রাস্তাটা এঁকে বেঁকে একা একা চলে
দু’পাশে বৃক্ষ আছে নিজের দখলে।
পাখিরাও গান গায় গাছের শাখায়
ছুটিমাখা সকালের রোদ আসে গায়।
শহরের কোলাহল হৈ চৈ ফেলে
ছায়া দেখে মায়া দেখে উত্তরে গেলে
মাটির গন্ধ পাই, যাই পায়ে পায়
কিছুটা টেম্পো করে, কিছু রিকশায়।
যে দিকে তাকাই আমি সবুজে সবুজ
কিছুটা ব্যাকুল হই, কিছুটা অবুঝ
একটু এগোলে দেখি ছোটখাটো নদী
মন চায় ঘুরি পাই নৌকাটি যদি।
ছকে বাঁধা সেতু নেই, নেই কোনো ফেরি
চা-বাগানে হাত নাড়ে আমিন কাদেরী।
ছবির দেশটা যেন কবিতারই দেশ
চারদিকে খুঁজে পাই মমতার রেশ।
যাই যাই একা আর দল বেঁধে যাই
হাতছানি দিয়ে ডাকে প্রিয় কাপ্তাই।
আমার এ কবিতাটি ‘ছুটিমাখা সকালে’ গ্রন্থের প্রথম কবিতা। কাপ্তাইয়ে ওয়াগ্গাছড়া চা বাগানের অপরূপ পরিবেশে আমি বহুবার গিয়েছি যাঁর আমন্ত্রণে, তিনি হলেন আমিনুর রশীদ কাদেরী। তিনি একজন খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক। দৈনিক আজাদী, দৈনিক পূর্বকোণসহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখেন। চা গবেষক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। পরিবেশ-প্রতিবেশ, পার্বত্যাঞ্চলের সম্ভাবনা, চা শিল্প, দারিদ্র্য বিমোচন ও সমকালীন বিশ্বের চলমান ঘটনাবলি নিয়ে তিনি নিয়মিত লিখে থাকেন। এ পর্যন্ত অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : দুটি পাতা একটি কুঁড়ি, দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস, জগৎজুড়ে, মাটির টানে, চা দেশে দেশে, সমকালীন বিশ্ব ও অর্থনৈতিক কূটনীতি, ক্যামেলিয়ার সবুজ রাজ্যে প্রভৃতি। তাঁর ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ গ্রন্থ প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে।
১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে নানা জায়গায় কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। বর্তমানে ওয়াগ্গাছড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চা শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি গবেষণায় রত সবসময়।
সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে চা শিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি তাঁর প্রবন্ধে বলেন, ৪ঠা জুন। চা শিল্পের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রাদেশিক বাণিজ্য শ্রম ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের স্মারক নং-৩৩৫/৯১৩/৫৬ সিপি তারিখ ৪ জুন, ১৯৫৭ খ্রিঃ মূলে বঙ্গবন্ধুকে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে মনোনীত করা হয়। তিনি ৪ জুন, ১৯৫৭ খ্রিঃ থেকে ২৩ অক্টোবর, ১৯৫৮ খ্রিঃ পর্যন্ত চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রবন্ধে তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন চা শ্রমিকদের নিকট একজন প্রাণ প্রিয় ব্যক্তিত্ব। এদেশের চা শ্রমিকরা ছিল অবহেলিত, বঞ্চিত। তিনি লক্ষ করলেন, এদের কোন ভোটাধিকার নেই। এটি তাঁর মনে খুবই কষ্ট দেয়। তিনিই ১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে প্রথম ভোটাধিকার প্রদান করার মাধ্যমে চা শ্রমিকদের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। তিনি চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার বিষয়ে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। প্রতিটি বাগানে বাধ্যতামূলকভাবে চিকিৎসাকেন্দ্রে স্থাপন, চিকিৎসক নিয়োগ, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন এর সুবিধা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাইতো চা শ্রমিকরা আজও তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধার সঙ্গে এবং হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে আপন করে। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন অনেক চা বাগানের স্বত্বাধিকারী, প্লান্টার্স, ম্যানেজার, এমন কি চা শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। ফলে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চা বাগানের স্বত্বাধিকারী, ম্যানেজার ও চা শ্রমিকগণ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভবে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে ই.পি.আর এবং মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগত কারণে বিভিন্ন চা বাগানে আশ্রয় নেয়। চা বাগান শ্রমিকরা পাকিস্তান বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। নিজেদের পারিবারিক নিরাপত্তা ও আর্থিক অসচ্ছলতা সত্ত্বেও ই.পি.আর সদস্য এবং মুক্তিবাহিনীর আশ্রয় পানাহাররের ব্যবস্থা করার মত দুঃসাহসিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এতে প্রতিশোধ সপৃহায় উন্মত্ত পাক সেনারা চা শ্রমিকদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন ও বর্বরোচিত আচরণ করে। বোমা মেরে আগুন জ্বালিয়ে শ্রমিকদের আবাসিক কলোনী, কারখানা, বাংলো, অফিস ও বাগানের আবাদি এলাকা ধ্বংস করে দেয়। চা গাছের সবুজ কুঁড়ি আগুনে ঝলসে যায়। শ্রমিকদের অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। বাঙালি ম্যানেজার, কর্মকর্তা বন্দি হয়ে নির্যাতনের শিকার হন। চোখের সামনে আত্মীয় পরিজনদের অপহরণ লুটপাট ও বেয়নেটের আঘাতে আঘাতে রক্তপাতে মানুষের হাহাকারে ক্য্যামেলিয়ার সবুজ রাজ্য শ্মশানে পরিণত হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হয়। মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া ক্ষত বিক্ষত মানুষেরা আবারো থমকে দাঁড়ায়। ঝলসে যাওয়া পুড়ে যাওয়া শতবর্ষজীবী ক্য্যামেলিয়ার বুকে আবারো নতুন কুঁড়ি গজায়।
এসব অজানা তথ্য আমরা পাই তাঁর প্রবন্ধ-পাঠে।
আমিনুর রশীদ কাদেরী একজন বড় সংগঠকও। তিনি চট্টগ্রাম একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক। অনেকগুলো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত অমায়িক, পরিশ্রমী, বন্ধুবৎসল ও পরোপকারী মানুষ।