ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মানুষ তার নিজ সংস্কৃতিকে আপন করে নেয়।সেই সংস্কৃতিকে আনন্দের সাথে ভাগাভাগি করে কিছু উৎসবের মাধ্যমে।প্রতিটি জাতি তাদের সংস্কৃতির মাধ্যমে খুঁজে পায় নিজস্ব অনুভূতিগুলোকে।বাঙালি জাতি হিসেবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার অন্যতম এক উৎসব হল পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ।
আমরা সবাই প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ খুব আড়ম্বরের সাথে পালন করে থাকি।এই উৎসবকে ঘিরে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের।কিন্তু আমরা অনেকেই কখনো জানি না বা জানার চেষ্টা করি না এই পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে।চলুন সংক্ষেপে জেনে নেয়
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস:
ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত।কিন্তু এই হিজরী সন গননা চাঁদের উপর নির্ভর করত বলে তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না।এই জন্য কৃষকদের অসময়ে খাজনা পরিশোধ করতে হত তাই খাজনা আদায়ের সমতা প্রণয়নের লক্ষে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।
মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিঃ এর ১০ বা ১১ মার্চ থেকে থেকে সন গননা শুরু করেন।সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকে পহেলা বৈশাখ উৎযাপন শুরু হয়।তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকলকে খাজনা,মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত।এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসিদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হত যা পরে সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।পরে ৬০ এর দশকে বেশ ঘটা করে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা শুরু হয় এবং ১৯৮৯ সালে ঢাবির চারুকলা বিভাগের উদ্যোগে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়।এই চৈত্র সংক্রান্তি বা বর্ষবরণ উপলক্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের সাংস্কৃতিক বা আঞ্চলিক অনুষ্ঠান আজো পালন করে আসছে।
নববর্ষ উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামীণ সাধারণ লোকের কাছে এই দিনটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।আমাদের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মধ্যেও এই উৎসব বেশ ঘটা করে পালিত হয়।পহেলা বৈশাখের সাথে চৈত্র সংক্রান্তির পার্বণও জুড়ে আছে বাঙালি সংস্কৃতিতে, তাই চৈত্র সংক্রান্তির কথা উল্লেখ না করলে নয়।বিশেষ করে গ্রাম-গঞ্জে ও আদিবাসী মধ্যে চৈত্র সংক্রান্তি ঘিরে রয়েছে অনেক লোকজ সংস্কৃতি যা বাংলার কৃষ্টি আজো ধরে রেখেছে নির্দিধায়। এই সংক্রান্তিতে চড়ক পূজা নামে এক বিষেশ পূজারো প্রচলন আছে অনেক গ্রামেগঞ্জে। এই দিনে অনেকে রীতি অনুযায়ী বিভিন্ন পদের সব্জি দিয়ে পাঁচন তৈরী করে থাকে আরো থাকে নাড়ু, মোয়া, পিঠা-পুলি।ঘরের দুয়ার বিয়ু ফুল নামক এক বিশেষ ফুলের মালা ও নিমপাতা দিয়ে সাঁজানো হয়।অনেকের মতে এতে বিভিন্ন সংক্রামক জাতীয় রোগ প্রতিরোধ হয়ে থাকে।হয়ে থাকে গ্রামীণ লোকজ খেলা ও মেলা।কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এসব আচার নিয়মগুলো যুগের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে শহুরে জীবন থেকে দূরে চলে বললেই চলে।আমরা ছোট বেলায় যেভাবে উৎসব দেখতাম ও আনন্দে মাততাম আজ আর সেই আমেজগুলো নেই।এখন শহরে অন্যভাবে বিভিন্ন জায়গায় একদিনের জন্য পহেলা বৈশাখের উৎসব পালিত হয়।তবুও বলব তখনকার গ্রামীন আমেজের সাথে এখনকার উৎসব অনেক ভিন্নতর ও তফাৎ রয়েছে।যেটা এই প্রজন্ম পরিচিত হতে পারছে না।
আরো একটা বিষয় হল, এই পহেলা বৈশাখ ঘিরে বেশ কিছু বছর যাবৎ ইলিশ-পান্তা খাওয়ার যে প্রচলন হয়েছে তার ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি নেই।বাঙালির নিজস্ব হুজুকে প্রচলনের কারন মাঝখান থেকে ইলিশের বাড়তি চড়া দাম হাকিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা হয়।বাঙালি হিসেবে আমাদের আদি সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে রক্ষা করাটা বিশেষ ভাবে জরুরী।অপঃপ্রচলনের মাধ্যমে অন্যায়কে পশ্রয় দিয়ে উৎসাহিত করা কোনভাবে কাম্য নয়।বাংলার ঐতিহ্য বেঁচে থাকুক আজীবন আমাদের মনে প্রাণে।