে বলতো এগুলো তোমাদের জন্য করছি। ওর কথা বিশ্বাস না করে আমি বলতাম আমাদের জন্য নয় পরিশ্রম তুমি তোমার জন্য করছো। তখন সে বলতো আমার মৃত্যুর পর যেন আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা কারো কাছে হাত পাততে না হয় সেই জন্য আমি কঠিন পরিশ্রম করছি। জীবিত থাকা অবস্থায় তার কথা বিশ্বাস না করলেও এখন দেখছি সে সত্যিই বলেছিলো। রীতা আরো বলে প্রায় রাতে স্বপ্নে হাসান এসে আমাদের খোঁজখবর নেয় ও উপদেশ দিয়ে যায়। বলে ধৈর্য্য না হারাতে। এসব বলতে বলতে রীতার চোখের কোণে অশ্রু জমা হতে থাকে। স্মৃতিচারণ করতে করতে রাতও অনেক গভীর থেকে গভীরতর হয়। হঠাৎ করে সোমা রীতাকে বলে আবার বিয়ে করতে। রীতা এবার বলে, শোন বাচ্চাদের চোখের দিকে তাকালে আমি হাসানকে দেখতে পাই। মনে হয় হাসান আমার দিকে তাকিয়ে আমার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কি জানিস ছোট ছেলেটা হুবহু বাবার মত হয়েছে। চলনে বলনে হবুহু হাসান, বলতে পারিস অবিকল নকল (লুক এলাইক)। রীতা সোমাকে আরো বলে, আমি বিয়ে করলে হয়ত স্বামী পাব কিন্তু বাচ্চাদের কি হবে? তারা বাবাকে হারিয়েছে নিয়তির জন্য। আমি বিয়ে করলে আমাকেও হারাবে। তখন তাদের কি হবে? তাহলে সবকিছু জেনেশুনে ও বুঝে আবার বিয়ে করাটা কি ঠিক হবে? তুই খেয়াল করেছিস কিনা জানি না, হাসান মারা যাওয়ার পর থেকে বড় ছেলেটা কেমন রিজার্ভ হয়ে গেছে। দরকার ছাড়া কোন কথা বলে না। মনে হয় ওর ভিতরে খুব কষ্ট। আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওকে বুঝাতে কিন্তু সে চুপচাপই রয়ে গেছে। এবার সোমা বলে শোন, তোর বাচ্চারা বড় হয়ে বিয়ে শাদী করলে হয়ত তোর এই আত্মত্যাগের কথা মনেও রাখবে না। রীতা বলে, আমি তো হাসানের জন্য বিয়ে করবো না। কারণ জীবিত থাকতে তাকে আমি এতোটা ফিল করতাম না। প্রায় তার সাথে ঝগড়াঝাটি করতাম, আক্রমণ করে অনেক কথা বলতাম কিন্তু সে সবসময় মুচকি হেসে সবকিছু হজম করতো। মৃত্যুর পর সে আমার সাথে ছায়ার মত লেগে আছে। মনে হয় সবসময় সে আমাকে ফলো করছে। আমার কাছে জীবিত হাসানের থেকে মৃত হাসান অনেক বেশী শক্তিশালী ও প্রিয়। এটা বলে রীতা অঝোরে কাঁদতে শুরু করে। রীতার কান্না দেখে সোমাও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। সেও কেঁদে রীতাকে জড়িয়ে ধরে বলে আসলে হাসান ভাই অনেক ভাগ্যবান একটা মানুষ। যে কিনা মরে গিয়েও তোর অনুভূতির মাঝে বেঁচে আছে ও আজীবন বেঁচে থাকবে।