কোচিং থেকে বেরিয়ে হনহন করে টেম্পো স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে থাকে অমিত।তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।আজ ক্লাস শেষ হয়েছে দেরীতে,এতক্ষণে মা নিশ্চয় তার পথ চেয়ে আছে।প্রতিদিন এতক্ষণে সে বাসায় পৌঁছে যায়,কিন্তু আজ একটা বাড়তি ক্লাস ছিল,তাই একঘন্টা দেরী হয়ে গেলো।তার বাসা এখান থেকে অনেক দূরে,তবুও এত দূরে কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার কারণ এ কোচিং সেন্টারটার মান বেশ ভালো।তাই তার মা বাবাও দূরত্বের কারণে মনে কিছুটা দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও এখানে তাকে ভর্তি করিয়েছে।এসব কথা ভাবতে ভাবতে সে রাস্তাটা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।তখনই সে পেছন থেকে শুনতে পায় “ভাইয়া” ডাকটি।
সে পেছন ফিরে তাকায় শব্দের অনুসন্ধানে,দেখে, তার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় একটা ছেলে তাকেই ভাইয়া বলে ডাকছে।কিছুটা অবাক হয় সে,ছেলেটাকে সে চেনে না,কিন্তু ছেলেটার দৃষ্টি দেখে মনে হয় ছেলেটা তাকে ভালো করেই চেনে।অমিত ভ্রু কুঁচকে বলে,” আমাকে বলছেন?” ছেলেটা খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে বলে,” হ্যাঁ,তোমাকে বড় ভাই ডাকছে।” অমিত বোঝে না বড় ভাইটা কে? তাই সে এদিক ওদিক তাকায় বড় ভাইয়ের সন্ধানে।ছেলেটা অমিতের দৃষ্টি বুঝতে পেরে বলে,” ওই যে বড় ভাই” বলেই একটা দোকানের সামনে বসা কয়েকজন যুবকের দিকে আঙ্গুল তোলে।অমিত কিছুটা ঘাবড়ে যায়,এ এলাকার কোচিং সেন্টারটা ছাড়া সে আর কিছু চেনে না।এ এলাকায় তার কোনো আত্মীয় বা পরিচিতজনও নেই।তাছাড়া তার এই আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত সে কখনো কলেজ আর বাসা ছাড়া একা কোথাও যায়নি।যেখানেই যায় মা বাবা কিংবা কলেজের বন্ধুদের সাথেই যায়।আর এমনিতেও সে একটু ঘরকুনো। প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বেরুতে তার ভালো লাগে না।নেহায়েত পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষায় টেকার মানসে তার এই কোচিং সেন্টারে আসা। এখানে আসার পরও তার নতুন কোনো বন্ধু হয়নি,ছোটবেলা থেকেই সে খুব চুপচাপ বলে তার বন্ধু সংখ্যাও হাতে গোনা।নতুন কারো সাথে সে চট করে মিশতেও পারে না।
তাই এই ছেলেটা বড় ভাইদের গ্যাংটাকে দেখিয়ে দেওয়ার পর সে কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়ে,কেন ডাকছে ওকে ওরা? তারপর বিধাতাকে স্মরণ করে সে ছেলেটার সাথে বড় ভাইদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।ওখান থেকে একজন উঠে আসে,তারপর অমিতের দিকে তাকিয়ে বলে,” খুব সেয়ানা হয়েছো না?” অমিত বোকার মতো তাকিয়ে থাকে প্রশ্নকর্তার দিকে,বুঝে উঠতে পারে না ও সেয়ানাগিরি কী করলো! ওর বোকা চাহনি দেখে সেই প্রশ্নকর্তাই আবার বলে,” তুই আমার বোনকে ম্যাসেন্জারে বাজে ছবি পাঠিয়েছিস কেন?” আকাশ থেকে পড়ে অমিত! ও পাঠিয়েছে কোনো মেয়েকে বাজে ছবি? মেয়েদের সাথে ভালো করে কথা বলতে পারে না বলে মেয়েরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে।মেয়েদের সাথে কোথাও একসাথে খেতে বসে না বলে ওকে সবাই “বাবু” ডাকে।আর এ ভাইয়া ওকে এসব কী বলছে! সে ঢোঁক গিলে বলে,” ভাইয়া,আপনার মনে হয় ভুল হচ্ছে।আমি তো কোনো মেয়েকে কোনো ছবি পাঠাইনি।” সাথে সাথে পাশের ছেলেটি বলে,”আমরা কি তবে মিথ্যা বলছি? এই ছেলে কোন পার্টি করো?” অমিত জানায় সে কোনো পার্টি করে না।
এবার বড় ভাই বলে,”আমাকে চেনো?”অমিত মাথা নেড়ে জানায় সে চেনে না।তখন পাশের ছেলেটি বলে,” তুমি বড় ভাইয়ের বোনকে ডিস্টার্ব করো না? বাজে ছবি পাঠাও না?” অমিত আবারও জোরের সাথে বলে,” না ভাইয়া,আমি কখনো কোনদিনও কোনো মেয়েকে ডিস্টার্ব করিনি,ছবিও পাঠাইনি।আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।” তখন বড় ভাইয়া বলে,”ঠিক আছে,তাহলে তোমার মোবাইল দাও,আমরা ম্যাসেন্জার চেক করবো।” অমিত অসহায়ের মতো আশেপাশে তাকায়।অনেক লোক চারপাশে,অনেকে দেখছেও কী ঘটছে,কিন্তু কেউ সামনে এগুচ্ছে না।অমিত মোবাইল বের করছে না দেখে বড় ভাই ধমক মারে,” কী হলো! মোবাইল দাও,মোবাইল না দিলে বুঝে নেবো তুমিই সেই ছেলে যে আমার বোনকে ডিস্টার্ব করে।যদি বুঝি তুমিই সেই তবে আর জান নিয়ে এখান থেকে ফিরতে পারবে না।”
নিমিষেই মায়ের কথা মনে পড়ে অমিতের। ওর কিছু হয়ে গেলে ওর মা আর বাঁচবে না।তাই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও অমিত পকেট থেকে তার অনেক সখের মোবাইলটা বের করে বড় ভাইয়ের হাতে দেয়। মোবাইলটা দিতে গিয়ে তার হাত কেঁপে ওঠে,বুকটাও কাঁপছে এক অজানা আশংকায়।তার একটা মোবাইলের সখ ছিল অনেক আগে থেকেই,কিন্তু ওর মা কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে তাকে কখনো মোবাইল ধরতে দেয়নি।এই মোবাইলটা তার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে গিফট পাওয়া টাকা আর বাকী টাকা মা দিয়ে কিনে দিয়েছিল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর।যদিও বাবা মাকে খুব বকা দিয়েছিল এরকম ফোন কিনে দেওয়াতে।যদিও খুব বেশি দামী ফোন নয়,তবুও ফোনটা তার অনেক প্রিয়।এটা সে কখনোই কাছ ছাড়া করে না।তবে খুব যে ব্যবহার করে তা না,কিন্তু পকেটে ফোনটা থাকলে তার খুব ভালো লাগে।
সেই সখের মোবাইল বড় ভাই হাতে নিয়েই আর ম্যাসেন্জারের দিকে গেলো না।বললো,” আচ্ছা, তুমি এবার চলে যাও।কোনোদিকে তাকাবে না, সোজা বাসায় চলে যাও।” অমিত হাত পেতে বলে,” আমার ফোনটা?! এক কুৎসিৎ হাসি হেসে ভাইয়া ডাক দেওয়া সেই প্রথম ছেলেটি বলে,” ওটা আর তোমার নেই,ওটা আমাদের হয়ে গেছে।এখন এখান থেকে চলে যাও।নাহলে ক্ষতি হয়ে যাবে।” বলেই “যাও “বলে এক গর্জন দেয়।অমিত বিমূঢ় হয়ে যায়।পেপারে সে এমন কাহিনী অনেক পড়েছে,তবে আজ যে এমন ঘটনা তার সাথে ঘটবে সে কখনো ভাবতেও পারেনি।কোলাহলময় রাস্তার উপরে প্রকাশ্যে এভাবে কেউ কারো সাথে এতটা অন্যায় করতে পারে অমিতের তা জানা ছিল না।
সে মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে টেম্পো স্ট্যান্ডের দিকে।আজ তার হঠাৎ করে মনে হয় তার মা তাকে ভুল শিক্ষা দিয়েছে।তার মা তাকে ছোটবেলা থেকে শুধু শিখিয়েছিল ভদ্র হতে,নম্র হতে, আর সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতে।তার মা তাকে বলতেন,” যদি তুমি কোনোদিন কারো কোনো ক্ষতি না করো,দেখবে বিধাতাও কখনো তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না।তুমি কারো সাথে অন্যায় না করলে তোমার সাথেও কেউ কখনো অন্যায় করবে না।” সে তো ছোটবেলা থেকে মায়ের প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।তাহলে ওর সাথে এমন ঘটলো কেন? অমিত হাঁটতে থাকে,মাথাটা তার নিচুই থাকে।মাথাটা আর তুলতে ইচ্ছে করে না ওর।একটা মোবাইল যেন আজ ওর মায়ের প্রতি,সমাজের প্রতি সমস্ত বিশ্বাসের ঘরটিকেই নড়বড় করে দিলো।