‘মা আমাকে খাওন দাও, খিদে লেগেছে।’- ‘তোর বাবা আসুক, দেখি কী বাজার করে আনে।’ – ‘বাবা কখন আসে ঠিক আছে মা, বাবা ভ্যান চালিয়ে বাজার আনলে তখন রান্না করবা?’-‘হ মা। আমি কী করবো ? আমার কি টাকা আছে কিছু কিনে আনুম। তোর ভাইজান হয়তো আইসা পড়বো, সে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে পুরানো কাগজপত্র কিনে, আবার বাইরে বেচে, সে দেরি করে না, সন্ধ্যার আগেই চলে আসে।’ এমনি করে মা মেয়েকে সাত্মনা দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু পেটের ক্ষুধা যে কোনো কিছুই মানতেই চায় না। মুনা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে। ভাই আশিক ছিলো অষ্টম শ্রেণিতে। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বনায় জীবন হয়েছে এলোমেলো। আশিকদের বাড়ি ছিলো উত্তরবঙ্গের পদ্মার পাড়ে কোন এক এলাকায়। আশিকের বাবা দিন মজুর। আশিকের মা মানুষের বাসায় গিয়ে কাজকাম করতো। বেশ কষ্টে জীবন কাটলেও কষ্টের মাঝেও এক ধরনের সুখ ছিলো। কষ্টের মাঝেও এগিয়ে নিয়েছে আশিক ও মুনার পড়ালেখা। কিন্তু সর্বনাশী পদ্মার করাল গ্রাস জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে। পদ্মার ভাঙনে ওখানে ওদের কোথাও ঠাঁই পাবার জায়গা হয়নি। টাকা পয়সা সহায় সম্বল যা ছিলো তাই নিয়ে বাঁচার তাগিদে চট্টগ্রামে ছুটে আসে। আশ্রয় নিয়েছে রেল লাইনের পাশে ছোট্ট এক বস্তিতে। পদ্মা পাড়ের সেই অষ্টম শ্রেনির ছাত্র এখন পুরানো কাগজপত্র ক্রয়ের ফেরিওয়ালা। মা মেয়ের এমন কথোপকথনের কিছুক্ষণ পরেই আশিক ঘরে ফিরে। হাতে বাজার। ভাইয়ের হাতে বাজার দেখে ক্ষুধার্ত মুনার মুখে যেন এক টুকরো খুশির হাসি। আশিক মুনাকে ডেকে বলে,‘মুনা ধর, নে পেয়ারা খা, এগুলো আমাদের গরিবের আপেল।’ মুনা খুশি মনে খায়,আর মা আশিকের আনা চাউল চুলার গরম পানিতে ঢালে। আশিক মাকে বলে, ‘মা পুরানো কাগজ পত্র কেনার সময় কতো ভালো ভালো বই চোখ পড়ে, ইচ্ছে করে রেখে দিই।’-‘রেখে দিয়ে কী হবে বাবা?’ – ‘এই দেখো না আমার অষ্টম শ্রেণির বাংলা ও অংকের বই। একজন পুরানো বই হিসাবে হিসাবে বিক্রি করে দিলো, আমি মহাজনের কাছে বিক্রি করি নাই, রেখে দিয়েছি।’ মা অনেক কষ্টে যেন দুঃখ চেপে রাখে। পদ্মার করাল গ্রাস আশিকের বই পত্র সহ সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। মায়ের চোখে ভেসে ওঠে সেই দুঃসহ দিনগুলো। এমন সময় আশিকের বাবার আগমন। বাবা বলে, ‘আশিক বই পত্রের প্রতি আর মায়া দেখাইয়া লাভ নাই, সব বিক্রি করে দে, খিদে আর অভাবের কাছে কোন মায়া নাই রে।’ আশিকের মা বলে,‘রান্না শেষ, সবাই খেতে বসো।’ সবাই ভাত খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে আবার জীবিকার সংগ্রামে বের হয় বাবা ও ছেলে। আজ আশিক পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেশ ভালোই পুরানো কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে। রাত হয়ে গেছে বিধায় সে মহাজনের কাছে তা বিক্রি করতে পারেনি। ঘরেই নিয়ে এসেছে। কাল সকালে মহাজনের কাছে দিয়ে টাকা নেবে। আশিকের একটি স্বভাব পুরানো কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা। আজ ঘেঁটে দেখতে গিয়ে দেখে, কোন এক উকিল সাহেবের মামলার গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। সে তারিখ দেখে অনুমান করে সাম্প্রতিক সময়ের কোন কিছু হবে। ভুল করে হয়তো কেউ পুরানো কাগজ পত্রের সাথে বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু কোথা থেকে এগুলো সে ক্রয় করলো ঠিক মনে করতে পারছে না। কতো জায়গা থেকেই না সে কাগজপত্র কিনলো। সে চিন্তা করে এগুলো ফেরত দেয়া দরকার। বাবাকে কথাটা জানালে বাবা বলে, ‘হ্যাঁ আশিক মনে করে দেখ কোথা থেকে কিনলি, পারলে দিয়ে আয়, ওদের বেশ উপকার হবে।’ পরের দিন আশিক ঐ কাগজগুলো নিয়ে বের হলো,অনুমান করে একজনের বাসায় গেলো, না কাগজগুলো নাকি তার নয়। আশিক পুরানো কাগজপত্র ক্রয়ও করছে, আর মনে মনে এই লোককেও খুঁজছে। একটি বাসার সামনে লেখা একজন এডভোকেটের নাম। হ্যাঁ,এ বাসা থেকেই তো সে কাল কাগজ কিনেছিলো। সাইনবোর্ডটি খেয়ালই করেনি। সেই বাসায় গিয়ে কলিংবেল চাপে আশিক। বিষণ্ন চিত্তে বের হন একজন। বলেন, ‘কী চাই?’-‘ স্যার আমি কাল এখান থেকে কিছু পুরানো কাগজপত্র কিনেছিলাম।’- ‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’ -‘স্যার আমার মনে হয় ভুল করে জরুরি কিছু কাগজ পুরানো কাগজের সাথে ঢুকে পড়েছিলো। আমি এনেছি যদি দেখতেন।’ -‘কই কই? দেখি।’ আশিক উকিল সাহেবের কাছে কাগজগুলো তুলে দেয়। উকিল সাহেব বলেন, ‘হ্যাঁ এগুলোইতো, কাল থেকে কাগজগুলো আমি হন্যে হয়ে খুঁজছি, আমার কর্মচারী ভুল করে পুরানো কাগজের সাথে বিক্রি করে দিয়েছে। তুমি আমার অনেক উপকার করলে বাবা। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’ আশিক উপকার করতে পারলো বলে নিজেকে ধন্য মনে করলো। উকিল সাহেব তাকে বললো, ‘তুমি কতটুকু পর্যন্ত পড়ালেখা করেছো?’- ‘স্যার অষ্টম শ্রেণি। পরীক্ষা দিতে পারি নাই, বাড়ি ছিলো উত্তরবঙ্গে, পদ্মার পাড়ে। পদ্মার ভাঙনে সব শেষ। এখন চাঁটগায় পুরানো কাগজের ফেরিওয়ালা।’ উকিল সাহেব খুশি হয়ে পাঁচশত টাকা বকশিস দিলেন। আশিক নিতে চাইলো না। তারপরও উকিল সাহেব জোর করে পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। যাবার সময় আশিককে বলে,‘তুমি দু,একদিন পর এসো, দেখি তোমার জন্য কিছু করতে পারি কী না। তোমার দায়িত্বশীলতা ও সততায় আমি মুগ্ধ।’ উকিল সাহেব আশিকের অপেক্ষায়, কিন্তু আশিক আর আসে না।