পাড়া গাঁ। গভীর রাত। বাইরে চারিদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। কোথাও পাতা নড়ার শব্দও নেই। যেন সম্পূর্ণ প্রকৃতি ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ আর্তচিৎকার, মার শালারে ! সাথে সাথে কান্নাকাটির আওয়াজ। ঘুম ভেঙে যায় কনার। ঘটনাটা অনেক দিনের। তখন ওর বয়স আর কত ১১, ১২ হবে হয়তো। সারাদিন পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে মাকে লুকিয়ে গল্প উপন্যাস পড়ত। প্রেম ভালোবাসা তখন তার কাছে গল্প উপন্যাসের চরিত্র ছাড়া কিছুই নয়।
তখন দেশে পাবলিক পরীক্ষায় নকলের মহোৎসব ছিল। বিশেষ করে গ্রামের বড় বড় পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে। শহরের নামকরা কলেজগুলো থেকে কিছু কিছু ছাত্র ভালো রেজাল্টের আশায় এসমস্ত কলেজগুলোতে পরীক্ষা দিতে আসত। কনাদের বাড়ির একমাইল দূরত্বে এরকম একটা কলেজ কেন্দ্র। এইচ এস সি পরীক্ষার সময় ওদের গ্রামে একটা উৎসব উৎসব ভাব। কারণ অনেকের বাড়িতে তখন অতিথি হিসেবে আসত এইসব পরীক্ষার্থী। কনাদের পুকুরঘাটে স্নান করতে আসলেই জানা যেত উনি কার ঘরের মেহমান।
আওয়াজটা মনে হচ্ছে ওদের ঘরের একদম কাছেই। চাপা অথচ স্পষ্ট নারী কন্ঠে কান্না। কনাসহ ঘরের সবাই জেগে উঠানে বের হয়ে আসলো। চারিদিকে বিদ্যুতের আলোয় মানুষজনের দৌড়াদৌড়ি ও দেখা যাচ্ছে।
কনার মা প্রভাবতী ধনী এবং অভিজাত পরিবারের বৌ। ভীষণ সাহসী এবং পরোপকারী। বললেন, তোরা ঘরে থাক আমি দেখে আসি। আমার মনে হয় অপরাজিতাদের বাড়িতে কোন সমস্যা হয়েছে। ওর কান্না শোনা যাচ্ছে।
মা উনিতো শহরে, কনা বলে।
প্রভাবতী বলেন, না, ও কাল এসেছে একজন পরীক্ষার্থী নিয়ে। আমার সাথে দেখা করে গেছে।
গ্রামে তখন একটা রেওয়াজ ছিল, যেসমস্ত ছেলেমেয়ে শহরে থাকে তারা গ্রামে আসলে পাড়ার বড়দের নমস্কার করে যেত। প্রতিবেশি কাকিমা জেঠিমারা ও আশীর্বাদের সাথে সাথে ঘরে বানানো মোয়া নাড়ু যার ঘরে যেটা, হাতে তুলে দিতেন। এ যেন এক অবিচ্ছেদ্য মায়া, ভালোবাসা প্রতিবেশির সাথে প্রতিবেশির। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও গ্রামের সবার সাথে সবার সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়ে ও বেশি।
যাহোক, এত রাতে প্রভাবতি অপরাজিতাদের বাড়িতে চলে গেলেন। মার পিছু পিছু কনাও ওদের বাড়িতে হাজির হল।
কনা দেখে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ওদের গ্রামের সবার প্রিয় অভিলাষ দাদাকে হাত পা বেঁধে নির্মম ভাবে মারছে অপরাজিতাদের বাড়ির নারী পুরুষ সবাই মিলে। অপরাজিতাদের বাড়িটা অনেক বড়, তাই কারো বিপদ আপদে মানুষের অভাব হয় না। অভিলাষের নাক মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে।
প্রভাবতী অভিলাষকে জড়িয়ে ধরে আছে। আর বলছে,ওর কি মা বাবা নেই, কোন অপরাধ করলে তাদের ডাক, ছেলেটাকে এভাবে মেরে ফেলবি নাকি? ছেলেমানুষ কনা অভিলাষের কষ্ট দেখে নিতান্ত ছেলে বুদ্ধিতে কাঁদতে লাগলো। কেন যে তার কারণ বুঝতে পারলো না।
প্রভাবতির কথায় ওদের বাড়ির সবাই একটু মর্মাহত হলেন। বলেন, কতবড় সাহস উত্তর পাড়া থেকে এসে দক্ষিণ পাড়ার মেয়ের সাথে বেয়াদবি। ওকে এখানেই মেরে ফেলবো।
অভিলাষ দন্ড, লাঞ্ছনা এবং অপমানে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলো। কান্না করতে করতে বলে, কাকিমা আমি অপরাজিতাকে ভালোবাসি ওকে বিয়ে করতে চাই। ও শহরে গিয়ে আরেকটা ছেলেকে ভালোবেসে এখানে পরীক্ষা দিতে নিয়ে এসেছে।
অপরাজিতাদের বাড়ির লোকজনের আক্রোশ তখন চরমে। বলে, ও এজন্যই বুঝি তুমি ছুরি নিয়ে এত রাতে ওদের ঘরে ঢুকেছো?
জানা গেছে অভিলাষ নাকি রাতে ছুরি নিয়ে ওদের ঘরে ঢুকেছে ওই পরীক্ষার্থী ছেলেকে ভয় দেখানোর জন্য। ছেলেটা ওকে ঝাপটে ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ির লোক জড়ো করে ফেলেছে। ধ্বস্তাধস্তিতে অপরাজিতার হাত ও মুখের অনেক জায়গায় কেটে রক্ত বেরুচ্ছে।
গ্রামের সবাই কম বেশি অভিলাষ আর অপরাজিতার প্রেমের সম্পর্কে জানত।ওদের বাড়ির লোকজন এত কথা শুনতে রাজি নয়। উত্তর পাড়ার ধনীর দুলালকে বাগে পেয়েছে, এখন হাঁড়গোড় ভেঙ্গে দিতে পারলেই তার যথার্থ জবাব দেয়া হবে।
তখনকার সময়ে গ্রামে উত্তরপাড়া আর দক্ষিণ পাড়ার মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল। সবাই নিজেদের পাড়াকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত। পূজার সময় এবং শীতকালে বার্ষিক পরীক্ষার পরে দুই পাড়ার মধ্যে গরুর লড়াই, ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে এই প্রতিযোগিতা আর ও তীব্র হত। পূজার সময় সবাই নিজেদের পাড়ার প্রতিমাকে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা দিয়ে দিত। অবশ্য অভিভাবকরা এসবের ধার ধারত না। প্রতিবেশী সুলভ সুসম্পর্ক ছিল সবার সাথে সবার।
প্রভাবতী ও নাছোড়বান্দা, না ওর গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। নিজের ছেলের বয়সি ছেলের কষ্ট দেখে কান্নার ঢেউ তারঁ কন্ঠ পর্যন্ত ফেনিয়ে উঠল। কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, কোন অপরাধ করলে থানা পুলিশ আছে। কিন্তু এভাবে ওকে মারতে পারবি না।
প্রভাবতিকে গ্রামের সবাই খুবই সম্মান করতেন। আর করবেই না কেন, গ্রামে সবার বিপদ আপদে আর্থিক এবং মানসিক সাহায্য নিয়ে সবার আগে দৌঁড়ে আসেন একমাত্র উনিই।
আরেকপাশে সেই অপরাজিতা, দুজন দুজনকেই প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে, সে ক্রমান্বয়ে কান্নাই করে যাচ্ছে। মুখে কোন ভাষা নেই।
হয়ত চিন্তা করছে, তুমি আমাকে এভাবে ভুল বুঝলে! একটা জুনিয়র ছেলেকে নিয়ে! এমন নিষ্ঠুর আঘাত, এত বড় নিলর্জ অপমান!
অপরাজিতার ছোট বোন সুজাতা মর্মান্তিক সিংহীর মত দুচোখে আগুন জ্বেলে জুতা নিয়ে ক্ষ্যাপে ক্ষ্যাপে আসছে। তা দেখে প্রভাবতী মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি চুপ থাক, তুমি কেন এরকম করছো?
অভিলাষ বলে, তুই ও আমাকে জুতা নিয়ে মারতে আসছিস! তোর এস এস সি র ফরম ফিলাপের টাকা কে দিয়েছে? পরীক্ষা কেন্দ্রে পুলিশের লাঠির পিটা কে খেয়েছে?
কপালডাঙ্গা গ্রামের অভিলাষ গ্রামের ভদ্র এবং গৃহস্থ পরিবারের ছেলে। মেধাবী এবং ভদ্র সন্তান বলে সবাই ওকে ভালোবাসে। স্নাতক পাস করার পর সরকারি চাকরি নিয়ে গ্রামে থাকেন। পাশাপাশি বাবার ব্যবসা ও দেখাশোনা করেন। অপরাজিতাদের পারিবারিক দুর্দশার ইতিহাস সবাই জানে। শারীরিক প্রতিবন্ধী মা বাবার বড় সন্তান। অনেক কষ্টে এইচ সি পাস করে, সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে শহরে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। দেখতে অনেক সুন্দরী। চেহারায় একেবারে সুচিত্রা সেন। তাই অভিলাষ সবসময় তাকে সন্দেহ করত। দুই পরিবারের সবাই ওদের সম্পর্কের কথা জানতেন। গরিবের মেয়ে বলে, অভিলাষের পরিবার ওদের এই সম্পর্ক মেনে নিতে চায়নি। অভিলাষের বাবা বলতেন, এই বিয়ে আমি কোনদিন মেনে নিবো না।একটা পঙ্গু বাবা মার মেয়ে আমার ছেলের বৌ হতে পারবে না।
প্রভাবতী বললেন, ওর দায়িত্ব আমি নিলাম। ও আমার কাছে আছে। কোথাও যাবে না। তোরা ওর বাড়িতে যা, অভিভাবককে ডেকে নিয়ে আয়। সবাই একটু শান্ত হলেন। অপরাজিতাদের বাড়ি থেকে কয়েকজনের একটা গ্রপ অভিলাষের বাড়িতে গিয়ে ওর মা বাবাকে বিষয়টি বলতেই ওরা ছুটে আসলেন।
অভিলাষের বাবা মনে হয় আজ রাগ, ক্রোধ, বিদ্রূপ সব ভুলে গেছেন। উনি এসে সবার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। প্রভাবতিকে বললেন, বৌদি আপনি আমার ছেলেকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। আপনার কাছে আমি এবং আমার পরিবার আজীবন চির ঋণী হয়ে থাকবো।প্রার্থনা করি আপনি সুখী হউন। প্রভাবতী আর ওদের বাড়ির সবার অনুরোধে দুজনের চিকিৎসা এবং চিকিৎসা পরবর্তী বিয়ের অঙ্গীকার করে অভিলাষের বাবা ওদের দুজনকে শহরে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।
চারিদিকে পাখির কিচির মিচির ডাক শোনা যাচ্ছে। ভোর হয়ে এসেছে। কনার পূজার ফুল তোলার সময় হয়ে গেছে। আরেকটু দেরি হলে ঠাকুমা রাগ করবেন!
আজ ১০ আশ্বিন। অভিলাষ আর অপরাজিতার বিয়ে। ঢাক ঢোল সহযোগে মহাসমারোহে বিয়ের আয়োজন। সকাল থেকে কনার আজ ব্যস্ততার শেষ নেই। বিয়ে উপলক্ষে উত্তর পাড়া আর দক্ষিণ পাড়া মিলে পুরো গ্রাম তোলপাড়। অভিলাষের বাড়িতে আজ ভিড় যেন ধরে না।