স্কুল শেষে প্রতিদিন মায়ের হাত ধুরে বাসায় ফেরে তম্মনা, ফেরার পথে মায়ের কাছে আবদার করে পার্কে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর। স্কুল সীমানার বাইরে মাঠের এক কোনায় কিছু দোলনা,সিমেন্টের তৈরী স্লিপার, বেয়ে উঠার কয়েকটা লোহার কাঠামো শিশুদের আনন্দের খেরাক জোগায়। ২য় শ্রেণীতে পড়ুয়া তম্মনা স্লিপারে পিছলে নেমে আসতে ভয় পায়। অন্য শিশুদের পিছল খাওয়া দেখেই সে আনন্দ পায়, নিজে সিড়ি বেয়ে উঠলেও উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে আবার সে সিড়ি দিয়েই নেমে আসে। মা বুঝতে পারে মনটা খুবই নরম তার। সেদিন একই ভাবে সিড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে দেখে হাতলে একটা ফড়িং বসে আছে। সাথে সাথে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে উঠল
-আম্মু, দেখো দেখো একটা ফড়িং বসে আছে।
-তুই উঠতে থাক, ওটা চলে যাবে।
তবুও সে না উঠে ফড়িংটার দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে থাকলো।উঠছে না দেখে মা বলে উঠলো-
-দাড়া, আমি ফড়িংটা ধরে ফেলি।
মা ভেবেছিলো ফড়িংটা ধরে দিলে হয়তো মেয়েটা আরো খুশি হবে, কিন্তু হলো তার উল্টোটা। তম্মনা তৎক্ষণাৎ মা’কে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো
-এই আম্মু ধরবেনা কিন্তু, ফড়িংটা ব্যাথা পাবে তো। ওটা যদি মরে যায় ?
মাকে অনেকটা গতিরোধ করে দাড়িয়ে থাকার মতো স্লিপারের দিকে না যেতে দুহাতে ঠেলে ধরে থাকলো। মা মেয়ের এই কথা কাটাকাটির মাঝে ফড়িংটা কখন উড়ে গেছে কেউ টের পেলো না। যখন মা বললো
– ঐ দেখ , ফড়িংটা উড়ে গেছে। ওই যে… মা মেয়ে দুজনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।
আজ বাড়ী ফিরে মা রান্না ঘরের দিকে গেল। তম্মনা তার ঘরে গিয়ে বইয়ের ব্যাগটা মাত্র রেখেছে, জানলা দিয়ে দেখলো উঠোনের কোণে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলো হইচই করছে কিছু একটা নিয়ে। সে দেখলো রীমা, দীবা, তুমান, দিনার, করিম, শোভা সবাই শেফাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। সে জিজ্ঞেস করলো
– দিনার, এই দিনার ওখানে কিরে ?
– আপু দেখেন না, শেফা আপু একটা ফড়িং ধরে ফেলেছে, সবুজ লেজওয়ালা ফড়িং, ছোট্ট একটু খানি।
– কি বললি ফড়িং এর বাচ্চা ?
– শেফা আপু, এই শেফা আপু…তৎক্ষণাৎ সে চিৎকার করে উঠলো।
স্কুল ড্রেস খুলতে ভুলে গেল সে, দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের কোণের জটলায় গিয়ে পৌঁছালো। দেখলো শেফা ছোট্ট ফড়িংটার লেজে একটা সুতা বেধে দিচ্ছে। শেফা ৩য় শ্রেণীর ছাত্রী, তার চেয়ে গড়নেও একটু বড়। তবুও সে রাগ মাখা স্বরে বলে উঠলো
– এই শেফা আপু কি করছেন, ফড়িংটার লেজে সুতা বাধছেন কেন ?
– সুতা বেঁধে উড়িয়ে দিলে দেখবি সুতা নিয়ে ওটা উড়ে যাবে।
– আরো এটাতো বাচ্চা ফড়িং, সুতা বাধলেতো ওটা মরে যাবে ।
– আরে মরবে না, আস্তে করে গিট্টু দিচ্ছি
– প্লিজ আপু গিট্টু দিয়েন না, ওটার লেজ ছিড়ে যাবে। লেজ ছিড়ে গেলেতো ওটা আর উড়তেও পারবেনা।
এটা বলেই শেফার হাতটা সুতো থেকে ছাড়িয়ে নিতে হাত ধরে একটা হেচকা টান দিলো সে। কিন্তু কোন কাজ হলো না। শেফা আরো জোরে তম্মনাকে ধমক দিয়ে বলে উঠলো
– যা তুই সর, ওটা আমার ফড়িং।
বলেই তম্মনাকে একটা ধাক্কা মেরে দিল। তম্মনা মাটিতে পড়ে যেতেই দিবা, দিনার , তুমান, আজিম সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠলো। তম্মনা পড়ে গিয়েও শেফার হাত একটা ধরে টানাটানি করতে থাকতে থাকলো, কিন্তু পেরে না উঠে চিৎকার করে কান্নাজুড়ে দিলো। মেয়ের কান্না শুনে রান্না ঘর থেকে দৌড়ে আসলো তম্মনার মা ।
– এই কিরে কী হয়েছে ?
মাটিতে পড়ে থাকা মেয়েকে টেনে তুলতে উদ্যত হলেন তিনি, এর মধ্যে তম্মনার মাকে দেখে একটু ভয় পেলো শেফা, চাচিকে কিছু একটা বলতে গিয়ে হাত ফসকে ফড়িংটা উড়তে শুরু করলো। সবাই হই হই করে উঠলো ফড়িংটাকে উড়তে দেখে। অনেক চেষ্ঠা করছে ফড়িংটা, কিন্তু সুতোর ভারে বেশিদুর যেতে পারলো না। কয়েক ফুট উপরে উঠে অল্পকিছদুর গিয়ে আবার মাটিতে পড়ে গেল। এবার তম্মনার কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেল।
– দেখেছেন. ওটা এখন উড়তে পারছে ? আপনি সুতা বাঁনছেন যে ওটা কষ্ট পাচ্ছে না ?
সাথে সাথে সবাই ফড়িং টা যেখানে পড়েছে সেখানটায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো। তম্মনার মা মেয়ের অবস্থা দেখে আপ্লুত হয়ে গেল, সবাইকে সরিয়ে দিয়ে তিনি সুতো সহ ফড়িংটা তুলে নিলেন। এরপর খুব সতর্কতার সাথে যেইনা সুতোটা খুলে দিলেন অমনি ফড়িং টা ফুড়ুত করে উড়ে গিয়ে এলোমেলো ভাবে উড়তে লাগলো। বুঝাগেল তার ভারসাম্যে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কয়েকবার এলোমেলো উড়ে ফড়িংটা উপড়ে নিচে উঠে নেমে কেমন যেন তিড়িং বিড়িং করে নেচে উঠে উপরে দিকে উঠে যেতে লাগলো। সবাইআকাশের দিকে তাকিয়ে, মা মেয়ের চোখ মুছতেই তম্মনা ফড়িংটার মুক্ত হওয়া দেখে খিল খিল করে হেসে উঠলো।