বিশ্বের যে কোনো স্থানের জীবনবাস্তবতার নান্দনিক অনুভূতি প্রকাশ করার মাধ্যম হলো অনুবাদ। ভাষান্তরের বাঁধা পেরিয়ে, ভৌগোলিক দূরত্বকে জয় করে বিশ্বমানবের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ এনে দেয় অনুবাদ। এমন কোনো সাংকেতিক মাধ্যম এখনো আবিস্কার হয়নি যা বিশ্ব জুড়ে সব মানুষের বোধগম্য হতে পারে। অপরিচয় থেকে পরিচিত ভাষায় রূপান্তরের মধ্যে যখন উভয় জীবনবোধের পার্থক্য মুছে দেয়া হয় তখনই সেই অনুবাদ হয় সার্খক ও কালোত্তীর্ণ। এই ধরনের অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা আমাদের কাছে অনেক। এক্ষেত্রে অনুবাদকের সংকটও কম নয়। এমন এক পরিস্থিতিতে অনুবাদ কর্মে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের মেধাবী লেখক ফারজানা রহমান শিমু। তিনি মূলত একজন গল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক। ইতোমধ্যে অনুবাদ কর্মে তার সাহসী ভূমিকায় অনেকের নজর কেড়েছে। অনুবাদের এই মাধ্যমে তিনি এত বেশি সফল হয়ে উঠছেন প্রকাশকরাও রীতিমত হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এরমধ্যেও কোনো কোনো সমালোচক নানাভাবে তার সম্পর্কে ভিন্নমত পোষন করেছে বটে। কিন্তু তা জোরালো ছিল না। বরং তিনি অনুবাদে ভাষাগত পার্থক্য দূরীকরণে সক্ষম হয়ে বোদ্ধা মহলের প্রশংসাও অর্জন করেছেন।
আসলে একই ভাষা হতে অন্য ভাষায় কোনো একটি ভাব ব্যক্ত করা বড়ই কঠিন। ভাষার ঠিক ব্যবহার না জানলে কী হতে পারে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিষবৃক্ষ উপন্যাসটি তার প্রমাণ। এই লেখাটি ইংরেজিতে অনুবাদ হয় Poison Tree  নামে। যিনি অনুবাদ করেন তিনি বঙ্গীয় সমাজের বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। স্বভাবতই তাঁর অনুবাদে ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। গ্রন্থের এক জায়গায় রয়েছে ‘কোথাও বা গোপাল উড়ের যাত্রা হইতেছে।’ অনুবাদক অনুবাদ করলেন, In some places there were the journey of the flying Gopal. অর্থাৎ পুরো লাইনটার মানেই বদলে গেল।

অনুবাদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি অনেকের হয়ে থাকলেও ফারজানা রহমান শিমু অত্যন্ত সচেতন। তিনি অনুবাদে ভাষার প্রকাশ ঘটাতে যেমন সতর্ক তেমনি ভাব প্রয়োগেও।
যখন কোনো লেখক তার লেখা রচনা করতে বসেন তিনি স্বদেশ ও পরিবেশকে প্রাধান্য দেন। দেশ কাল স্থান পাত্র পরিবেশ অনুযায়ী লেখক জানা উপকরণ দিয়ে তার সৃষ্টিকে সাজান। সেই সৃষ্টি যখন আরেক দেশের ভাষায় অনুবাদ হয় তখন কি অনুবাদক একই চিন্তাধারায় একই শব্দ গন্ধ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন নাকি সেটা সম্ভব!
এদিক থেকে চিন্তা করলে বলা যায়, ফারজানা রহমান শিমু যোগ্যতার সাথে সম্ভব কথাটার ইতিবাচক রূপ দিয়ে তার অনুবাদ কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। আক্ষরিক অনুবাদ তার মোটেও পছন্দ নয়। ভাবানুবাদে বিশ্বাসী একজন অনুবাদক হিসেবে আমরা তাকে পাই। তার আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো তিনি একজন সাহিত্যিক।গদ্যচর্চায় তার হাত বেশ শানিত।
তিনি যে সব লেখার অনুবাদ করছেন তা এক কথায় বিশ্বের সেরা কিছু বই যা বেশিরভাগই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে উপজীব্য। অন্তত নির্দ্বিধায় বলা যায়, সবগুলো বই মানসম্মত যার অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত। সুতরাং ভালো মানের বই অনুবাদে তার দায়িত্বশীল ভূমিকাও কম নয়। বুদ্ধদেব বসু নিজে একাধিক অনুবাদ করলেও অনুবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, লেখা যত ভাল অনুবাদকের বিঘ্ন তত বেড়ে যায়।
এই বিঘ্ন অতিক্রম করা শিমুর জন্য তেমন কঠিনও ছিল না।কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজে এক সময় প্রচুর অনুবাদ করলেও তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন অনুবাদ করলে মূল সাহিত্যের গুণ বজায় থাকে না। সেই কারণেই তিনি পরিণত মানসিকতায় দীর্ঘ জীবনব্যাপী সাহিত্যচর্চার অনুবাদের তুলনায় ভাষা শিক্ষার ওপর অধিক জোর দেন। ফারজানা রহমান শিমুর ক্ষেত্রেও তা-ই দেখি। তিনি যখন ইংরেজীতে অনার্সসহ মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তখনই আমি বুঝতে পারি অনুবাদে তার সক্ষমতা সম্পর্কে। তার অনুবাদে আমি রীতিমত অবাক হতাম। অনেক প্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্র (motto) তৈরি করতেও তাকে দেখেছি। বাক্যগুলোয় এমন ভাব, রূপ, ব্যঞ্জনা ও নান্দনিক গুণের প্রকাশ ঘটাতো মুগ্ধ না হয়ে পারতাম না। তাই ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় অগ্রসর এই লেখকের পক্ষে শুদ্ধতম অনুবাদের সবকটি বাধা অতিক্রম করা অসম্ভব কিছু নয়।
দিনরাত অনেক পরিশ্রমে তার অনুবাদ কর্ম এগিয়ে চলেছে। তার অনুবাদ গ্রন্থগুলো হলো ফ্রিডম ইজ নট ফ্রি,  মূল- শিব খেরা (মার্চ-২০০৪), দি পাওয়ার অব পজিটিভ থিংকিং (ফেব্রুয়ারি ২০১৮), চেঞ্জ ইয়োর থিংকিং চেঞ্জ ইয়োর লাইফ (ফেব্রুয়ারি ২০১৯), রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড (ফেব্রুয়ারি ২০১৯), মাই-সেট- (ফেব্রুয়ারি ২০১৯), অ্যাস এ ম্যান থিংকথ (মার্চ-২০১৯), দি আর্ট অব থিংকিং ক্লিয়ারলি (মে ২০১৯), বডি ল্যাঙ্গুয়েজ (মে-২০১৯), দি ইন্টেলিজেন্ট ইনভেস্টর (জানুয়ারি-২০২০), থিংকিং ফাস্ট এ- স্লো (সেপ্টেম্বর-২০২০), দি ফাইভ লাভ ল্যাঙ্গুয়েজ (নভেম্বর ২০২০), দি ফোর আওয়ার ওয়ার্ক উইক (নভেম্বর ২০২০)।
তার অনুবাদ গ্রন্থগুলো দেখে মনে হয় তিনি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। যেহেতু তিনি একজন সাহিত্যিক সে হিসেবে বলতে পারি, তিনি আগামী অনুবাদের বিষয় নির্বাচনে যেন জীবনধর্মী সাহিত্যও সম্পৃক্ত রাখেন। এভাবে বিশ্বের বরেণ্য সাহিত্যিকদের সমৃদ্ধ সাহিত্যের সাথে তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিবেন এই প্রত্যাশা আমরা অন্তত করতে পারি।