এক.
মুদি দোকানি জাকিরকে সবাই চেনে এই বাজারের লোকজন। দোকানের সদাই পাতি কিনতে গিয়েছিল কর্ণফুলীর ঐ পাড়ের শহর এলাকায়। খরিদ করা সদাই পাতির বস্তা-পোটলা সহ ঘাটের যাত্রীদের বসার জন্য রাখা গাছের গুড়ির বেঞ্চিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে তাকে জ্ঞান ফেরার জন্য। নদী পেরুবার মাঝ পথেই নাকি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল নৌকার পাঠাতনে। নৌকা জামতলী বাজারের ঘাটে ভিড়তেই মাঝির চিৎকার চেচামেচিতে ঘাটবাজারের বেশ কিছু লোকজন নেমে এসে ধরাধরি করে নৌকা থেকে ঘাটে তুলে নিয়ে গেছে জাকিরকে। একজন পানি নিয়ে এসে ছিটিয়ে দিয়েছে চোখে মুখে কয়েকবার তাতেও কাজ হয়নি, শুধু একবার চোখ খুলে চেয়ে দেখেছে তারপর থেকে আবারো চোখ মুদে পড়ে আছে। দোকানদারেরা সবাই চিনে বলে কোন অসুবিধা হয়নি। মালপত্র গুলো পাশেই রাখা আছে। জ্ঞান না ফিরলে বা দোকানের চাবিটা কোথায় আছে না জানতে পারলে কেউ জাকিরের দোকান খুলতে পারছে না বলে তাকে ঘাটের বেঞ্চিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে যদিও ঘাট থেকে অল্পকিছু দুরে বাজারের পুবদিকেই জাকিরের মুদির দোকান। পশ্চিম পাড় থেকে তাকে নিয়ে আসা নৌকাটা ফিরে গেছে অন্য যাত্রী নিয়ে। ঘটনাটা পুরোপুরি কারো কাছে জানা নেই পরিস্কার ভাবে। মাঝির মুখ থেকে যেটুকু শুনেছে সেটুকুই সবাই আওড়াচ্ছে শুধু-
জাকির’রে পাক বাহিনী ধইজ্জিল বলে/কেনে কেনে বাঁচি আইসসে বলে
ঐ পাড়ত্তুন মাঝি ওউ আনিয়েরে নামাই দি গেইয়ে
দোয়ান’র বাজার সদাই কিনি আইবার সমত আরো মাইনসর হোঁয়ারে তারেও পাক বাহিনী ধরি ফালাইল্ বলে..
এখনও বেহুশ হই পড়ি থাইক্কে, মাল সামনাগিনও ঘাটর টুলত্ পরি রইয়ে..
পুরো জামতলির বাজারে এই কথাগুলো চলছিল লোকজনের মুখে মুখে। ঘাটলা জুড়ে অনেক মানুষ জঠলা হয়ে আছে জাকিরের মুখটাকে ঘিরে। কাছে বসে কয়েকজন প্রনান্তকর চেষ্টা যাচ্ছে জাকিরের ত্রিশোর্ধ শরীরটাকে ঘসে মেজে কোন রকমে জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পারে কিনা সেই চেষ্টায়। কেউ হাতের আঙুলে কেউ পায়ের পাতায় তেল মাখিয়ে ঘর্ষন করে যা্েচ্ছ ্একটু পরপর। আর নতুন দেখতে আসা কৌতুহলী লোকজন ঐ এতটুকুই বলে যাচ্ছে শুধু। কিভাবে জাকির কর্ণফুলীর পশ্চিম পাড় থেকে জামতলীর বাজারের ঘাট পয্যন্ত এসে পৌছালো। এখন সবার উৎকণ্ঠা শুধু জ্ঞান ফিরবার প্রত্যাশায়। তারপর জাকিরের মুখ থেকেই জানা যাবে আসল ঘটনা ঘটেছে।
দ্ইু.
জাকির পেশায় একজন নাবিক। কর্ণফুলীল পশ্চিম পাড়ের হালিশহর গ্রামের বাসিন্দা। যেখানে রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক নৌ ঘাটি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়া সেই মার্চ মাসেই ঐ গ্রামে শুরু হয় লুটপাট আর আগুন। পাকিস্তান ইস্পাত কারখানা’র কিছু পাকিস্তানি বিহারীরও বসবাস ছিল এই গ্রামে। সারাদেশে যখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে, বাংলার দামাল ছেলেরা যখন দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিকে হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করার সপথে বলিয়ান হয়ে সমুখ সমরে যোগ দেওয়ার উপায় খুজতে ব্যসÍ, ঠিক সেই সময়টাতে এলাকায় অবস্থান করা পাকিস্তানিদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বহিরাগত বিহারীরা গ্রামে শুরু করে দিয়েছিল লুটপাট। তাদের হাত ধরেই গ্রামে প্রবেশ করেছিলে পাক হানাদার বাহিনী। বিহারীদের পরিচিত বাড়ীগুলো আক্রান্ত হয়েছিল সবার আগে। তাদের দেয়া তথ্যের উপর ভর করেই হানাদারেরা ‘মুক্তি’ তল্লাসীর নামে গ্রামের ঘরে ঘরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে আর সেই সুযোগ নিয়েই বিহারী মাস্তানেরা লুটপাট করে নিয়ে যেতে শুরু করেছিল গ্রামের নিরীহ মানুষগুলোর সহায় সম্বল। গ্রামের নওজোয়ান যুবকেরা যারা জাকিরের মত ছিল, তারা সকলে মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলো বলে যেখানেই প্রতিরোধের সম্মুখিন হয়েছিল হানাদারেরা সেখানে অগ্নি সংয়োগ করে একটা ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে গ্রামবাসিকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেছিল ঐ দখলদারেরা। স্থানীয় যুবকদের কাছে এটাও ছিল একটা সম্মুখ যুদ্ধের প্রতিরূপ। প্রশিক্ষণ বিহীন একঝাঁক যুবক যখন হানাদার মোকাবিলা করার জন্য পাড়ায় মহল্লার প্রবেশমুখে ব্যরিকেড দিয়ে লুটেরাদের প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করার প্রয়াস পেয়েছে তখন নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে যুক্ত হয়েছিলো অগ্নি সংযোগ। তার সাথে নিরিহ যুবকদের ধরে নৌ ঘাটির ভিতরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন, হত্যা শুরু করে দেওয়ায় প্রাণ ভয়ে অনেকেই আত্মগোপনে চলে গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে চেয়েছে। যার কারনে প্রথমেই পরিবার পরিজনদের নিরাপদ দুরত্বে সরিয়ে নিতে তারা ছড়িয়ে পড়েছিলো নিরাপদ আশ্রয়ের খোজে। সেই সময়েই কর্ণফুলীর এপারে জামতলী বাজারের পিছনের গ্রামের নানার বাড়ীতে এসে আশ্রয় গ্রহন করে নাবিক জাকির এবং তার পরিবার।
একদিকে হানাদারদের হাত থেকে এই মাটি রক্ষা করার যুদ্ধ অন্যদিকে এই মহাবিপদের সময়ে সম্বলহীন পরিজনের মুখে দু’মুঠো খাবার জোগাড় করারও আরেকটা যুদ্ধাবস্থায় দিনাতিপাত করছিল জাকির। নিজের আয়ের সবটা দিয়ে যে বাড়ীটা নির্মাণ করেছে নিজেদের গ্রামে, সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে নিজ দেশে পরবাসির মত কর্মহীন দিন কাটে তার। আর কতদিন ইবা চলে এমনি করে। লোকে বলে বসে বসে খেলে রাজভান্ডারও একদিন শেষ হয়ে যায়। জাকিরেরও তাই হয়েছে। কর্নফুলীর একপাড়ে পরিবার পরিজন অন্যপাড়ে নতুন করে বানানো বাড়ীটা, মাথাগোজার ঠাঁই টা ঠিক আছে নাকি হানাদারেরা জ¦ালিয়ে দিয়েছে তার খবরাখবর নিতে লুকিয়ে চুরিয়ে গিয়ে বাড়িটা দেখেও আসে জাকির প্রতি সপ্তাহে। এভাবে ্এপার ওপার করে দিন গেলেও এক সময় পেটের দায়ে বাজারে ছোট একটা পান বিড়ি লেবু চা বিক্রি করে সংসারের হাল ধরার যুদ্ধে অবতির্ন হয জাকির। দুমাস যেতে না যেতেই জাকির বাজারের সকলের আস্থাভাজন আর গ্রামে একজন আশ্রিত হিসাবে সকলে সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পটিয়া অনোয়ারা হয়ে এখানে দেয়াং পাহাড়ের এলাকাতেও মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছিলো বেশ কয়েক জায়গায়। গ্রামের মানুষ নির্দিষ্ট করে জানত না কারা এসব মুক্তিযোদ্ধা, কোন এলাকায় তাদের ঘাটি, কিন্তু জামতলীর বাজারে একবার একদল মুক্তিযোদ্ধা এসে যখন তাদের অপারেশন পরিকল্পনার জায়গা হিসাবে এই ঘাট রেকি করে তখন থেকে বাজারের লোকজন তাদের অবস্থানের কথা জানতে পারে। বাজারের দোকানদারেরা শুনেছে পশ্চিম পাড়ের গুপ্তখালি দিয়ে অপারেশন জ্যাকপট না কী একটা গ্রপের মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের জাহাজে বোমা লাগিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে ্এগুচ্ছে। গুপ্তখালী থেকে ঠিক উল্টোদিকে আড়াআড়ি ভাবে কর্ণফুলীর পুর্বপাড়ে জামতলী বাজারের অবস্থান হওয়ায় এপাড় থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা এইপাড়ের ঘাটে এসে যখন সম্ভাব্যতা যাচাই করার কাজ চালিয়েছে, তখনই বাজারের লোকজন জানতে পেরেছিল দেয়াং পাহাড়ের ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা আছে। কিন্তু সেটা সঠিক কোন জায়গায় অবস্থিত তা গ্রামের লোকজনের একেবারেই অগোচর ছিল। সন্ধ্যার পর আঁধার নামলে কখনো কখনো মুক্তিযোদ্ধারা এই বাজারে আসতো আর ঐপাড়ের পরিস্থিতি পরিকল্পনা নিয়ে ওপাড়ের ঘাটথেকেও এদিকে এসে একত্রিত হত কিছু মুক্তিযোদ্ধা। বাজারের লোকজন তখন খুব সতর্ক অবস্থায় থাকতো তাদেরকে নিয়ে। গ্রামের মানুষজনও ছিল বেশ সহযোগী ভাবাপন্ন, মুক্তিযোদ্ধাদের বাজারে বা ঘাটে অবস্থানকালে তাদের আদর আপ্যায়নের জন্য সবাই বেশ খোজ খবর নিত।
এভাবেই কাজ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারে বাজারের এক দোকানদারের কাছে ভাল রেডিও আছে। যার মাধ্যমে তারা খবরাখবর শোনে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সহ দেশাতœবোধক বাংলা গানও নাকি শোনা যায় এই রেডিওর মাধ্যমে। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধারা খোজ পেয়ে যায় জাকিরের মুদি দোকানের। ঘাটের সাথে লাগানো এক দোকানদার শরিফ সওদাগরের সাথে কথা এক মুক্তিযোদ্ধার। তারা যখন জানতে পারে জাকিরের রেডিওর কথা, তখন শরিফ সওদাগর সহ মুক্তিযোদ্ধারা এসে বসে জাকিরের দোকানের সামনে।
জাকির, বদ্দারা মুক্তিযোদ্ধা। তোর লয় কথা কইবো। জাকিরের কানে কানে বলল শরিফ সওদাগর।
ভাই কেমন আছেন, শুনলাম আপনার কাছে রেডিও আছে
জি¦ ভাই, একটা রেডিও ছিল, বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় অনেক কষ্টে মাল সামালের সাথে রেডিওটা নিয়ে এসেছিলাম। মাঝে মাছে খবর গান-টান শুনি আর কি।
মাঝে মাঝে মানে ভাই ? এখনতো ্আপনার এই জিনিষও আমাদের কাজে লাগবে। আমারা কি আপনার রেডিওতে একটু খবরাখবর শুনতে পারবো ?
অবশ্যই পারবেন, কী খবর শুনবেন ? আমরা তো মাঝে মাঝে বিবিসি’র খবর শুনি।
ভাই সেই জন্যই তো আপনার কাছে আসলাম। শুধু বিবিসি না, আপনার রেডিওর মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান শুনা যাবে।
সেই থেকে সখ্যতা সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। বাজারের দোকানগুলো সাধারণত রাত আটটার মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। এশার আজানের পরে বেশিক্ষণ আর বাজার চলে না। বাজার বন্ধ হওয়ার একটু আগে যেসব দিন মুক্তিযোদ্ধারা আসেন তাদেরকে নিয়ে বসার জন্য দোকানের পিছনের দিকটায় লম্বা লম্বা দু’টো টুল বসিয়েছে জাকির। শুনশান বাজারে পাঁচ-সাত লোক জাকিরের দোকানে বসে রেডিওর মিটার ঘুরাতে থাকে বাংলা অনুষ্ঠান শুনার আশায়। কোনদিন পরিষ্কার শুনা যায়, কোনদিন নানান রকম শব্দের ঘ্যানঘ্যানানিতে কিছুই বুঝা যায় না। তবুও সবাই খুশি একটু একটু যেটুকু শোনা যেত তা নিয়ে আর ওটুকু শোনার জন্য সে যে কী সতর্কতা আর উৎকন্ঠা সবার মাঝে। আর ওসব অনুষ্ঠান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে তাদের অপারেশনের ইঙ্গিত নিতেন তা সাধারণ বাজার দোকানিদের বুঝার কোন উপায় ছিল না। তারা শুধু অন্তর দিয়ে বুঝতে পারতো কিছু একটা ঘটবে, এই দেশ মুক্ত হবে একদিন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপন সেবা করার চেষ্টা করতেন তারা। সবাই ভাবতেন এই জামতলির বাজারটা অনেক নিরাপদ, হানাদারেরা এখানে আসতে পারবে না। দেয়াং পাহাড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা আছেন, তারাই এখন এই গ্রামবাসির গর্ব আর সাহসের বিষয়। তাই মুক্তিযোদ্ধারা যখন যেরকম সহযোগীতা চাইতেন বা নির্দেশ দিতেন সবাই একবাক্যে মেন চলতেন । বিভিন্ন সময়ে নানান রকম ছদ্মবেশধারী লোকজন নানান রকম মালপাতির চালান নিয়ে বাজারের বিভিন্ন দোকানে পৌছে দিয়ে যেতো আর রাতের বেলায় মুক্তিযোদ্ধারা এসে সেগুলো সংগ্রহ করে তাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতেন।
তিন.
জাকিরকে বাড়িতে পৌছে দেয়া হয়েছে। জ্ঞান ফিরলেও ভাল করে লোকজনের সাথে কথা বলতে পারেনা সে। চোখেমুখে কেমন যেন আতংকের ছাপ ফুটে রয়েছে তার চেহারায়। আর এরকম আতংকগ্রস্থ লোক যেভাবে ভয়ে কুচকে থাকে, লোকজনের সাথে কথাবলতে গেলে সেরকমই যেন সংকোচিত হয়ে থাকে সে। প্যান্টের পকেট থেকে চাবিটা খুজে নিয়ে শরিফ সওদাগর দোকানটা খুলে দিল। বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসা সদাই-পাতিগুলো কোন রকমে দোকানে ঢুকিয়ে দিয়ে জাকিরকে হাটতে সাহায্য করছিল সে।
আজিয়ে আর দোয়ান গরন ন পরিবো, ঘরত যাই বিশ্রাম ল গই
হ বদ্দা শরীলের কাপনি ত কোনমত ন থামের, কেন গইত্তাম..
হইয়ে ত , আল্লাহ ত বাচাই আইন্নে। এখন যঅ, নামাজ কালাম পরি আল্লাহর কাছে শোকর আদায় গর গই আর বিশ্রাম ল গই।
ঐ করিম্মা, আঁই জাকির ভাইয়ের হোয়ারে যাইর, ভালা গরি হাডিত ন পারের। তুই দোয়ান চালাইচ
আর কিছু লইবা না জাকির ? জাকিরের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে জিজ্ঞেস করল শরীফ
বদ্দা ক্যাশ পেডির নিচেত্তুন আর সম্পত্তিগান এককেনা লঅ না
কী সম্পত্তি আবার
বদ্দা ছোড থইলে ইবাত ঘরল্লাই কিছু বাজার গইজ্জিদি, রেডিওগান এক্কানা থইলের ইবার ভিতরে ঢুকাই দঅন.
ঠিক আছে, চলঅ..
শরীফ সওদাগর তার কাধে জাকিরের হাতটা ধরিয়ে দিয়ে আগলে আগলে তাকে বাড়ীতে পৌছে দিয়েছে। পথে হাটতে হাটতে জাকিরের কাছে ঘটে যাওয়া ঘটনার একটু আধটু জেনেছে শরীফ। কিন্তু জাকিরের ভয়ার্ত কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছিল তার কষ্ট হচ্ছে তাই আর বেশি ঘাটায় নি, পরে এক সময় জেনে নেওয়া যাবে এই ভেবে। আগে লোকটা একটু সুস্থ হয়ে উঠুক।
রাত আটটা পেরিয়ে গেছে, পুরো গ্রাম যেন আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ছে। দেয়ং পাহাড়ের গোড়ার দিক থেকে মাঝে মাঝে শেয়ালের হুক্বা হুয়া ডাকও ভেসে আসতে শুরু করেছে। পুরো গ্রামে যেন পিনপতন নীরবতা শুধু একজনের চোখে ঘুম নেই। চোখ থেকে কিছুতেই যেন মুছতেছেনা জাকিরের সেই আকুতির দৃশ্য। হানাদার সৈন্যগুলো যখন লাইন করে দাড় করিয়েছিলো, জাকির ভেবেই নিয়েছিল সেদিনই তার হায়াত শেষ গেছে হয়তো। শুয়োরগুলো কোন কথাই শুনতে চায় না। ভাগ্যিস কমান্ডারটা এসে নাবিক পরিচয়পত্রটা দেখেছে তার। সরকারি পরিচয় পত্র দেখে জাকিরকে ছেড়ে দিয়ে নৌকায় তুলে দিয়েছে কমান্ডারটা। জাকির নিজে বেঁচে আসলেও নৌকায় কিছুদুর এগুতেই যখন গুলির শব্দ শুনল, তখনই বুঝতে পেরেছিল বাকি লোকগুলোকে গুলি করে মারা হয়েছে। সেই গুলির শব্দও যেন কিছুতেই মোছা যাচ্ছেনা তার কান থেকে। ক্ষণে ক্ষণে সেই শব্দেরই অনুরনণ জাকিরকে পূণঃ পূণঃ হতচকিত করে তুলছিল ফলে সে বারবার ছট ফট করে উঠছিল। পাশে শুয়ে আছে তার স্ত্রী আর ছোট ছেলেটা, সামনের ঘরে বড় ছেলেটা সহ শুয়ে আছে তার খালা। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন লোকের হেটে আসার পায়ের শব্দ শুনতে পেল সে, ভাবতে ভাবতেই দরজায় খট খট করে আওয়াজ। শব্দ শুনে লাফিয়ে উঠে বসে জাকির, এই গ্রামেও কি তাহলে পাকসেনা ঢুকে পড়ল, জাকিরের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ঘরের পিছনদিকে বেরিয়ে যেতে ইঙ্গিত দিল সে। তার স্ত্রী উঠে গিয়ে বাচ্চাদেও নিয়ে চুপি চুপি ঘরের পিছনের দরজায় গিয়ে দাড়াল খালা সহ, অপেক্ষোয় রইল জাকিরের ঈশারার। ঘরের পিছনে পুকুর পাড়ের ঝোপে গিয়ে লুকিয়ে পড়বে যদি স¦ামী ইঙ্গিত দেয়।
দরজায় আবার খট খট কওে শব্দ। আল্লাহর নাম মুখে নিতে নিতে জাকির ভাবল ধরা এবার পড়েই গেছে, আর বুঝি রক্ষা হলো না। বউকে ঈশারা দিল বেরিয়ে যেতে, আর নিজে প্রস্তুতি নিল কিভাবে সামলাবে পরিস্থিতি। অন্ধকার ঘরের বেড়ার ফোকার দিয়ে একবার দেখার চেষ্টা করলো সে। বাইরে বেশ চাঁদের আলো কিন্ত দরজার সামনে জড় হয়ে থাকা লোকগুলোকে চিনতে পারা যাচ্ছিল না। জীবনের শেষ সময়টা পাড়ি দেওয়ার চিন্তায় মগ্ন হল জাকির। এবার তার নাম সহ ডাক শুনতে পেল জাকির, কিন্তু কন্ঠটা যেন চেনা চেনা..
জাকির ভাই, অ জাকির ভাই, ঘুমিয়ে গেলেন নাকি
এতক্ষণে কালেমা, দোয়া ইউনুচ পড়া শেষ হয়ে গেছে তার। তাদের মুখে ‘জাকির ভাই’ ডাক শুনে বেশ আশ্চর্যনি¦ত হল জাকির। তবুও উত্তর দেয়ার আগে বেড়ার ফাঁক দিয়ে আরেকবার দেখে নেয়ার চেষ্টা করল সে। লোক গুলোকে পাকসেনাদের মত মনে হল না। তারপরও নিজেকে কিভাবে বিশ^াস করাবে সে..
জাকির ভাই, আমি মুক্তিযোদ্ধা মাসুম, আমরা কয়েকজন আপনাকে দেখতে এসেছি। দরজা খুলুন, ভয় পাইয়েন না। এতক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচল জাকির ।
জি¦, জি¦ মাসুম ভাই আসছি, বলেই দরজা খুলে দিল জাকির।
কী ব্যাপার জাকির ভাই, আপনাকে নাকি হানাদার পাক সেনারা ধওে ফেলেছিল আজ ? জাকিরের মুখ দিয়ে আসলে কোন কথা বেরোচ্ছে না দেখে মাসুম আবার বলে উঠল
যাক আল্লাহর রহমতে বেঁচে ত আসলেন, আর ভয়ের কোন কারন নাই। শহরে বাজার সদাই করতে গেলে একটু সাবধানে থাকবেন। সবাইকে ঘরের ভিতরে এসে বসার জন্য আমন্ত্রণ জানাল জাকির, কিন্তু মাসুম সাথে সাথে বলে উঠল..
বাইরে বেশ চাঁদের আলো, একটা পাটি নিয়ে আসেন সবাই একসাথে উঠোনে বসি। আজ ঘাটে টহলের কাজ ছিল, ভাবলাম আপনার রেডিওতে কিছু শুনবো। কিছুক্ষণের মধ্যে আজকের ‘চরমপত্র’ ত শুরু হবে, দেন দেন রেডিওটা দেন সবাই গোল হয়ে বসি।
পাটি বিছিয়ে সবাই উঠোনে রেডিও নিয়ে বসে গেল। জাকির সব খুলে বললো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, কিভাবে তার জীবন রক্ষা পেল আর কিভাবে নিরীহ মানুষগুলো ঐ শুয়োরের বাচ্চ্গুলে গুলি করে শহিদ করে দিল। শুনে মুক্তিযোদ্ধারা সান্তনা জানাল জাকিরকে, অতঃপর গোল হয়ে বসে পড়ল চরমপত্র শোনার জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে মাসুম আবার বলে উঠল..
আমাদেরকে আপনার ঘর পয্যন্ত যখন আসতে হলো, আপনার কিন্তু জরিমানা দিতে হবে। জাকির চোখ বড় বড় করে তাকালো মাসুমের দিকে, এবার মাসুম মুচকি হেসে আবার বলে উঠলো
আরে ভাবিকে বলেন আমাদের জন্য লেবু চা বানাতে, এটাই আপনার জরিমানা। রেডিও শুনতে শুনতে লেবুচাটা বেশ লাগবে কিন্তু… বলতেই সবাই সমস্বরে হেসে উঠল।