Site icon Shaili Tv

আত্মজা / রেজাউল করিম স্বপন

সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছেন লিখন সাহেব, হঠাৎ মোবাইলে একটা কল আসলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখেন কলটা বিদেশের অপরিচিত নাম্বার থেকে এসেছে। ফোন ধরে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে চমৎকার কন্ঠের এক মেয়ে জিজ্ঞেস করলো আপনি কি লিখন সাহেব? তিনি বললেন হ্যাঁ। মেয়েটি বললো আপনার সাথে কি একটু কথা বলা যাবে। তিনি বললেন আমি এখন একটু ব্যস্ত। আপনি এক ঘন্টা পর ফোন করলে কথা বলতে পারবো। লিখন সাহেব অফিসে গিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন, প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর আবারো একই নাম্বার থেকে ফোন আসলো। ফোন ধরে লিখন সাহেব বললেন আপনি কে, কোত্থেকে বলছেন? মেয়েটি বললো আমি মিথিলা, আমেরিকা থেকে বলছি। লিখন সাহেব বললেন এই নামে কাউকে তো আমি চিনি না। আমার কাছে কি আপনার কোন কাজ আছে বা আপনি কি আমাকে চিনেন? মেয়েটি কোন উত্তর না দিয়ে বললো, আমি আপনার সম্পর্কে একটু জানতে চাই। লিখন সাহেব বললেন কেন? মেয়েটি বললো, দেখুন আপনি বলতে না চাইলেও আমি অন্য কারো থেকে আপনার সম্পর্কে ঠিকই জেনে নিতে পারবো। তাই আমি চাই আপনিই বলুন। এবার লিখন সাহেব বললেন দেখুন এখন আপনার সাথে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবো না, আপনি বরঞ্চ রাতে ফোন করেন। ফোন রেখে লিখন সাহেব টেনশনে পড়ে গেলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগলেন মেয়েটি কে? কেনই বা আমার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে? ভেবে কোন কূল কিনারা করতে পারলেন না। সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যায় বাসায় এসে হালকা নাস্তা করে বারান্দায় বসে মেয়েটির কথা ভাবছেন, এমন সময় মেয়েটি আবার ফোন করলো। ফোন ধরে লিখন সাহেব বললেন আপনি কেন আমার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন। মিথিলা বললো, বলতে পারেন কৌতূহল থেকে। লিখন সাহেব বললেন আমার সম্পর্কে কৌতূহল কেন জানতে পারি। মিথিলা বললো, আপনাকে সব কিছু বলবো তবে তার আগে আপনার সম্পর্কে জানা দরকার।এবার লিখন সাহেব বললেন আপনি কি জানতে চান বলুন? মিথিলা বললো আপনার বাড়ী কোথায়? কি করেন? পরিবারে কে কে আছেন, আপনার সন্তান কয়জন ইত্যাদি। ঘন্টা খানেক মিথিলার প্রায় সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে লিখন সাহেব বললেন, আজ আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রাখি বলে ফোন রেখে লিখন সাহেবের মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। মেয়েটি কে? কেনই বা এতো বার ওনাকে ফোন করছে এবং ওনার নাম্বারই বা কোথা থেকে পেল। ভাবতে ভাবতে লিখন সাহেবের মনে হলো মেয়েটি ওনার সম্পর্কে সব তথ্য আগে থেকে জেনে তারপর ফোন করে নিশ্চিত হচ্ছে। আবার মনে হলো ওনার সব তথ্য জেনে মেয়েটি না আবার ওনাকে কোন বিপদে ফেলে। রাতে খেয়ে ঘুমাতে গিয়ে দেখেন ঘুম আসছে না, শুধু মেয়েটি কথা মনে পড়ছে। পরের দিন মেয়েটি আবারো ফোন করলে লিখন সাহেব মেয়েটির সম্পর্কে জানতে চান। মিথিলা বললো,এখন কিছু বলবো না তবে সামনা সামনি দেখা হলে সব কিছু বলবো। এ কথা শুনার পর লিখন সাহেব ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। দু’দিন পর মেয়েটি আবার ফোন করে জানালো আগামী সপ্তাহে সে দেশে আসবে এবং ওনার সাথে দেখা করবে। হঠাৎ তার দেশে আসার খবর শুনে লিখন সাহেব আরো বেশী চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভেবে কূল পাচ্ছেন না কি এমন বিষয় আছে যেটা বলার জন্য মিথিলা দেশে আসছে। আবার ওনার ভয়ও লাগছে, না জানি ওনার জীবনের কোন গোপন বিষয় নিয়ে মেয়েটি ওনাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। সপ্তাহ খানেক পর একদিন দুপুরে লিখন সাহেবকে ফোন করে মেয়েটি বললো সে দেশে এসেছে। সন্ধ্যায় যেন তিনি তার সাথে দেখা করতে স্থানীয় হোটেলে যান।এটা শুনার পর লিখন সাহেব সারাদিন খুব অস্বস্তি অনুভব করলেন টেনশন ও ভয়ে। তবুও তাড়াতাড়ি বাসায় এসে একটু রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যার পর যথারীতি হোটেলে গিয়ে তাকে ফোন করলে মিথিলা বলে লবিতে বসতে। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি এসে সালাম দিয়ে ওনার সামনে বসে। ভালভাবে খেয়াল করে দেখলেন মেয়েটি দেখতে বেশ চমৎকার, পোশাক আশাকে বেশ পরিপাটি ও রুচিশীল। তবে মুখে মাস্ক পরায় চেহারা পুরাপুরি বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটি কয়েক মিনিট ওনাকে ভাল করে দেখে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছেন? তিনি বললেন ভালো। লিখন সাহেবও জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছো? সে বললো আছি কোন রকম। এবার লিখন সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করলেন সুদূর আমেরিকা থেকে সে কেন দেশে এসেছে। মিথিলা বললো আপনার সাথে দেখা করতে। লিখন সাহেব আশ্চর্য হয়ে বললেন শুধু আমার সাথে দেখা করতে এসেছো? ও বললো হ্যাঁ। দুয়েকটা কথা বলার পর মিথিলা লিখন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা আপনি কি মিতা নামে কাউকে চিনেন? লিখন সাহেব বললো কোন মিতা? এবার মেয়েটি বললো আপনি কি কোন মিতাকেই চিনেন না বা চিনতেন না। হঠাৎ করে মিতার কথা জিজ্ঞেস করায় লিখন সাহেবের মাথায় পুরা আকাশ ভেঙে পড়লো। তিনি অপ্রস্তুত হয়ে খানিকটা নার্ভাস হয়ে বললেন তুমি মিতাকে কিভাবে চিনো। মিথিলা বললো আপনি চিনেন কিনা সেটা আগে বলেন। লিখন সাহেব বললেন সে অনেক দিন আগের কথা।এটি আমার জীবনের এক অপ্রকাশিত ও দুঃখজনক অধ্যায়। যেটির দুঃসহ স্মৃতি আমি এখনো বহন করে চলেছি তবে সেটা কেউ জানে না। কেউ কখনো জানতেও চায় নাই। মিথিলা বললো আপনি কি মিতার বিষয়টা আমাকে একটু খুলে বলবেন। লিখন সাহেব বললো ওর কথা শুনে তোমার কি লাভ। মিথিলা বললো লাভ লোকসান বুঝি না তবে আমি তাঁর বিষয়টা আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। এবার লিখন সাহেব বললেন মিতা এখন কোথায়? মেয়েটি বললো আপনাকে সব বলবো। আগে বলুন তাঁর সাথে আপনার কি সম্পর্ক ছিলো। লিখন সাহেব বললেন তাহলে শোনো, মিতার মেঝ ভাই ছিলো আমার ক্লাসমেট ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আমরা একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। আমি ছিলাম গণিত বিভাগের ছাত্র আর ওর ভাই ছিলো অন্য সাবজেক্টে। মিতারা দুই ভাই এক বোন। মিতা ছিলো সবার ছোট ও খুব আদরের। ও আমাদের তিন বছরের জুনিয়র ছিলো। তখন সে এইচ এস সি পরীক্ষার্থী। আমি থাকতাম আমার ভাইয়ের বাসায়। মিতার বাবা ছিলো সরকারের প্রভাবশালী একজন আমলা ও অনেক ক্ষমতাবান। আমি সবসময় ওদের বাসায় যেতাম। তাঁরা আমাকে ছেলের মত আদর করতেন। তাঁদের সাথে আমাদের একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরী হয়। দুই পরিবারের মধ্যে বেশ যাতায়াত ছিলো। তাঁদের আত্মীয় স্বজনের সাথেও আমার খুব সুসম্পর্ক ছিলো। একদিন মিতার মা আমাকে বললেন মিতাকে প্রাইভেট পড়াতে। আমি প্রথমে রাজি হই নি, পরে ওনার পীড়াপীড়িতে রাজি হই। পড়াতে গিয়েই মিতার সাথে আমার সম্পর্ক তৈরী হয়।এইচএসসি পাস করে সে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে সম্পর্ক আরো গভীর হয়।এদিকে আমি ও তার ভাই মাস্টার্স পাস করে বের হই। হন্যে হয়ে চাকুরী খুঁজছি। মিতা তখন অনার্সের ছাত্রী। প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে আমার সাথে দেখা করতো এবং আমরা একসাথে সময় কাটাতাম,এদিক ওদিক ঘুরতাম।এতে করে সম্পর্ক আরো গভীর হতে গভীরতর হলো।এরি মধ্যে মিতা অনার্স পরীক্ষা দিলো। ঐদিকে ওদের পরিবারে জানাজানি হয়ে যায় যে, আমার সাথে মিতার গভীর প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। মিতাকে ওর মা ও খালারা বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞেস করলে সে সব স্বীকার করে। এতে করে ওদের পরিবারে অশান্তি শুরু হয়। সবাই ওর মাকে দোষারোপ করে। বিষয়টি ওর বাবার কানে যাওয়ায় ওর বাবা ওকে ডেকে খুব বকাবকি করে এবং আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলে। কিন্তু সে আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে বলে পরিবারে জানিয়ে দেয়। কিছু দিন পর হঠাৎ মিতা আমাকে বলে বিয়ে করতে। প্রথমে এটা সেটা ও আমার বেকার অবস্থার কথা বলে সময় নিতে চাইলাম। কিন্তু মিতা ছিলো নাছোড়বান্দা ও প্রচন্ড জেদী। যেটা বলতো সেটার থেকে এক চুলও নড়তো না। তবুও আমি কিছু অজুহাত দেখিয়ে সময় নিই। কয়েকদিন পর একদিন সে আমাকে বললো আজ আমরা বিয়ে করবো, নাহলে আজ রাতে আমি সুইসাইড করবো এবং সুইসাইড নোটে লিখবো আমার সুইসাইডের একমাত্র কারণ তুমি। আমি পড়লাম মহা সমস্যায়।একে তো বেকার, থাকি ভাইয়ের বাসায়। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওকে বললাম আমাকে একটা দিন সময় দিতে, অনেক বুঝিয়ে একদিনের জন্য রাজি করালাম। ওকে বিদায় দিয়ে কয়েকজন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ চাইলাম। বিস্তারিত শুনে বন্ধুরাও বিয়ের পক্ষে মতামত দিলে ঐ দিনই সবকিছু ঠিকঠাক করে পর দিন কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে যে যার বাসায় চলে গেলাম। সপ্তাহ খানেক পর আমার বড়ভাই আমাকে ডেকে মিতার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে আমি ওর সাথে সম্পর্ক আছে বলে বললাম। এতে তিনি খুব ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে প্রচুর বকাঝকা করেন এবং মিতার সাথে সম্পর্ক না রাখার জন্য বলেন। তিনি আরো বলেন ওর সাথে সম্পর্ক রাখলে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে। ঐ রাতে সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। পর দিন মিতার সাথে দেখা হলে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলাম। কিন্তু কি করবো সেটাও ভেবে উঠতে পারছিলাম না। তিন চার দিন পর ভাবী এসে বললো বড়ভাই বলেছেন আমাকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে। এটা শুনে মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো, কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অনেক ভেবে চিন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে একটা হলের লন্ড্রি ম্যানের রুম ভাড়া নিয়ে ওখানে উঠে গেলাম। এরি মধ্যে টিউশনি করে কিছু আয় করতাম আর মিতাও মাঝে মধ্যে কিছু টাকা দিতো,এতে কোন রকমে চলতাম। প্রতিদিন মিতা ক্লাস শেষ করে আমার রুমে চলে আসতো একসাথে খাওয়া দাওয়া করে ২-৩ ঘন্টা থেকে সে আবার বাসায় চলে যেত। এই যে সে প্রতিদিন আমার রুমে এসে সময় কাটাতো সেটা আস্তে আস্তে ওর পরিবারের সবাই জেনে যায়। একদিন তাকে তার বাবা আলটিমেটাম দেন আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে, না হয় আমার ক্ষতি করবে বলে হুমকি দেন। তবুও সে আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে বলে পরিবারে জানিয়ে দেয় ও আমাদের যে কোর্টে বিয়ে হয়েছে সেটাও বলে দেয়। এর কয়েকদিন পর একদিন বিকালে আমার রুমে চুরি হয়। বাহির থেকে এসে দেখি ঘরের সব জিনিসপত্র তছনছ করা কিন্তু কোন কিছুই খোয়া যায় নি, শুধু বিয়ের ডক্যুমেন্ট ছাড়া। বুঝলাম এটা মিতার পরিবারের কাজ। পরদিন মিতা আসলে তাকে ঘটনা বললে সে মাথা গরম করে বাসায় চলে যায়। এরপর থেকে ওর সাথে আমার আর কোন যোগাযোগ হয় নি।
এবার মিথিলা বলে আপনি কি তাঁর সাথে যোগাযোগের কোন চেষ্টা করেছিলেন? আমি বললাম এর পরে আমি ওদের বাসার দারোয়ান, ড্রাইভার ও বুয়ার মাধ্যমে খবর নিতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেউ ওর সঠিক সন্ধান দিতে পারে নি।ওরা শুধু বলেছিলো ঐ দিন মিতা বাসায় গিয়ে খুব চেঁচামেচি করেছিলো এবং আমার কিছু হলে সুইসাইড করবে বলে ধমক দিয়েছিলো।এরপরে আমি ওর খালা ও মামাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম তাঁরা আমাকে মিতাকে ভুলে যেতে বলেছিলেন। ওর যত আত্মীয় স্বজন ছিলো সবার বাসায় গিয়েছি সবার একটাই কথা ওকে ভুলে যেতে। প্রায় বছর খানেক পর শুনেছিলাম ও আমেরিকায় চলে গেছে। এরপর আর কোন খবর পাইনি।
এবার লিখন সাহেব মিথিলাকে বললেন আমার জীবনের এই কাহিনী শুনে তোমার কি লাভ। তখন সে একটা চিরকুট বের করে লিখন সাহেবের হাতে দেয়।যাতে লেখা রয়েছে :

মা মিথিলা,
আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তোকে একটা চরম সত্য জানাতে চাই।এটি না জানালে আমি মরেও শান্তি পাব না। সেটি হলো এতোদিন তুই যাকে বাবা বলে জানিস আসলে সে তোর বাবা নয়। তোর আসল বাবা হলো লিখন, যে কিনা তোর মেঝ মামার বন্ধু। পারলে তাকে খুঁজে বের করে বলিস, তুই তার মেয়ে!

এটা পড়ে লিখন সাহেবের চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে লাগলো। তবুও নিজেকে সামলে তিনি বললেন এটা অসম্ভব কারণ মিতা কনসেভ করলে আমি তো সবার আগে জানতাম। লিখন সাহেবের কান্না দেখে মিথিলাও আবেগপ্রবণ হয়ে বললো আমিও প্রথমে বিশ্বাস করি নি। মায়ের মৃত্যুর প্রায় ১০ দিন পর মায়ের ডেস্ক পরিস্কার করতে গিয়ে চিঠিটি পেয়ে আমি নিজেও থ বনে গিয়েছিলাম। চিঠিটি পড়ে আমি নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, বাসায় থেকে সারাদিন কেঁদেছি। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের কথা ভেবে সত্য সন্ধানে নেমে পড়লাম। তারপর আমি মেঝ মামার বাসায় গিয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রথমে সব অস্বীকার করেন কিন্তু মায়ের হাতে লেখা চিঠিটি দেখালে তিনি সব স্বীকার করেন। আমি মামাকে বললাম মায়ের সাথে কিভাবে আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হলো- সেটা জানাতে। তখন মামা বললেন আপনার বাসা চুরি হওয়ার পরদিন মা বাসায় খুব রাগারাগি করেন এবং আপনার কিছু হলে সুইসাইড করবেন বলে জানান। পরদিন সকালে মাকে জোর করে নিয়ে তাঁর বাবা মা খুলনায় তাঁর খালার বাসায় চলে যান। ওখানে যাওয়ার পর মা রাগ করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়। দুই দিন কিছু না খাওয়ায় মা অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়ে। তারপর মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার ঔষধ দিলেও হঠাৎ তাঁর বমি বমি ভাব ও অরুচি দেখা দেয়। আবারো ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি ওতুধ বদলিয়ে দেন কিন্তু মায়ের উপসর্গ দূর হয় না। পরে আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার প্রেগন্যান্সি টেস্ট করলে জানা যায় তিনি কনসেভ করেছেন। এটা শোনার পর মায়ের বাবা মা তাঁর বাচ্চাকে এভোসান করে নষ্ট করার জন্য প্রচন্ড চাপ দেন। মা কিছুতেই এভোসন করতে রাজি হননি। ওদিকে মা আপনার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু তখন মোবাইল বা ঐ বাসায় ল্যান্ড ফোন না থাকায় কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। ৩-৪ দিন পর ওনার বাবা ওনাকে দুইটি প্রস্তাব দেয় যার একটি ওনাকে করতে হবে বলে জানান। না হয় ওনি আপনাকে গুম বা মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেন। প্রস্তাব দু’টি ছিলো, হয় এভোসন করে বাচ্চা নষ্ট করতে হবে, না হয় ওনাকে ঐ অবস্থায় দেশ ছেড়ে আমেরিকায় মেঝ মামার কাছে চলে যেতে হবে। একদিকে আমার অস্তিত্ব অন্যদিকে দেশ ত্যাগ মানে আপনাকে ত্যাগ-এই দুটোর মধ্যে উনি আমার অস্বস্তিকে প্রাধান্য দিয়ে দেশ ত্যাগে রাজি হন। মাস খানিকের মধ্যে মা আমেরিকায় চলে যান। আমেরিকায় যাওয়ার ৫ মাস পর আমার জন্ম হয়। আমার জন্মের আরো দেড় বছর পর মামার এক বন্ধুর সাথে মায়ের আবার বিয়ে হয়, যদিও মা ঐ বিয়েতে রাজি ছিলেন না। শুধু আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিলেন। এসব কথা বলতে বলতে মামাও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে ছিলেন। মামা আরো বলেছিলেন, মা রে আমি তোর মাকে ওয়াদা করেছিলাম এই ঘটনা কখনো কাউকে বলবো না।কিন্তু আজ আর সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারলাম না।একথা বলে মামাও খুব কেঁদেছিলেন।
এতটুকু বলে মিথিলা লিখন সাহেবের দিকে তাকালেন। দেখলেন লিখন সাহেবের জামা চোখের পানিতে ভিজে একাকার। এবার লিখন সাহেব বললেন ভেবে দেখ মা আমি কত হতভাগা একজন মানুষ যার কিনা এতোবড় ও চমৎকার একটি সন্তান রয়েছে কিন্তু তা আমার অজান্তে।এতো দুর্ভাগা মানুষ কি দুনিয়াতে আর আছে। এবার মিথিলা বললো প্রথম মায়ের চিরকুটটা পেয়ে ভেবেছিলাম আপনাকে যেখানে পাব অপমান অপদস্ত করবো। কিন্তু মেঝ মামার কথা শোনার পর থেকে ভেবে দেখলাম আপনাদের জীবনের এই ঝড়ে আপনি বা মায়ের কোন হাত ছিলো না। আপনারা পরিস্থিতির শিকার।এই কথা বলে মিথিলা চেয়ার থেকে উঠে এসে লিখন সাহেবের পিঠে হাত দেয়। লিখন সাহেবও চেয়ার থেকে উঠে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা রে আমি একজন অপদার্থ মানুষ যে কিনা জীবনে তার ভালবাসার মানুষকে ধরে রাখতে পারিনি। এতো লক্ষ্মী একটা মেয়ে আছে সেটাও জানতাম না। এসব কথা বলে লিখন সাহেব বলেন, এই ব্যর্থ জীবন রেখে আর কি হবে বল!

Exit mobile version