Site icon Shaili Tv

কবিতার চাল ও শব্দের সৌন্দর্য/রাশেদ রউফ

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, গদ্যের চালটা পথে চলার চাল, পদ্যের চাল নাচের। এই নাচের গতির প্রত্যেক অংশের মধ্যে সুসংগতি থাকা চাই। যদি কোনো গতির মধ্যে নাচের ধরনটা থাকে, অথচ সুসংগতি না থাকে, তবে সেটা চলাও হবে না, নাচও হবে না, হবে খোঁড়ার চাল অথবা লম্ফঝম্প। কোনো ছন্দে বাঁধন বেশি কোনো ছন্দে বাঁধন কম, তবু ছন্দমাত্রার অন্তরে একটা ওজন আছে। সেটার অভাব ঘটলে যে টলমলে ব্যাপার দাঁড়ায়, তাকে বলা যেতে পারে মাতালের চাল। তাতে সুবিধাও নেই, সৌন্দর্যও নেই। [শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষকে লিখিতপত্র: ২২জুলাই ১৯৩২]
ছিয়াশি বছর আগে যে মন্তব্য করেছিলেন কবিগুরু, তার উদ্ধৃতি টানছি বিশেষ একটি কারণে। কারণটা বলছি। কিছুদিন আগে ছন্দবিষয়ক এক আলোচনায় আমি বক্তব্য রাখছিলাম। আলোচনায় কবিতার নানা দিক উঠে আসছে। দেশের নামকরা কবির কবিতা আসছে উদাহরণ হিসেবে। চট্টগ্রামে অবস্থানরত কয়েকজন কবিও উঠে আসছেন আলোচনায়। কিছুক্ষণ পর দর্শকÑশ্রোতাদের একজন আমার পরিচিত এক কবির মুদ্রিত একটি কবিতা সর্ম্পকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। দেখলাম, কবিতাটি প্রচলিত ছন্দে তৈরি করতে চেয়েছেন কবি। ফলে এর মধ্যে যে মাত্রা ঘাটতি আছে, তা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। ব্যাহত হয়েছে সুর, নষ্ট হয়েছে এর সুসংগতি। তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এটিকে বলতে পারি- খোঁড়ার চাল অথবা লম্ফঝম্প অথবা মাতালের চাল।
কাব্যের ধর্ম হচ্ছে রসসৃষ্টি করা। যদি এ শ্রেণীর রচনা গদ্যছন্দে তৈরি হয় এবং তাতে যদি কাব্যরস থাকে-তাহলে তাকে কবিতা বা কাব্য বলে গণ্য করতে বাধা থাকে না। ‘সাহিত্যে এমন অনেক রচনার পরিচয় পাওয়া যায় যা পাঠকের চিত্তে কাব্যরসের আনন্দ দেয়, অথচ সেই ভাব ও রসের বাহন প্রচলিত ছন্দ নয়’। আলোচ্য কবিকে আমি জানি, তাঁর কবিতার গতিÑপ্রকৃতি ও প্রকরণ সম্পর্কেও আমার বেশ ধারণা আছে। সাধারণত তিনি তাঁর কবিতা গদ্যে লিখে থাকেন। কিন্তু হয়তো কারো প্ররোচনায় অথবা স্বউৎসাহে তিনি উক্ত কবিতাটি আবদ্ধ করতে চেয়েছেন ছন্দের নিয়মতান্ত্রিক জালে। মুসিবৎ সেখানেই। সেখানেই তিনি পুরোপুরি সফল হয়ে ওঠেন নি। যেÑপথে তিনি স্বচ্ছন্দ, সেÑপথে এগিয়ে যাওয়া মঙ্গল।
বস্তুতপক্ষে কবিতা সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে চাই না। কেননা, আমি জানিÑকবিতা বিষয়ে কেউ নিজের ভাবনায় বেশিদিন স্থির থাকতে পারেন না। কবিতা ক্রমাগত তার রূপ বদলাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে নিজে। কবিতা কী? সেÑবিষয়েও অভিন্ন কোনো মত নেই। একেক জন একেক ভাবে সংজ্ঞায়িত করছেন কবিতাকে। শিল্পী যে কাজ করেন রঙ দিয়ে, কবি সে কাজ করেন শব্দ দিয়ে Ñঠিক একথাই বলেছেন কার্লাইল। তিনি কবিতাকে বলেছেন সঁংরপধষ ঃযধঁমযঃং. ওয়ার্ড্সওয়ার্থ বলেছেন, জীবনের সত্য ও সৌন্দর্যের পরিপ্রেক্ষিতে জীবনোপলব্ধির সমালোচনাই হলো কবিতা। অন্যদিকে শেলী বলেছেন, ‘কল্পনার অভিব্যক্তিই হলো কবিতা। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, ‘উপমাই কবিত্ব’। দান্তে বলেছেন, ‘সুরে বসানো কথাই কবিতা’। এই সংজ্ঞা ছোট হতে হতে এখন এসে দাঁড়ালো: ‘শব্দই কবিতা’। এই শব্দ কোন ধরনের শব্দ! তাতে থাকা চাই মুগ্ধ হওয়ার উপকরণ, যার নাম সৌন্দর্য। যেমন:
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

অথবা
এখানে সাগর নেই, নেই সে- ঝিনুক
রাঙামাটি চায় লোকে কুয়াশা কিনুক।
চারদিক পরিপাটি আর সুনসান
বাউরি বাতাসে ভাসে আদিবাসী গান।

কবিতা আরাধনার বিষয়। এটি একটি নির্মাণকলা, অন্যান্য শিল্পের মতো একেও নির্মাণ করতে হয়; যদিও সবার নির্মাণশৈলী মৌলিক ও নান্দনিক হয়ে ওঠে না। কেননা ছন্দ-অলংকার, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও অপরূপ শব্দ-যোজনায় নির্মাণ করা হয় কবিতার বসতবাটি। এটি সহজাত শিল্পসৌকর্যে যতটা উজ্জ্বল ও প্রাণময় হয়ে উঠবে, ততই পাবে ব্যাপকতা। ছন্দ যেমন কবিতার শরীরে গতি আনে এবং তেমনি শব্দ কবিতাকে করে তোলে মোহময়।

আবু হাসান শাহরিয়ার তাঁর ‘শব্দ’ কবিতায় লিখেছেন ;
শব্দই কবির প্রেম; সে ঢোকে নিঃশব্দ পায়ে মনে
শব্দের ডুবুরি কবি; শব্দ বাঁচে ডুব-সন্তরণে।

অন্যদিকে, ড. সফিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, একজন শক্তিমান কবির হাতে এক একটি শব্দ হয়ে ওঠে ভয়াবহ ভূমিকম্পের মতো, বিসুভিয়াসের বিস্ফোরণের মতো, বজ্রের মতো ও এটমের মতো শক্তিশালী, প্রচ- ঝড়ের তা-বের মতো, সাগরের উত্তাল গর্জনের মতো, সূর্যের মতো তেজোদীপ্ত, আকাশের ও দিগন্তের মতো বিস্তার এবং পূর্ণিমার চাঁদের মতো আলোকোজ্জ্বল ও সাগরের মতো অতলান্ত গভীর। তাই আর্য ঋষিরা ঈশ্বরের কাছে শৈল্পিক শব্দ এবং ওজস্বী ও আবেদন ঋদ্ধ উচ্চারণ প্রার্থনা করতেন যেন ঈশ্বরের কাছে তার প্রার্থনার কণ্ঠস্বর পৌঁছে।
একজন কবি তাঁর কবিতায় এই প্রার্থিত শব্দেরই এক আলৌকিক সত্তা। শব্দে তিনি জীবন্ত- শব্দেই তিনি প্রাণবন্ত। কবিতায় ও ভাবে, রূপক ও প্রতীকে, চিন্তা-চেতনা ও শব্দের অভিযোজনায় তিনি হয়ে ওঠেন প্রিয়, গ্রহণীয় ও বিশিষ্ট।
কবিদের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ্যণীয়; সেটা হলো বৃত্ত ভাঙার প্রচেষ্টা। তরুণ বয়স থেকে তাঁর ভিতরে এমন উন্মাদনা তৈরি হয়, তিনি ইচ্ছে করেন প্রচ- ঝাঁকুনি দিয়ে চারপাশ কাঁপিয়ে কাব্য রচনায় ব্রতী হতে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এ কবিরা ভেতরে ভেতরে প্রচ- বিস্ফোরণ ঘটান এবং কাব্যের মহৎ ভাব ও উত্তাপকে কালান্তরে উৎসারিত করেন। তিনি আয়োজন করেন আলোর মহা উৎসব। সেই উৎসবেই কবিতার ব্যাপকতা, বিশালতা ও বিস্তৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যান ঝরনাধারার মতো। একসময় তাঁর মাথায় উঠে আসে সাফল্যের মুকুট। অবলীলায় তিনি বলতে পারেন :

যে আমাকে অস্বীকার করে
প্রথমত অকবি সে; দ্বিতীয়ত পরশ্রীকাতর
হয়তো সে মিডিয়াপালিত কোনও প্রাবন্ধিক; ভুলবাক্যে বুকরিভিউ করে
অথবা সে আসল কালপ্রিট, দ্যাখে বড়কাগজের লঘু সাহিত্য পাতাটি
নতুবা সে ছোট কোনও কাগজের পাতি সম্পাদক
নিজেকে জাহির করে নিজের কাগজে
কাগজে-কাগজে করে সখ্যবিনিময়
ওরা কেউ কবি নয়, ওদের পেছনে ঘুরে বহু প্রতিভাকে আমি নষ্ট হতে দেখি
যে-আমাকে কেবলই স্বীকার করে, বিতর্ক করে না
সে-ও কোনও কবি নয়, জেনো
যে আমাকে গ্রাহ্য করে, পাশাপাশি মধুর তর্কও
তারই মধ্যে আমি কিছু সম্ভাবনা দেখি
সে-ও কবি নয় কে তাহলে ?
অমিতসম্ভাব্য কবি ভালবাসে একার সন্ন্যাস।

Exit mobile version