কয়েকদিন ধরে আকাশভাঙ্গা বৃষ্টিতে গরম কিছুটা কমলেও শহরের বিভিন্ন এলাকা এখনও জলমগ্ন। আজ সকাল থেকে বৃষ্টি থামায় পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুরে মোবাইলটা বেজেই চলছে। বর্ণা বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরলো,’হ্যালো’।
সকালে ঘরের হাজারটা কাজ শেষ করে মেয়েকে সময়মত স্কুলে পৌঁছে দেওয়া। নিজের স্কুলে যাওয়ার তাড়া।
আমি চকবাজার থানার পুলিশ বলছি। আপনাকে এক্ষুনি একবার হাসপাতালে আসতে হবে।
এটাতো আমার ফুলদির নাম্বার, আপনি কোথায় পেলেন? আমার বোন কোথায়?
আপনি আসলেই জানতে পারবেন।
বর্ণার বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল। ফুলদির কোন সমস্যা হলো নাতো!
দাদাবাবু কোথায়?
নাহ্, দাদাবাবুকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।
মেয়েকে আর স্কুলে নিয়ে গেল না।
নিজের স্কুলে ফোন করে জানিয়ে দিল, তার আসতে একটু দেরি হবে।
একটা রিক্সা নিয়ে রওনা দিল। বর্ণার বাসা থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের দূরত্ব মাত্র দশ মিনিটের। কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা। মেঘলা আকাশ জানান দিচ্ছে যখন তখন আবার ঝাঁপিয়ে নামতে পারে বৃষ্টি। রাস্তায় রিক্সা চলছে আস্তে আস্তে। ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে বর্ণার গায়ে।
প্রবর্তকের মোড়ে এখনও অনেক জায়গায় পানি জমে আছে। নিত্য যাত্রীদের কষ্টের সীমা নেই। স্কুল ইউনিফর্ম পরে চুলের দুটি বেণী সামনের দুদিকে ঝুলিয়ে দু’জন ছাত্রী রিক্সা করে যাচ্ছে। আকৃষ্ট হয়ে দেখছে বর্ণা। সে আর দিদি একসময় এভাবেই পাথরঘাটা থেকে সেন্ট স্কলাস্টিকাস গার্লস স্কুলে যেত। মা তাদের চুলে সুন্দর বেণী করে দিত। দু’বোনকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে থাকত, যতক্ষণ তাদের রিক্সা চোখের আড়াল না হচ্ছে।
আচ্ছা তারা দু’জনও কি বোন, নাকি বন্ধু?
দুই বোনের মধ্যে বর্ণা ছোট, স্বর্ণা বড়। তিনদিন আগে স্বর্ণা গেছে ঢাকায়, ওর বন্ধুর দেওরের বিয়েতে। বাস ছাড়ার আগে গরিবুল্লা শাহ মাজারের ওখানে গ্রীনলাইন কাউন্টার থেকে তাকে ফোন দিয়েছিল।
চিন্তা করতে করতে পৌঁছে গেল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেইন গেইটের ভিতরে।
রিক্সা থেকে নামতেই কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ দেখতে পেল। ওর টেনশন আরও বেড়ে গেল।
ছোটকাল থেকেই পুলিশ দেখলেই অহেতুক ও ভয় পায়। দু’জন পুলিশ ওর দিকেই এগিয়ে আসছে।
ফুলদির কোন বিপদ হয়নিতো!
সাহস সঞ্চয় করে, এক্সকিউজ মি, আমাকে চকবাজার থানা পুলিশ আসতে বলেছিল।
আমিই ফোন দিয়েছি আপনাকে। একটা লাশ শনাক্ত করতে হবে।
বর্ণা উচ্চস্বরে, লাশ!
আপনাকে যে নাম্বার থেকে ফোন দিয়েছি, তার।
কান্নাজড়িত কন্ঠে, ওটা আমার বোনের নাম্বার।
সরি, উনি চট্টগ্রাম -ঢাকা মহাসড়কে টেক্সি এক্সিডেন্টে প্রাণ হারিয়েছেন।
বুক ফাটা আর্তনাদ করে উঠল, না, অসম্ভব।
আমার ফুলদি ঢাকায় গেছেন। আমার সাথে বাসে উঠার আগেই কথা হয়েছে।
আপনি আসেন।
লাশঘরে রাখা আগাগোড়া মোড়ানো লাশটির কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বিকৃত লাশ।
বর্ণার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমিতো কিছুই চিনতে পারছি না। ওটা আমার দিদির লাশ হতেই পারে না।
আপনি আমাকে হাত দুটো দেখান।
না না, লাশটি প্যাকেট করা আছে, খোলা যাবে না।
আপনি আত্মীয় স্বজন সবাইকে খবর দেন।
বর্ণা কিছুই বুঝতে পারছে না, কিভাবে কি হয়ে গেল! মাবাবাবিহীন এই পৃথিবীতে ওরা দু’বোন একজন আরেকজনের প্রাণ।।
বর্ণা বারবার দাদাবাবুকে ফোন দিয়েও পেল না।
মনে হয় বরাবরের মত তিনি অফিসের কাজে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় আছেন,
দুর্বল মোবাইল নেটওয়ার্ক, তাই হয়তো কল ঢুকছে না।
অগত্যা বর্ণা আর ওর স্বামী রবি লাশ গ্রহণ করে।
চার দিন পর স্নিগ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকা পার হলে মোবাইলে স্বর্ণাসহ অনেকগুলো মিস কল দেখে ভাবলো, বাসায় পৌঁছে স্বর্ণাকে সারপ্রাইজ দিব। আগামীকালের পরিবর্তে আমাকে আজ দেখে নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবে।
ভাবতে ভাবতেই বর্ণার ফোন, হ্যালো বর্ণ?
বর্ণাকে ছোট বোনের মত আদর করে বর্ণ ডাকে স্নিগ্ধ।
কান্না করতে করতে সব শেষ হয়ে গেছে দাদাবাবু। আপনাকে গতকাল থেকে পাচ্ছি না।
উদ্বিগ্ন কন্ঠে, কি হয়েছে? কোন সমস্যা?
আপনি তাড়াতাড়ি বাসায় আসেন।
তোমার দিদি!

বর্ণা ফোন কেটে দেয়।
স্নিগ্ধ মোবাইলে বারবার স্বর্ণাকে ফোন দিয়ে পায় না।
নিশ্চয়ই ঢাকা থেকে এসে ঘুমাচ্ছে, ফোনে চার্জ দিতে ভুলে গেছে।
মাথায় হাত দিয়ে গাড়িতে বসে আছে। বাসের ঠান্ডা এসিতেও তার গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে।
রাস্তার দু’পাশে সাদা কাশ ফুলের মিষ্টি হাসি শরতের আগমনী বার্তা জানাচ্ছে। স্বর্ণার জন্য মনটা হু হু করে উঠল। স্বর্ণা খুব খুশি হত, এই ফুল দেখলে। মনে মনে ভাবছে, সামনের মাসে আসার সময় ওকে সাথে করে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু ততদিন এই ফুল থাকবেতো, যেভাবে বৃষ্টি পড়ছে!

বাসার সামনে টেক্সি থেকে নেমে আত্মীয় -স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের দেখে অবাক হয় স্নিগ্ধ। সবাই তার দিকে এগিয়ে আসছে। ওকে ধরে একটা এম্বুলেন্সের কাছে নিয়ে গেল। আগাগোড়া মোড়ানো স্বর্ণার লাশ দেখে জ্ঞান হারাল।
বাস থেকে নেমে রিক্সায় উঠেই স্বর্ণা ভাবছে, শালার ছিনকারী আমার মোবাইলটা ছিনতাই করার আর সময় পেল না! এখন বাসায় গিয়ে আইডি কার্ড খুঁজে বের করা, জিডি করা, সিম কেনা, মোবাইল কেনা, বিরক্তির সীমা নেই। স্নিগ্ধ ও বাসায় নেই। ও থাকলে এ সমস্ত কাজ নিয়ে তাকে চিন্তা করতে হতো না।
রিক্সার ভাড়া মিটাতে মিটাতে দেখছে ফ্ল্যাটের দু’দিকের মাধবীলতার ঝাড় কয়েকদিনের বৃষ্টিতে অপরুপ সাজ এ সজ্জিত হয়ে আছে।
ভিতরে ঢুকতেই, এম্বুলেন্সটা দেখতে পেল।
দাড়োয়ান, কেয়ারটেকার সবাই তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
কি হয়েছে, আমাকে সবাই এভাবে দেখছে কেন?
আমি কি ভূত না অপ্সরা?
কে মারা গেছে? কার লাশ?
কোন উত্তর নেই, কারও মুখে।
ম্যাডাম আপনি বাসায় যান। স্যার বাসায় আছেন।
মনটা খুশিতে নেচে উঠল, স্বর্ণার।
যাক বাবা, স্নিগ্ধ তাহলে একদিন আগেই এসে গেছে। মোবাইল সম্পর্কিত চিন্তা মুহূর্তেই উধাও।
লিফট থেকে নেমে, স্বর্ণা দেখে বাসার দরজা হা করে খোলা, ড্রয়িংরুমের বারান্দায় কামিনী ফুলের গাছটা সাদা ফুলে ঢেকে আছে। ফুলের মিষ্টি গন্ধে চারপাশটা কেমন যেন মাদকতার আবেশে ডুবে আছে। সোফায় আত্মীয়- স্বজন বন্ধু- বান্ধব সবাই স্নিগ্ধকে নিয়ে স্থির হয়ে বসে আছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার; সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, বোয়ালখালী হাজী মো: নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।