আলেয়ার নিষ্প্রাণ দেহটা হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে, দু’হাত দু’পা বেডের সাথে শক্ত করে বাঁধা। মুখে মলিন হাসি নিয়ে চিরনিদ্রায় আলেয়া। ওর স্বামী নেজাম মাথায় হাত দিয়ে পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। কোন পুরুষ মানুষ যে এমনভাবে কাঁদতে পারে নেজামকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেনা। খবর পেয়ে কাছের চার-পাঁচজন স্বজন এসে সান্ত্বনা দিচ্ছে নেজামকে। হাসপাতালের লোক হাত পায়ের বাঁধন খুলে লাশকে একটা স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে ওয়ার্ড থেকে বের করে নীচে নামাচ্ছে। লাশের পেছন পেছন নেজাম আর তার স্বজনেরা । লাশ হাসপাতাল থেকে নিতে যেতে৷ হবে, কী করেবে, কোথায় নিয়ে যাবে ভাবছে নেজাম। মাথা কাজ করছে না , মাত্র একমাস আগেই চট্টগ্রাম এসেছে রংপুর থেকে। প্রথমে একটা বেসরকারি হাসপাতালে নিয়েছিল আলেয়াকে, একদিনে আই সি ইউ’র বিল এসেছে বিশ হাজার টাকা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর অবস্হা পর্যবেক্ষণ করে রোগীকে সরকারী মেডিকেল কলেজে স্হানান্তরের পরামর্শ দেয়। অসুস্হ স্ত্রীকে সুস্হ করে নিতে নেজাম দৌড়ে হাসপাতালে তো ভর্তি করিয়েছে, কিন্তু এখন বিশ হাজার টাকা বিল কোথা থেকে পরিশোধ করবে! মাথায় যেন বাজ পড়ে নেজামের। তখন এগিয়ে আসে নেজামের স্বজনেরা, কিস্তিতে ত্রিশ হাজার টাকা লোন নিয়ে দেয় নেজামকে। সেই টাকা থেকে বিশ হাজার টাকা দিয়ে নেজাম হাসপাতালের বিল পরিশোধ করে আলেয়াকে চট্টগ্রাম সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করায়। এটা সরকারি হাসপাতাল হওয়াতে শুধু ওষুধ আর ইনজেকশন বাবদ সাতহাজার টাকা ছাড়া আর তেমন বড় কোন খরচ হয়নি এই একদিনে। কিন্তু এখন লাশ নিয়ে বিপদে পড়েছে। জানা গেছে যেকোন জায়গায় দাফন করতে হলে প্রায় বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা খরচ হবে। কিন্তু নেজামের মন সায় দিচ্ছিল না আলেয়াকে এক মাস আগে আসা এই দূরনগরীতে কবর দিতে। লাশ বহনকারী গাড়ির ড্রাইভারের সাথে কথা বলে জানা গেল ৩৫–৪০ হাজার টাকা লাগবে রংপুরে লাশ নিতে। কোথায় পাবে সে এই টাকা! অসহায় ভাবে ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল নেজাম। এবারও সাহায্যের ডালা তুলে ধরে সেই কিস্তিতে লোন! নেজাম কথা দিয়ে যায় বাড়ি গিয়ে জমি বিক্রী করে দেনা পরিশোধ করবে। সিদ্ধান্ত নেয় আলেয়াকে এখানে এতদূরে একা রেখে যাবেনা। আলেয়াকে সে নিজের জমিতেই দাফন করবে,তার বিশ্বাস আলেয়া শান্তিতে থাকবে তার আপনজনদের কাছাকাছি। লাশবাহী গাড়ির সাথে দরাদরি করে শেষমেষ ৩০ হাজার টাকায় রাজী হয়েছে। গত দুদিন এক মুহুর্তের জন্যও চোখ বন্ধ করতে পারেনি সে। আলেয়া আই সি ইউতে থাকলেও বাইরে বসে কাটিয়াছে নেজাম। মাঝে মাঝে গিয়ে দূর থেকে দেখে এসেছে আলেয়াকে। বিশেষ করে গতরাত গেছে বিভীষিকাময়, আলেয়া তার নিজের গায়ের চামড়া আঁচরে আঁচরে ক্ষতবিক্ষত করছিল, তার হাতে লাগানো আইভি চ্যানেল একটানে খুলে ফেলে দিয়েছিল, অক্সিজেন, রাইসটিউব সহ মনিটরিংয়ের জন্য আরো যা যা তার শরীরে লাগানো ছিল,মুহুর্তে সব খুলে ফেলেছিল। ভীষণ অস্হির হয়ে পড়েছিল,নেজাম ভাবছিল এত শক্তি কোথা থেকে পেলো আলেয়া! ভাবছিল সত্যিই কি তবে আলেয়াকে জ্বীনে আছর করেছে! বেগতিক দেখে ডাক্তার বেডের সাথে হাত পা বেঁধে রাখার নির্দেশ দেন, সেই থেকে মৃত্যু অবধি হাত-পা বাধা ছিল। নেজাম ভাবছে, কতটা শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে আলেয়াকে। নেজামের দুচোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়েই চলেছে। আলেয়াকে নিয়ে চলেছে রংপুরের পথে, সাথে দু ছেলে আর দুজন আত্মীয়। পূরুষ মানুষের চোখে এত জল খুব কমই দেখা যায় সেও আবার এই শ্রেণীর লোকদের মাঝে, যাদের ঘরের বৌদের নানা কারণে কথায় কথায় বরের মার খেতে হয়, অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে হয়। নেজামের চোখের জল দেখে সবাই খুব অবাক হয়েছিল। নেজাম যখন আলেয়াকে বিয়ে করে ঘরে তোলে আলেয়ার বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। রংপুরে বাড়ি হলেও চট্টগ্রামেই জন্ম আলেয়ার। রংপুর থেকে বেশ কিছু লোক রোজগারের জন্য চট্টগ্রামে চলে আসে,গড়ে তোলে কলোনী। নতুন কেউ রংপুর থেকে এলে সাহায্য করে এরা একে অপরকে কাজ পেতে,বাসস্হান পেতে। ছেলেমেয়ে বিয়ে দিয়ে গড়ে তোলে আত্মীয়তা। তেমনি একটা কলোনীতে আলেয়া নেজাম থাকতো। মা-বাবা ইচ্ছাতেই বিয়ে হয় আলেয়া নেজামের। নেজামের বয়স তখন ২০-২১ বছর, সুগন্ধায় ময়লা টানার কাজ করতো বাবার মত আরো অনেকের সাথে। বিয়ের কিছুদিন পর আলেয়াকে নিয়ে সে চলে যায় রংপুর বাবার বাড়িতে,যেখানে তার বাবা কষ্ট করে দুবেলা খেয়ে না খেয়ে অল্প টাকা জমিয়ে ছোট্ট একটুকরো জমি কিনেছিল। পরবর্তীতেটিনের ছাউনি আর বেড়া দিয়ে দুটো ঘর তুলে রেখেছিল। প্রতি ঈদের পর হাতে বখসিসের বেশ কিছু টাকা আসতো,তার সাথে সারাবছরের রক্ত ঝরা আয় থেকে সঞ্চিত কিছু অর্থ হাতে নিয়ে চলে যেত রংপুর,থেকে আসতো ক’টা দিন।এ সময়টাতে সামর্থ্য অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কিছু আসবাব, তৈজসপত্র কিনে সাজিয়ে আসতো ঘর, লাগিয়ে আসতো সখের দু’চারটে গাছ। দিন পনেরো কাটাবার পর আবার ফিরে আসতো সকাল থেকে সন্ধ্যে ছুটে চলা সেই চিরচেনা নগর জীবনে।
নেজাম ছেলেটা খুব সংসারী, ওদের আর দশটা ছেলের মত নয়। কোন বদ নেশা নেই, আলেয়ার গায়ে কোনদিন সে হাত তোলেনি।আলেয়াকে নেজাম সত্যিই খুব ভালোবাসে। আলেয়াও শান্ত স্বভাবের মেয়ে, মুখে সবসময় হাসি লেগে আছে। রাগ নেই, অভিমান নেই, কাজের জায়গায় বকা খেলেও হাসি দিয়ে তা হজম করে নেয়। তার এই স্বভাবের জন্য আশপাশের সবাই তাকে বেশ ভালোবাসে।

গ্রামে দিনমজুর হিসাবে কাজ করতো নেজাম, আর আলেয়া সংসার সামলায়। দিনমজুরের কাজ, সবসময় থাকে না। প্রতিবেশীর সহযোগিতায় নেজাম চলে আসে ঢাকায় আলেয়াকে নিয়ে, দুজনেই একটা গার্মেন্টসে কাজ নেয়। ভালোই চলছে দুজনে, একটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকে। রাতে এসে রান্না করে আলেয়া। মাছ মাংস কেনা বা রান্না করার সময় বা সামর্থ্যও কোনটাই নেই ওদের। ডাল, ভর্তা, বা একটা সব্জি রান্না করে কাটিয়ে দিচ্ছে দিন। রাতে খাওয়ার পর যা থাকে,সকালে নেজামকে তা প্যাক করে দিয়ে দেয় দুপুরে খাওয়ার জন্য। নিজে দুপুরে হয়তো দুটো বিস্কিট, নয়তো একটা নানরুটি,কখনো একটা সিঙ্গাড়া, আবার কখনো বুটবাদাম কিনে দুপুরের খাওয়া চালিয়ে দেয়। প্রতিমাসে কিছু কিছু টাকা জমাচ্ছে ওরা দুজন, চোখে অনেক স্নপ্ন— সবসময় এ চাকরি করবেনা ওরা, বাড়িতে পাকা ঘর তুলবে, এটা ওটা কিনে ঘর সাজাবে ইত্যাদি ইতাদি। দিন যায়, ওদের কোল জুড়ে আসে কন্যাসন্তান। নেজাম আলেয়াকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। দুবছর পর আলেয়া আবার ঢাকায় চলে আসে, শুরু করে চাকরি। মেয়ের বয়স যখন চার তখন কোলে আসে ছেলে। এবার ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়িতে চলে যায় আলেয়া। শাশুড়িকে রাজী করিয়ে ছেলেটা যখন আটমাসের, শাশুড়ির কাছে বাড়িতে রেখে ঢাকায় এসে আবার গার্মেন্টসের কাজে যোগ দেয়। দুইজনের রোজগারে কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে ছেলেমেয়ে বড় করার সাথে সাথে বাড়িতে কাঁচা ঘর ভেঙে পাকা ঘর তোলে। সখের একটা পালঙ্ক তৈরী করায়, সিলিংয়ে ফ্যান লাগায়, বাচ্চাদের দেখার জন্য একটা টেলিভিশন কিনে দেয়, কিছুদিন পর একটা ফ্রিজও কেনে কিস্তিতে। ছেলেমেয়ে দুটোকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছে, ছুটিছাটায় বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে আসে। এভাবে ভালোই চলছিল দুজনের। মেয়েটার বয়স যখন ১২, আলেয়া আগের মত আর কাজ করতে পারে না, ফলে কাজের জায়গায় কথা শুনতে হয় প্রায়ই ,তখন আলেয়া আর নেজাম সিদ্ধান্ত নেয় আর চাকরি করবেনা। বাড়িতে গিয়ে স্হায়ীভাবে বসবাস করবে। ওরা বাড়িতে চলে আসে। নেজাম ক্ষেতে কাজ করে আর আলেয়া করে ধান ভানা, ধান শুকানো, মরিচ তোলা, আলু তোলা ইত্যাদি যখন যে কাজ পায় । দুজনের রোজগারে চলে যাচ্ছিল দিন, সুখেই ছিল ওরা। অল্প অল্প করে সখের অনেক জিনিস দিয়ে ঘর সাজিয়ে তুলছিল। মেয়েটার বয়স যখন ১৭ বিয়ে দেয় মেয়েটাকে। খাট, হাত ঘড়ি, বিছানা বালিশ, শোকেস,বাসনপত্র,টেলিভিশন,গলার চেইন, এক জোরা কানের সব দিতে হয়েছে মেয়েকে। এতেকরে প্রায় দুলাখ টাকা লোন হয়ে যায় ওদের। ভেবেছিল ধীরে ধীরে জমিয়ে লোন শোধ করবে। কিন্তু মেয়ের জামাই অত্যন্ত লোভী হওয়াতে একটার পর একটা জিনিসের ফরমায়েশ করেই চলেছিল। ক’দিন আগে মেয়ের জামাই একট ফ্রিজের জন্য বেশ চাপ দেয়। নেজাম আর আলেয়া উপায়ান্ত না দেখে ঠিক করে চট্টগ্রাম এসে আলেয়া বাসায় বুয়ার কাজ করবে, আর নেজাম কিছু একটা করে রোজগারের ববস্থা করবে। ছেলেটা ১১-১২ বছরের হয়েছে, ওকে হয়তো কোন একটা দোকানে কাজে লাগিয়ে দেবে। এছাড়া লোন শোধ, আর মেয়ে জামাইয়ের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। একমাস হলো ওরা চট্টগ্রাম এসেছে, আলেয়া দুটো বাসায় কাজ করে, নেজাম অন্য কোন কাজ না পেয়ে রিক্সা চালায়। চার-পাঁচ দিন ধরে আলেয়ার শরীরটা বেশ খারাপ।
আলেয়াদের মত মেয়েরা কোন পুষ্টিকর খাবার কেনদিন খায় না। টাকা জমিয়ে জমি কিনে,সখের জিনিস কিনে, মেয়ের জন্য সোনার গয়নাও গড়িয়ে রাখে। এ বাসা ও বাসা থেকে ভালো খাবার দিলে পুটুলি করে নিয়ে যায় ছেলেমেয়ে পরিজনদের জন্য। অল্পবয়সে গায়ে জোর থাকায় সারাদিন দৌঁড়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে। অল্প অসুস্হ হলে ডাক্তার নয় এমন ডাক্তারের কাছ থেকে কড়া ডোজের ওষুধ খেয়ে দু-একদিনেই তরতাজা হয়ে যায়, কিন্তু এতে করে যে পরবর্তীতে শারীরিক ক্ষতি হতে পারে তা ওরা বুঝেই না। অতিরিক্ত পরিশ্রম, অধিক সন্তানের জন্মদান, পুষ্টির অভাবে বয়স হওয়ার আগেই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে।
তিনদিন আগে আলেয়াকে একজন ডাক্তার দেখানো হয়, তবে তিনি কোন ডিগ্রিধারী ডাক্তার নয়। ডাক্তার কিডনির অবস্হা বেশ খারাপ বলে জানায়, সাথে অন্যান্য শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে সেইদিন না সেই অজ্ঞ ডাক্তার আট আটটা ইনজেক্সন পুশ করে আলেয়ার শরীরে! রাতে আলেয়ার শারীরিক অবস্হার অবনতি হয়, ভিষণ ছটফট করছিল আলেয়া। আশপাশের সবাই বলছিল আলেয়াকে জ্বিন আছর করেছে, ঝাড়ফুঁক করার জন্য এক মৌলবীকে আনা হয়। ঝাড়ফুঁকের পর আলেয়ার অবস্হার আরো অবনতি হয়। উপায়ান্ত না দেখে বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। এরপর আই সি ইউতে শিফ্ট করা হয়। আলেয়া ভয়ঙ্কর রকম ছটফট করছিল, শরীরের সব কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলছিল। অবস্হা সুবিধার নয় দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে চট্টগ্রাম সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করতে বলেন। বিশহাজার টাকা বিল পরিশোধ করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করলেও শেষ রক্ষা হয়নি—আলেয়া ঠিকই সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে! আলেয়াকে নিয়ে আ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলেছে রংপুরের পথে—
নেজাম শূন্যে দৃষ্টি মেলে বসে আছে, ভাবছে কেমন করে কি হয়ে গেলো!