দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। সূর্যের আলোর লাল ছটা প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। একটু আগে বেলি চোখ মুছতে মুছতে বিদায় নিয়ে চলে গেল। হৃদপিন্ড যেন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। কোন শব্দ কানে আসছে না। চারিদিক মনে হয় ঘুরছে। সারা প্রকৃতি যেন হঠাৎ করে শব্দ বন্ধ করে দিয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সমস্ত ইমিগ্রেশান শেষ করে পলাশ আর কল্পনা এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি। কিছুক্ষণ পরপর টিস্যু দিয়ে চোখ মুছছে।

পলাশ কল্পনাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে। চোখের পানি গোপন করে বললো ,’’চলো বিমান ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। ‘চারিদিকে প্রচুর বাংলাদেশি , দেশে ফেরার অপেক্ষায়। বাংলাদেশ থেকে এত লোক থাইল্যান্ড ভ্রমণে আসে, সেটা আগে কোনদিন খেয়াল করেনি পলাশ। সবাই থাইল্যান্ডের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসে, তা কিন্তু না। কেউ আসে ব্যবসার কাজে আবার কেউ কেউ চিকিৎসার জন্যও আসে। পলাশ ব্যবসার কাজে প্রায়ই থাইল্যান্ডে এলেও স্ত্রী কল্পনাকে নিয়ে এবারই প্রথম।
কয়েকদিন থেকে কল্পনার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তাই পলাশ কয়েকদিন আগে কল্পনাকে নিয়ে ব্যাংকক আসে। উদ্দেশ্য ব্যাংকক শহরের পর্যটন কেন্দ্রগুলো কল্পনাকে নিয়ে ঘুরবে আর বামুনগ্রাদ হাসপাতালে কল্পনাকে ডাক্তারও দেখাবে। মানে এক ঢিলে দুই পাখি মারা।হাসপাতালের কাছেই একটি হোটেলে তারা রুম ভাড়া করে উঠেছে। যাতে যাওয়া আসার সুবিধা হয়। পরদিন হাসপাতালে সব পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেল কল্পনার রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেছে। এর মধ্যে হিমোগ্লোবিন এতটাই কমে যাওয়ায় ডাক্তার অতি দ্রুত রক্ত দিতে বললেন । হাসপাতালে এ মুহূর্তে কল্পনার নেগেটিভ গ্রপের রক্ত নেই। সংগ্রহ করতে সময় লাগবে অন্তত দুই চার দিন। পলাশ চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো। কারণ নেগেটিভ গ্রপের রক্ত যোগাড় করা ভীষণ কষ্টের। দেশে আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কাছে হয়তো পাওয়া যেত । ফোন করে রক্ত যোগাড় করা কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু এখানে বিদেশ বিভুইয়ে সবাই অচেনা , সহজে কারো কাছ থেকে রক্ত যোগাড় করা কষ্টসাধ্য ।সময়টা বৃষ্টিমুখর । বাইরে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে । হসপিটাল করিডোরে কিছু লোক দুশ্চিন্তায় পায়চারি করছে। কল্পনা হাসপাতালের বেডে শুয়ে স্বামীর হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, ‘তুমি এত চিন্তা করছো কেন ? এত বড় হাসপাতাল , তারা কোন না কোন ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবে। বামুনগ্রাথ হাসপাতালের বাঙালি এটেনডেন্স যারা আছেন তারাতো সাধ্যমত চেষ্টা করছেন , উপায় একটা হবেই।‘বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর যাবত বাঙালি এটেনডেন্স হিসেবে চাকরি করছেন রুচি আপা। বাংলাদেশি রোগীদের কাছে উনি খুবই জনপ্রিয়। ব্যাংককের সব কিছু উনার নখদর্পনে। একটু আগে উনিও আশ্বস্ত করে গেছেন , রক্ত তারা ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন।পলাশ অস্থিরভাবে হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারী করছে। স্ত্রী কল্পনা ছাড়া তার আর কেউ নেই। প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে তাকে । দাঁড়িয়ে শুধু দেখছে কত দেশ থেকে রোগী এসেছে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। মানুষ কত কষ্ট করছে। যে সমস্ত দেশের রোগী বেশি সে সমস্ত দেশের রোগীদের ভাষাগত অসুবিধা দূর করার জন্য তাদের দেশের নতুন পাস করা ডাক্তাদের এটেনডেন্স হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রেখেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাঁটতে হাঁটতে বাঙালি এটেনডেন্স রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিতর থেকে একজনের ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা কথায় পলাশের চিন্তায় ছেদ পড়েছে। রুমের ভেতরে ঢুকে পলাশ চেয়ার টেনে বসল। মেয়েটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় যা বললো তার সারমর্ম হচ্ছে , সে শুনেছে বাংলাদেশি এক রোগীর এ বি নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন। তার রক্তের গ্রুপ এ বি নেগেটিভ । তাই সে রক্ত দিতে এসেছে। মেয়েটিকে দেখার পর থেকে পলাশের বুকের ভেতর কেমন যেন করছে। মনে হচ্ছে যেন মেয়েটি তার অনেকদিনের চেনা !

নিজের সন্তান সমতুল্য মেয়েটিকে সে বললো, ‘মা , তোমাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।‘মেয়েটি বললো, ‘এটা আমার দায়িত্ব । কৃতজ্ঞতার কিছুই নেই।‘এরপর বেশ কয়েকবার মেয়েটি হাসপাতালে এসেছে। রক্ত দেওয়ার পরও নিয়মিত দেখতে আসত কল্পনাকে।কী অদ্ভুত এক মায়া ! বিদেশি এই মেয়েটিকে দেখলেই কল্পনা ছাড়তে চায় না।‘মা তুমি কোথায় থাক? কি কর? কি নাম তোমার ? বাংলা ভাষা কিভাবে শিখলে? – এরকম হাজার প্রশ্নে মেয়েটি কোনরকম বিরক্তি না হয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।
‘আমার নাম বেলী ‘

‘তোমরা কয় ভাইবোন,?’ কল্পনা জিজ্ঞেস করে।

‘আমি মা বাবার একমাত্র সন্তান।‘ মেয়েটি উত্তরে বলে ।

‘তুমি বাংলা ভাষা কিভাবে শিখলে? তোমার মা বাবা কেউ কি বাঙালি?’

বেলি , না। তবে
তবে কি? পলাশ জানতে চায়।
‘আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ।’
পলাশ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো , ‘তাহলে তুমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশি!’
‘হ্যাঁ , হিসেবমতে তাই।’
আমার দুই বৎসর বয়সে মা বাবা আমাকে বাংলাদেশ থেকে দত্তক নিয়েছে।
‘কখন নিয়েছে?’ পলাশ চমকে গিয়ে কল্পনার দিকে তাকায়। কল্পনাও বেলীর কথায় উদগ্রীব হয়ে ওঠে ।
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, ১৯৭১ সালে’, বেলী বলে ।
‘তোমার আসল মা বাবা? ‘আচ্ছা কোথায় পেলেন তোমাকে,তোমার বাবা ?’ কল্পনা জানতে চায় ।
করুণ কণ্ঠস্বরে বেলী বলে , ‘আমি দুইবার বাংলাদেশে গিয়েছি, আমার জন্মদাতা মা বাবার খোঁজে। কোন সন্ধান পাইনি। আমার দত্তক বাবা একজন সাংবাদিক ছিলেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় সংবাদ কভারেজ করার জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। আমাকে নাকি কোন এক পথের ধারে কুঁড়িয়ে পেয়েছিলেন। উনি মারা যাওয়ার পর থেকে আমি আমার জন্মদাতা মা বাবাকে খুঁজছি প্রতিনিয়ত। বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের পাশেই আমার অফিস। সে সুবাদে এখানকার বাঙালি এটেনডেন্সদের সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব আছে। ওদের কাছ থেকেই আমি কিছু কিছু বাংলা ভাষাও আয়ত্ত করেছি। ‘

বেলী আরও বলে , ‘বাংলাদেশে জায়গাটার নাম বাবুইপাড়া। নিভৃত পল্লী। আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। কিন্তু আমি ওখানে গিয়ে ওরকম কোন পরিবার খুঁজে পাইনি। যারা তাদের বাচ্চা হারিয়েছে। ওখানকার পুলিশ, পাড়া, প্রতিবেশী কেউ এরকম কোন শিশুর খোঁজ জানে না। ‘
অবাক বিস্ময়ে পলাশ আর কল্পনা ওর কথা শুনছে আর ঘামছে, কি বলছে এই মেয়ে!
রাতে দুজনের মুখে কোন কথা নেই । বুকের ভেতর তোলপাড়। সারারাত কারও চোখে ঘুম নেই । ভাবনার মাঝেই সকাল হয়ে যায়। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। একটু পর কল্পনাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হবে।

মনে পড়ে গেল সেই রাতের কথা । সেই বিভীষিকাময় রাত । পলাশ মুক্তিযুদ্ধে চলে যাবার পরের রাতের কথা। রাস্তাঘাটে জনমানবশূন্য থমথমে রাত। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ঘরে একা কল্পনা । আগের দিন ওদের পাড়ার কুখ্যাত রাজাকার এবং পাকিস্তানি বাহিনী এসে হুমকি দিয়ে গেছে।
‘ তোর জামাইকে বলবি আমাদের সাথে হাত মেলাতে। নাহয় কপালে দুঃখ আছে।‘

কল্পনা মাষ্টারের মেয়ে। সবসময় সৎ ও ন্যায়ের পথে থাকার শিক্ষা সে বাবা মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে।

ক্ষিপ্ত স্বরে মুখের উপর বলে দিল, ‘মরে যাবো, তবুও তোদের দলে যেতে দেবো না আমার জামাইকে। থুতু মারি তোদের মুখে।‘

‘মেয়ে মানুষের এত দেমাগ ভালো না ‘ সেই রাজাকার বলে ।

‘আমার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে গেছে , এজন্য আমি গর্বিত। কাউকে আমি ভয় করি না।‘

‘এত বড় স্পর্ধা! তোকে আমি দেখে নেবো । তোর মেয়েকে কার কাছে রাখবি ঠিক করে রাখিস।‘

রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল কল্পনার । বলল,,’আমার মেয়ের কথা তোকে চিন্তা করতে হবে না।‘

সেদিন রাত্রেই সেই কুলাঙ্গার দলবল নিয়ে পলাশদের বাড়ি আক্রমণ করে , তুলে নিয়ে যায় কল্পনাকে। কী দুঃসহ সেই স্মৃতি!

দুই বছরের মেয়ের বুক ফাটা কান্না !

এতদিন যে ব্যথা চুপচাপ বুকে আগলে রেখেছে আজ তা অশ্রু ধারা হয়ে ঝরছে অবিরত। বেলীকে পেয়ে যেন বেদনার সাগরে এক অজানা আনন্দ সাঁতরে চলেছে ।

কল্পনাকে ধরে বিমানে উঠে বসাল পলাশ। বিমান উড়ছে , দ্রুতবেগে। । আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যায় সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট, অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আশেপাশের সুদৃশ্য কারুকাজ করা বাহারি রঙের বাড়ির ছাদ। কিন্তু পলাশ আর কল্পনার জীবনে দুঃখকে ছাপিয়ে আলো যেন আনন্দের অংশ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো ।

 

(গল্পের প্রত্যেকটি চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক। এর সাথে বাস্তবের কারও সাথে কোন সম্পর্ক নেই।)