প্রচলিত আছে জোড়া শালিক পাখি দেখলে দিন ভালো যায়। তবে একটা শর্ত আছে। দুইটাই পুরুষ অথবা দুইটাই নারী শালিক দেখলে হবে না। এদের মধ্যে একটা পুরুষ ও অন্যটা নারী শালিক পাখি হতে হবে। ইফাদ সাহেবের ধারণা দুইটা শালিক পাখির মধ্যে একটা নারী ও একটা পুরুষ শালিকই হবে। রোজ দুপুর বেলায় কোত্থেকে যেন দুইটা শালিক পাখি অতিথি হয়ে তার বারান্দায় আসে। তিনি কিছুটা বিস্মিত হলেন।

একদিন বিস্মিত কণ্ঠে তার স্ত্রীকে বলেন,
“একটা জিনিস খেয়াল করেছ?”
“হ্যাঁ, ঠিক দুপুর বেলায় দুইটা শালিক পাখি আমাদের বারান্দায় এসে বসে। এরা অন্য কোনো সময়ে আসে না। ঠিক দুপুর সময়টায় আসে।”

তিনি বলার আগেই বিরস কণ্ঠে জবাব দেন রেনু। ইফাদ সাহেব দ্বিতীয় বারের মত বিস্মিত হলেন। যদিও তিনি জানেন রেনুর চোখ থেকে কোনো কিছু এড়ায় না।

“তোমার অবাক লাগছে না?”
“নাহ। অবাক লাগার বয়স আরো ২৫-৩০ বছর আগে পার করে এসেছি।”

মুখের উপর এমন উত্তর শুনে ইফাদ সাহেব নিজের বিস্মিত ভাবটা গিলে ফেললেন। তিনি ঘরের জানালা দিয়ে লাগোয়া বারান্দায় তাকালেন। দুপুর দুইটা বাজতে চলেছে। এখনই শালিক পাখি দুইটা এসে বারান্দায় বসবে।

.

শালিক পাখিগুলোর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করছেন ইফাদ। ইফাদ সাহেবের পাগলামিতে কিছুটা বিরক্ত হলেও রেনু মুখে কিছু বললেন না। মানুষটার অবসরটা যদি এই পাখিগুলোকে নিয়ে কাটে তো কাটুক না। ক্ষতি কী?

ইফাদ ঘরে এসে জানালার সামনে বসে রইলেন। তাকে দেখলে পাখিগুলো হয়ত খাবে না। কিছুক্ষণ বাদেই পাখিগুলাও এসে বারান্দায় বসলো। আজকে তাদের জন্য খাবার আর পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাখিগুলো খাচ্ছে। ভীষণ আনন্দ অনুভব করলো ইফাদ।

“তোমার শুধু বয়সটাই বেড়েছে। এখনো সেই বাচ্চাটিই রয়ে গেছ।”
কাপড়গুলো ভাজ করতে করতে কথাগুলো বললেন রেনু।
ইফাদ স্ত্রীর দিকে তাকালেন না। না তাকিয়েই উত্তর দিলেন,
“পাখিগুলো কী সুন্দর খাচ্ছে, দেখো!”
রেনু সেদিকে একবার তাকালেন। কিন্তু জবাব দিলেন না। বুড়ো বয়সে বাচ্চামিকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না।
রেনু বললেন,
“খেতে চলো।”
“আসছি একটু পর।”

“বাবা, তুমি কি এখন শালিক পাখির সাথে সাথে কুকুরও পুষতে শুরু করেছ?”

ছেলে আরাফ এর আওয়াজে ঘুরে তাকালেন তিনি। একদিন মসজিদ থেকে আসার পথে এই কুকুরটাকে তিনি রুটি কিনে দিয়েছিলেন। কুকুরটা সেদিন তার পিছু পিছু বাসা পর্যন্ত চলে এসেছিলো। এরপর থেকে প্রায়ই কুকুরটা এখানে আসে। তবে রেনুর কড়া হুকুম কুকুরকে ঘরের ভিতরে আনা যাবে না।

আরাফকে উদ্দেশ্য করে ইফাদ সাহেব বললেন,
কুকুররা মানুষের চাইতে বেশি বিশ্বাসী হয় জানিস তো? আর দেখ মাত্র একদিন রুটি খাইয়েছি তাতেই আমার পিছু ছাড়ছে না।”
“মা কিন্তু খুব রাগ করবে, বাবা। মায়ের কুকুর পছন্দ না।”
বাঁকা হেসে ইফাদ সাহেব বললেন,
“ছাড় তো তোর মায়ের কথা। তোর মায়ের তো আমাকেই পছন্দ না।”
“এটা কিন্তু ঠিক না বাবা। মা তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে।”
“কুকুরটার জন্য একটা নাম ভাবা দরকার। কী নাম দেয়া যায় বল তো।”
আরাফ কিছুটা রেগে বলল,
“জানি না।”

একদিন বড় সাহসিকতার কাজ করে ফেললেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বাসার মূল ফটক খুলে অর্ধভেজা কুকুরটাকে বাসায় ঢুকতে দিলেন।

“তুই তো পুরো ভিজে গেছিস রে। আয় ভিতরে আয়।”
কুকুরটাও লেজ গুটিয়ে ভিতরে চলে আসলো। রাগে রেনু কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল।

“গত দুইদিন ধরে কুকুরটা আসছে না কেন? কুকুরটার সাথে কি ঝগড়া করেছ?”
বিদ্রুপের স্বরে ইফাদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন রেনু।
“জানি না কেন আসছে না। কোথায় কোথায় থাকে কে জানে!”
“ওহ।”
“তোমার মায়া হয় না ওদের জন্য?”

ভীষণ মায়া হওয়া সত্ত্বেও কেন যেন রেনু সেটা প্রকাশ করতে পারলেন না। তার বিশ্বাস ‘মায়া প্রকাশ করতে হয় না। মায়া প্রকাশ করলেই তারা হারিয়ে যাবে।” তিনি যখনই প্রকাশ করে ফেলবেন কুকুরটার প্রতি কিংবা জোড়া শালিক পাখিগুলোর প্রতি তার মায়া জন্মে গেছে এরপর থেকেই আর ওরা আসবে না। কেন এই ধারণা হলো কে জানে!

মুখে যথাসম্ভব বিরক্তিভাব এনে তিনি বললেন,
“ঘরটাকে চিরিয়াখানা বানিয়ে ফেলছ দিন দিন।”
ইফাদ সাহেব হাসলেন।
“খাবার নিয়ে আসছি। খেয়ে নাও। এরপর তো ঔষধ গুলো খেতে হবে।”
“ইচ্ছে করছে না এখন।”
রেনু ইফাদ সাহেবকে কিছু বললেন না। রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে ছেলের হাতে খাবারের প্লেটটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“বাবাকে খাইয়ে দিয়ে আয়। আমার একটু কাজ আছে। কাজগুলো সেরে আসছি।”
আরাফকে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতাশার ভঙ্গিতে ইফাদ সাহেব বললেন,
“তোকে পাঠিয়েছে?”
“হ্যাঁ। এখন লক্ষী ছেলের মত খেয়ে নাও তো।”
বাবার পাশে বসে ছোট এক লোকমা বাবার মুখে তুলে দিলো আরাফ। তিন নাম্বার লোকমাটা মুখে নিয়ে বসে রইলেন ইফাদ সাহেব। হঠাৎ তার মাথাটা ঢলে পড়লো আরাফের কাধে। ঘটনার আকস্মিকতায় আরাফের হাত থেকে ভাতের থালা টা পড়ে গেল। শেষ লোকমাটা বাবার মুখেই থেকে গেল। সেটা আর পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।
শালিক পাখিগুলোর জন্য রাখা বাটিটায় খাবার দিলেন রেনু। চারদিন খাবার দেয়া হয়নি পাখিগুলোকে। পাখিগুলো এসেছিলো কিনা সেটাও খেয়াল করেননি। বাটিটায় খাবার আর পানি দিয়ে তিনি রুমের ভিতরে এসে বসলেন। তিনি বারান্দায় থাকলে হয়ত পাখিগুলো আসবে না।
অধৈর্য হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালেন রেনু। তিনটা বাজতে চলল। অথচ পাখিগুলো আসেনি।
রেনু তবুও বাটিটায় নষ্ট হয়ে যাওয়া আগের খাবার ফেলে দেন। নতুন খাবার দেন। কুকুরটা এসেছে কিনা সেটা জানার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তায় উঁকি মারেন। কিন্তু সেদিনের পর থেকে জোড়া শালিক কিংবা কুকুর কেউই আর আসেনি। কেন আসেনি এই উত্তর কেউ জানে না।