মাগরিবের আজান হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে কিন্তু তাও আশরাফ সাহেব আজ পার্কে বসে আছেন। মশার কামড়ে চুলকাতে চুলকাতে হাত- পায়ে চাকা চাকা দাগ হয়ে যাচ্ছে, তবু্ও আজ তাঁর উঠতে ইচ্ছে করছে না।
কী হবে উঠে? সেই তো বাড়িতে গিয়েই ঢুকতে হবে!
নিজ বাড়িতে তো আজ উনি নিজেই পরবাসী! আজ আর ওদের মুখোমুখি হতে একদম ইচ্ছে হচ্ছে না আশরাফ সাহেবের।

শেষ পর্যন্ত সন্তানের কাছে আজ আমি গলগ্রহ হয়ে গেলাম? সারাজীবন ত্যাগ স্বীকারের এই পুরস্কার? সে না হয় পরের বাড়ির মেয়ে, আমার কষ্টকালের কথা কিছু জানেনা, কিন্তু তুই? তুই তো আমারই ঔরসজাত, সব জেনেশুনে তুই কি করে আমার সাথে এমন ব্যবহারটা করতে পারলি? পিতার উদ্দেশ্যে অবলীলায় এমন রূঢ় শব্দটা উচ্চারণ করতে পারলি বাপ ?
তাহলে কি আমার সারাটা জীবন তোর নামে উৎসর্গ করে দিয়েও মাতৃহারা তোকে সত্যিকারের একজন মানুষ করে গড়ে তুলতেই পারিনি?
পিতা হিসেবে এতটাই ব্যর্থ আমি !

ভাবতে গিয়ে চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে আশরাফ সাহেবের।
সব, সবকিছুই ভুলে গেলি বাপ আমার!

যখন তোর মা মারা গেল তখন তুই সাত বছরের। সারাক্ষণ আম্মুকে কোথায় নিয়ে গেল, আম্মুকে নিয়ে এসো… এসব বলে বলে আমায় অস্থির করে তুলতিস।

তখন কি এমন ছোট ছিলি বাবা যে, আজ তোর কিছুই মনে নেই কিভাবে হাজারো দুঃখ – কষ্ট সয়ে তোকে একা হাতে মানুষ করলাম?
তবে কি তোকে সৎমা দেবোনা বলে দ্বিতীয়বার বিয়ে না করাটা আমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?

আজ আমার পেনশন নেই। তোদের পয়সায় দুবেলা দুমুঠো খেতে হচ্ছে বলে আমি গলগ্রহ?

পেনশন নেই কেন আমার তাতো তোর অজানা নেই। তারপরেও উঠতে- বসতে কথা শোনাস তোরা আমায়।
সরকারি চাকরি ছিলো আমার। অবসরে যাওয়ার পর ভালো পরিমাণের একটা টাকা তো আমার হাতেও আসার ছিলো, যা দিয়ে আমার শেষ জীবনটা ভালোভাবেই কেটে যেতো। কিন্তু হয়নি। কেন হয়নি তাও তোর স্মরণে আছে নিশ্চয়ই।

তোর তখন ক্লাস এইট। অজ পাড়াগাঁয়ে বদলি হলো আমার।
যেখানে প্রতি তিন বছর অন্তর বদলি হয়, সেখানে আমি ছেলের কষ্ট হবে এই অজুহাতে টানা দশ বছর ঢাকায় ছিলাম। আমার বস মানুষটা খুব ভালো ছিলেন। উনি বুঝতেন, একজন পিতা একাহাতে কত কষ্ট করে তার ছেলেকে বড় করে তুলছে!
উনি অবসর নিলেন, আর আমারও কপাল পুড়লো। নতুন বস ভীষণ কড়া টাইপের মানুষ। নিয়মের বাইরে এক পাও ফেলেন না। উনি এসেই আমার বদলির ব্যবস্থা পাকা করে ফেললেন।

ঐ পাড়াগাঁয়ে তোর পড়াশোনা ঠিকমতো হবে না বলেই তো সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি এক কোম্পানিতে চাকরি নিলাম।
আমার একটাই সন্তুষ্টি ছিলো তখন, চাকরির ভবিষ্যৎ যা ই হোক না কেন, ঢাকায় তো থাকতে পারবো! আমার আসল ভবিষ্যৎ, আমার ছেলেটার পড়াশোনাটা তো ভালোভাবে হবে!

না, তোর পড়াশোনা নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। ছোট থেকেই তুই যেমন বাধ্য ছেলে, তেমনই ছিলি মেধাবী ছাত্র। আর
সেজন্যই তো আজ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এত বড় পদে সরকারি চাকরি করছিস।

ভালো চাকরি, সুন্দরী বউ, মিষ্টি একটা ছেলে নিয়ে আজ তোর সুখের সংসার। দেখেও আমার শান্তি!

কিন্তু তোর এই সুখের সংসারে আমার জায়গা কোথায় বাবা? একদিন সকালে সময়মতো উঠে বাজারে যেতে পারিনি বলে তোদের মাথা গরম হয়ে গেলো?
আর আমার আজ কদিন ধরে যে রাত হলেই জ্বর আসছে সেই খবরটা তো তোরা কেউ রাখিস না।
আমার একটা দিন বাজার না করার অপরাধটা কি মাফ করে দেওয়া যেতো না? তাও তো দাদুভাইকে স্কুলে দিয়ে আসার জন্য আমি তৈরি হয়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু তোরা তো রাগ দেখিয়ে দাদুভাইয়ের স্কুলটাই কামাই করিয়ে দিলি।

তোর মনে আচ্ছে আব্বু, রোজ সকালে আমরা বাপ- বেটা দুজনে মিলে হাতে হাতে সবকিছু করে তৈরি হয়ে বেরোতাম? তোকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে যেতাম।

তখনো অফিসে দারোয়ান, বেয়ারারা কেউ আসতো না বলে আমি অফিসের সামনের এক চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে ঐ একঘন্টা কাটাতাম। তোর খালামনি তার ছেলের সাথে স্কুল থেকে তোকেও সাথে করে নিয়ে যেতো তার বাসায়, আর আমি অফিসফেরত তোকে নিয়ে যেতাম।
আমরা বাপ- বেটায় কিন্তু বেশ সুখেই সেসব দিনগুলো কাটিয়ে ছিলাম!
মাতৃহীন পুত্র আর বিপত্নীক পিতা, খুব মেলবন্ধন ছিলো আমাদের, বল?
ছুটির দিনগুলোতে এক -আধটু বাইরে ঘুরতে গেলেও বাকী দিনগুলোতে তো আর সম্ভব ছিলনা, তাই আমাদের বাপ- ছেলের একমাত্র বিনোদন ছিল রাতে সব কাজকর্ম সেরে ছাদে মাদুর পেতে শুয়ে শুয়ে আকাশে নক্ষত্রদের মাঝে তোর মাকে খোঁজা।
এভাবেই একদিন তুই বড় হয়ে গেলি আর আমি বুড়ো হয়ে গেলাম!
শিশুবেলা থেকে যে দুটো শক্ত হাত ধরে তোর বড় হয়ে ওঠা, আজ তার বুড়োবেলার অশক্ত হাতদুটো ধরতে তোর এতটা কার্পণ্য কেন বাবা?
আমি বারান্দায় বসে তোদের দুজনের ঝগড়া শুনলাম। এটাও শুনলাম, সারাজীবন এই ‘গলগ্রহ’ টাকে নিয়েই তোদের বাস করতে হবে!
না বাবা, আর না! অনেক হয়েছে! তোরা সুখে থাক।
এই পৃথিবীতে কত মানুষই তো আছে যারা গৃহহীন, স্বজনহীন- আজ থেকে আমিও না হয় তাদের কাতারেই সামিল হলাম!
এই খোলা আকাশের নীচের জীবনটাকেই বেছে নিলাম!
কথিত আছে, পিতা -পুত্রের নাকি অবিচ্ছেদ্য মানসিক বন্ধন!
তাই যদি হয়, তাহলে মনের মধ্যে গুমরে মরা আমার ঝরাবেলার এই ভাষাবিহীন কথাগুলো একদিন না একদিন তোর মনে পৌঁছে যাবে ঠিক ঠিক!