সপ্তাহখানেক থেকে কলেজে যাওয়া -আসার পথে রোজই পাগলীটাকে দেখছে নিম্মি।
বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ, একমাথা উসকোখুশকো চুল, আর পরনে শতচ্ছিন্ন একটা কাপড়! কোথা থেকে এসেছে, কি বা তার পরিচয় জানে না কেউ।
নিম্মিদের সুসজ্জিত বিল্ডিংটার বাইরে গলির মোড়ের এককোণায় পড়ে থাকে।
কেউ দয়া করে উদ্বৃত্ত খাবার কিছু দিলে খায়, নয়তো রাস্তার পাশে ডাস্টবিনটা উল্টেপাল্টে নোংরা ঘাটতে থাকে। পাশ দিয়ে যেতে গেলে গায়ের উৎকট গন্ধে ভীষণ বমি পায় নিম্মির!
এমনিতে কারো কোন ক্ষতি করে না সে, আপন মনে কিসব যেন বিড়বিড় করতে থাকে সারাক্ষণ। কিন্তু কেন জানি নিম্মি একেবারে সহ্য করতে পারেনা এই পাগলীটাকে! তাদের এমন সুন্দর বহুতল ভবনটির সুদৃশ্য গেটের সামনে নোংরা, ঘিনঘিনে একটা পাগলী দিনরাত বসে থাকে…, কোন কথা হলো এটা?
এই তো সেদিন কোচিং শেষে বন্ধু তামান্নাকে সাথে নিয়ে এসেছিলো বাড়িতে, ঢুকতেই দেখে, গেটের কোণে দাঁড়িয়ে কপাল চাপড়ে কিসব যেন বলছিল আর মাঝেমাঝে চিৎকার করে কেঁদে উঠছিলো।
“কিরে নিম্মি, তোদের এরিয়াটা কি পাগলের আস্তানা হয়ে গেলো নাকি?”
ভয়ে আর ঘৃণায় মুখ বেঁকিয়ে তামান্না বলে উঠলো। শুনে এত্ত রাগ হয়েছিলো না নিম্মির!
“কবে যে বিদায় হবে আপদটা!” ভেবেছিলো নিম্মি।
আজ রুম্পার বার্থডে থেকে ফিরতে কিছুটা রাত হয়ে গেছে নিম্মির। অন্যদিন বাসার গাড়িটা সাথে থাকে, কিন্তু গতকাল থেকে গাড়িটাও খারাপ হয়ে গ্যারেজে আছে।
অনুষ্ঠান শেষে রুম্পার বাড়ি থেকে মা আনতে যাবে বলায় নিম্মি মায়ের গলা জড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলো “আম্মু, তুমি ভুলে যাও কেন যে,আমি আর এখন সেই ছোট্টটি নেই! কলেজে পড়ি। এখন এই বয়সেও তোমার আঁচলের তলায় থাকলে বন্ধু- বান্ধবের সামনে আমার মানসম্মান আর কি কিছু থাকবে? এমনিতেই সবাই বলে আমি নাকি একটা বিড়াল। সারাক্ষণ মায়ের আশেপাশে ম্যাঁও ম্যাঁও করে ঘুরতে থাকি! তা ছাড়া রুম্পাদের গাড়ি তো আমাকে রাস্তার মোড়ে নামিয়েই দিয়ে যাবে আম্মু। তারপর তো আর একটুখানি রাস্তা!”
“আচ্ছা, আচ্ছা বাবা, যাবো না তোকে আনতে। তবে দেখিস বেশি রাত যেন না হয়”।
আসলে খুব ছোটোবয়সে পিতৃহীন হয়ে পড়ায় মা নিম্মিকে একরকম পাহারা দিয়েই রাখে সবসময়।
গলির মোড়ে ঢুকতে যাবে, অমনি পথ আটকে দাঁড়ালো সেই বখাটে সুজন মাস্তান। পাড়ার উঠতি এই মাস্তানটা কদিন ধরেই ঘুরঘুর করছিলো নিম্মির পেছনে। ছেলেটার প্রেমের প্রস্তাব নিম্মি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করায় গতসপ্তাহে হাত ধরে অসভ্যতা করতে যায় সে নিম্মির সাথে।
কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই কিছুটা ডাকাবুকো টাইপের নিম্মি এসব বদমায়েশি সহ্য করবে কেন?
সেও অনেক লোকজনের সামনেই সপাটে চড় মেরে দিয়েছিলো ছেলেটার গালে। কিন্তু তার ফল যে আজ এভাবেই ভুগতে হবে আন্দাজ করতে পারেনি নিম্মি।
শীতকালের রাত হওয়ায় ন’ টার মধ্যেই রাস্তা ফাঁকা! গুটিকয়েক লোক ছিলো যারা, তারাও কিছু একটা গোলমালের আশঙ্কা করে সরে পড়ে একে একে।
আসলে সুজন আর তার দলবলকে ঘাঁটাতে সাহস করে না কেউ। চারপাশ দেখে বেশ ভয় পেয়ে যায় নিম্মি!
হঠাৎ রাস্তার ওপাড়ে পাশের ফ্ল্যাটের ফরহাদ সাহেবকে দেখতে পেয়ে বুকে সাহস এসে যায় নিম্মির। ‘আংকেল’ বলে চিৎকার করে ডাক দিয়ে সাহায্যের আশায় দৌড়ে যায় তাঁর কাছে।
কিন্তু ফরহাদ সাহেব শান্তিপ্রিয় মানুষ। ফালতু গুন্ডা- বদমায়েশদের পাল্লায় পড়তে যাওয়াটা উনার স্বভাববিরূদ্ধ।
” নিজে যেচে বিপদ ডেকে এনেছো যখন, তখন কি আর বলবো? সেদিন সুজন মাস্তানকে ওভাবে থাপ্পড় মারাটা কি তোমার উচিত হয়েছিলো বলো? তোমার মা তোমাকে সাহসী আর প্রতিবাদী করে গড়ে তুলেছে, সেসব ঠিক আছে কিন্তু সেই সাহস কি সবখানে দেখালে কি চলে মা? এখন বুঝতে পারছো বিপদটা?
এসব ছেলের সাথে টক্কর দেওয়ার সাহস আমার নেই। আমার ঘরেও তো আছে দুটো মেয়ে। সরি নিম্মি মা। তবে চিন্তা করোনা, আমি তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে তোমার আম্মুকে খবরটা দিচ্ছি।” কথাগুলো বলেই দ্রুত সরে পড়েন ফরহাদ সাহেব।
নিম্মির চোখ ফেটে জল আসে। সুজনের চোখেমুখে তখন পৈশাচিক উল্লাস! নিম্মির হাত ধরে সজোরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো তাদের আড্ডখানায়। এই অসুরের শক্তির সাথে এঁটে উঠতে পারে পারেনা নিম্মি। কাঁদতে লাগলো সে!
পাগলীটা রাস্তার ধারে কাঠ জ্বেলে গা হাত পা গরম করছিলো এতক্ষণ। আচমকা একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে এলোপাথাড়ি পিটাতে থাকে সুজনকে! কাঠটার সামনের অংশে তখনও আগুনের লেলিহান শিখা!
শার্টে আগুন ধরে গেছে সুজনের। পিঠের বেশ কিছুটা অংশ পুড়ে গেছে তার। বাম চোখটাতেও দেখতে পাচ্ছে না কিছুই।
বাধ্য হয়ে নিম্মিকে ছেড়ে দিয়ে চম্পট দেয় সে!
পাগলীটার চিৎকারে আশেপাশে লোক জমে গেছে বেশ! তখনও সে শূন্যে চেলাকাঠ ঘোরাতে ঘোরাতে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে,
“জানোয়ারের দল, আমার মেয়েটাকে খেয়ে শেষ করে দিয়েছিস সেই কবেই! আবার এই মেয়েটাকে শেষ করতে এসেছিস? আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেবো না কিছুতেই “।
ফরহাদ আংকেল মনে হয় এতক্ষণে খবরটা বাসায় দেয়ার সময় পেয়েছেন। নিম্মি দেখতে পেলো, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে আম্মু।
চোখদুটো জলে ভরে উঠলো নিম্মির। আর সেই ঝাপসা চোখে নিজের মা আর নোংরা – আবর্জনা ঘাঁটা পাগলীটা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো!