Site icon Shaili Tv

বাংলা নববর্ষ বাঙালির সংস্কৃতির প্রেরণার উৎস/ নেছার আহমদ

প্রতিবছরের ন্যায় আমরা বাংলা সংস্কৃতির শিকড় নববর্ষকে বরণ করতে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু জন্ম শতবর্ষ এবং স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী আমরা ইতিমধ্যে পালন করছি। সাথে সাথে নববর্ষের সাথে আজ থেকে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব এবং সংযমের মাস রমজান শুরু হচ্ছে।
আমাদের বাঙালির সংস্কৃতির প্রধানতম উৎসব “নববর্ষ” উদযাপনের প্রাক্কালে আবারও নতুনভাবে শংকিত হচ্ছি। একদিকে মানবতার চরম সন্ধিক্ষণে মহামারী “করোনার” প্রকোপ বৃদ্ধির কারণে বিশ্ব এবং সারাদেশ আতঙ্কগ্রস্ত। অন্যদিকে মহামারীর ন্যায় ভীষণ বিপদের মাঝে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নতুনভাবে আবির্ভাব পুরো জাতিকে শংকিত করে তুলেছে হেফাজত ইসলামের ব্যানারে ধর্মের নামে সারাদেশে পুনরায় যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতিকে যেভাবে পদদলিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে তাতে আমরা আবারও নতুনভাবে শংকিত হয়ে পড়েছি। সাম্প্রদায়িকতার বিষপাষ্প ছড়িয়ে দেশের বহমান সংস্কৃতিকে কলংকিত করছে মৌলবাদীচক্র। আজ চলমান এ ষড়যন্ত্রকে রুখবার প্রত্যয় নিয়ে জাতি নতুন বর্ষকে বরণ করে নেবে এ প্রত্যাশা অবশ্যই করতে পারি।
আবহমান বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাংলার সাংস্কৃতিক সভ্যতার ধারাবাহিকতা। এ ধারাবাহিকতায় তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সর্বদা তারা ছিল অগ্রগণ্য, মহান সংগ্রামী তিতুমীর, সুবেদার রজব আলী, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়েদেদ্দার, ক্ষুদিরাম হতে শুরু করে সকলেই ছিলেন বাঙালির গর্বে গৌরবাম্বিত মহান সৈনিক। মীর মদন, মোহন লালের আদর্শেই উজ্জীবিত বাঙালিরা তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাঙালিত্ব ও বাঙালি সংস্কৃতিকে রক্ষা করে এসেছে। এক পর্যায়ে ১৯৪৭ সালে ধূর্ত ব্রিটিশ রাজত্বের কপাট ভেঙ্গে বাঙালিরা স্বাধীনতা পেয়েছিল, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের ঘুম ভেঙ্গে বাঙালি জেগে উঠেছিল, হিন্দু কিংবা মুসলমান পরিচয়ে নয়, বাঙালি জাতি হিসেবে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬২, ১৯৬৯ পরিশেষে ১৯৭০ এর নির্বাচনে বাঙালিত্বের জয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা সেটিও হতে দিলনা। যার ফলে ১৯৭১ এ জেগে ওঠা বাঙালি জাতি ইসলামিক রিপাবালিক অব পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করে বিশ্বের নিকট চমক সৃষ্টি করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল।
বাংলাদেশের উত্থান উপমহাদেশে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণাকে অর্থহীন করে দেয়ায় ঐ মতের মৌলবাদী ধ্যান ধারনায় মানুষদের কাছে বাংলাদেশ চিরন্তন শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। সেই শত্রুতার জের ধরেই ইতিহাসে ঘটে যায় বাঙালি জাতির অবিসংবাধিত নায়ক সারাজীবন অসাম্প্রদায়িক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকান্ড। বর্তমানে যদিওবা দেশে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ও বাঙালি সাংস্কৃতির ধারক-বাহকরা ক্ষমতায় কিন্তু মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী এবং ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। তারা তাদের কর্মকা-ের মাধ্যমে সকল সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। আমিনী-সাঈদীরা যা অতীতে করে আসছিল তা এখনো শতগুন বৃদ্ধি পেয়ে এগিয়ে চলেছে।
(ক) মুসলমানদের সংস্কৃতি (কালচার) বলতে কোন্ ডেফিনিশন বা সংজ্ঞা আছে কিনা? (খ) ইসলামের নিজস্ব নির্ধারিত বিশ্বজনীন কোন কালচার বা সংস্কৃতি আছে কিনা? (গ) আমরা যে দাড়ি রাখি, টুপি পড়ি, তসবি টিপি, সাংবাদিকদের কাছে পোজ দিয়ে ছবি তুলে সংবাদপত্রে ছাপতে দিই এগুলো কোন ধরনের ইসলামী কালচার? (ঘ) হহুদি, খ্রীষ্টান, হিন্দুরা কি দাড়ি রাখে না, টুপি পরে না এবং তসবি টিপে না? (ঙ) ইসলাম পূর্বকাল হতেই ঐসব সম্প্রদায় দাড়ি, টুপি, তসবির ব্যবহার করছিল কিনা?
এসবের উত্তর আজ সকল মুসলিম জনসাধারণের জানা অতীব প্রয়োজন।
ইসলাম পূর্বকাল হতেই বর্ণিত সকল কর্মকা- ও অনুষ্ঠান কালচারের ব্যবহার ছিল। আমরা শুধু তা অনুকরণ করছি। আমরা যে খৎনা করি, তা ইহুদিদের অনুকরণে। আরও অনেক ভাল ও উত্তম বিষয় আছে যা ইসলাম অনুকরণ করেছে। ইসলামী কালচারের কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যেহেতু এটি বিশ্বজনীন এবং সকল কালচারের সমন্বয় করানোর জন্যই এর আবির্ভাব। ইসলামী কালচারের কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই কিন্তু সকল দেশের সংস্কৃতি যদি ইসলামের শিক্ষায় পরিপন্থী না হয় তবে তা ইসলাম কর্তৃক সর্বদা গৃহীত হয়েছে। তথাপি এতে ইসলামের এ্যাপলাজ আছে।
মার্মাডিউক পিকেথল তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, IT IS A MISNOERO অর্থাৎ ইসলামী কালচার শব্দটি ভ্রান্তভাবে চালু হয়ে গেছে।
সুতরাং ইসলামের নামে জিকির তুলে যারা সকল বিষয়ে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি খুঁজে বেরান তাদের বিষয়ে আজ আমাদের চিন্তা করতে হবে। এরাই পাকিস্তান সৃষ্টিতে কাফেরের গন্ধ খুঁজে পেয়েছিল। ১৯৫২ তে ভাষা আন্দোলনকে হিন্দুয়ানী এবং এর স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে হিন্দু রাজত্বের খোঁজ পেয়েছিল। বর্তমান সময়ে সে তাঁরাই দেশে নতুনভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে দেশে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করছে। দেশকে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ফিরিয়ে নিতে আন্দোলনে নেমেছে। তাদেরকে প্রতিরোধের এখনই সময়, প্রজন্ম আজ জেগেছে।
বর্ষ বা সন গণনার ইতিহাস : সন তারিখ দু’টি আরবী, সন অর্থ বর্ষ, ফার্সিতে সাল আর তারিখ অর্থ ইতিহাস, আমরা বাংলায় বলি দিন। দিনের সমষ্টির নাম কাল, সপ্তাহ, মাস বা বর্ষ, তেমনি কোন একটি বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয় এক একটি অব্দ। সর্বপ্রথম কখন এই অব্দের সূত্রপাত হয়েছিল তা সঠিকভাবে কোন গবেষক নির্ধারন করতে পারেনি। এনিয়ে নানা মুনির নানা মত প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন মিশরীয়রা তারকার সাহায্যে বর্ষ গণনা শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে কৃষি কাজের সুবিধার্থে বর্ষ পঞ্জিকার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। দীর্ঘ দিনের গবেষণায় তারা দেখতে পেয়েছিলেন তিনশ পয়ষট্টি দিন পর পর লুদ্ধক নামক নক্ষত্রটি সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্বক্ষণে আকাশে দৃশ্যমান থাকে। এটি একমাত্র তারকা যা দৃষ্টিগোচর হয়। এ লুদ্ধককে কেন্দ্র করেই মিশরে শুরু হয় বর্ষ গণনা। খ্রীষ্টপূর্ব ২৩০ অব্দে মিশরে নববর্ষের প্রচলন হয় শরৎ ঋতুতে। এধরনের আরও অনেক বর্ষ ও সনের উল্লেখ ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায়। সে সব খুঁজে পাওয়া ইতিহাস হতে গবেষকদের গবেষণালব্ধ বিষয়াবলী হতে যে কয়টি সনের উৎপত্তির উৎস ও সন খুজে পাওয়া গিয়েছিল তার কয়েকটির সনের বর্ণনা পাঠকদের জন্য নিম্নে তুলে ধরছি। যেমন :
১। যুধিষ্ঠির অব্দ ২৪৪৯ খ্রীষ্টপূর্ব হতে শুরু হয়েছিল (আনুমানিক)।
২। শ্রীহর্ষাব্দ-৪৫৮ খ্রীষ্টপূর্ব হতে শুরু (আনুমানিক)।
৩। বিক্রম সম্ভৎ-৫৮ খৃষ্টপূর্ব হতে (আনুমানিক)।
৪। শকাব্দ ৭৮ খ্রীষ্টাব্দ হতে।
৫। বল¬ভাব্দ-৩১৮ খ্রীষ্টব্দ হতে।
৬। গুপ্তাব্দ-৩২০ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ মার্চ চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যাভিষেককে কেন্দ্র করে এর উদ্ভব।
৭। আমান ফিল বা হস্তী সন-৫৭০ খ্রীষ্টাব্দ। উলে¬খ্য যে, এ সনটিকে প্রকৃত কোন অব্দ বলা যায় না।
৮। হিজরী চান্দ্র বৎসর-৬২২ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ জুলাই থেকে এ বর্ষ গণনা শুরু হয়।
৯। বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ এর উৎপত্তি ৬২২ খ্রীষ্টাব্দে ১৬ জুলাই অন্য হিজরী চান্দ্র বা কমরী সন হতেই এ সনের রূপান্তর। ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দ মোতাবেক ৯৬৩ হিজরী থেকে সৌর হিসাবে যে গণনা শুরু হয় তাই আজকের বাংলা সন ১১ এপ্রিল ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে এর যাত্রা শুরু। আর প্রথম সন বা অধুনা বাংলা সন জন্মলগ্ন হতেই ছিল ৯৬৩ বাংলা সন।
১০। এলাহি সন-১৫৮১ খ্রীষ্টাব্দের ১১ মার্চ সম্রাট আকবর সর্বধর্মেই উপাদান নিয়ে যে নবধর্ম প্রচারের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন সে হতেই এ সনের উদ্ভব। কিন্তু নবধর্ম ‘দীন এ এলাহির’ ন্যায় এ সনও অকালে কালের গহবরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
১১। ত্রিপুরাব্দ-৫৯০ খ্রীষ্টাব্দ।
১২। মঘীসন-৬০৮ খ্রীষ্টাব্দ।
১৩। মলাব্দ-৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দ।
১৪। লক্ষনাব্দ-১১১৮ খ্রীষ্টাব্দ।
১৫। চৈতন্যাব্দ-১৫৩১ খ্রীষ্টাব্দ চৈতন্য পন্থীরা এই সনের প্রবর্তন করে এবং আজো নিজেদের মধ্যে এ চৈতন্যাদেব প্রচলন বিদ্যমান।
১৬। দানিশাব্দ-১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের ১৫৫৭ সাল ধরে এ সনের গণনা শুরু হয়েছিল।
১৭। খ্রীষ্টাব্দ-যীশুখ্রীষ্টের জন্মকে কেন্দ্র করে এই সনের উদ্ভব। যদিও যিশু খ্রীষ্টের জন্ম কারো কারো মতে বর্তমানে যে খৃষ্টাব্দ প্রচলিত হয়েছে সেই খৃষ্ট সনের ৪ থেকে ৮ বৎসর পূর্বে অর্থাৎ খ্রীষ্টের জন্ম খ্রীষ্টপুর্বে হয়েছিল। খ্রীষ্টাব্দ বর্তমানে স্থায়ীভাবে বহুল প্রচলিত রয়েছে বিশ্বব্যাপি যা খ্রীষ্টানদের কর্তৃক প্রচলন করা হয়েছিল কিন্তু এতে আমাদের আলেম সমাজ বিধর্মীয় চিন্তা খুজে পান না শুধু পান বাংলার বেলায়।
১৮। শিবাজী বর্ষ-১৬৪৪ খ্রীষ্টাব্দে শিবাজীর রাজ্যভিষেককে কেন্দ্র করে এটি চালু হয়েছিল। কথিত আছে যে রোম নগরীর প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ৭৫৩-৪৩ খৃষ্ট পূর্বের কোন এক ২১ এপ্রিল থেকে এ নতুন সনের প্রচলন হয়েছিল।
১৯। হিজরী শামছি (সৌর সন) যার উৎপত্তি ৬২২ খ্রীষ্টাব্দ হতে শুরু। এটির বিশেষত্ব হল এটি চন্দ্রের দ্বারা গণনা না করে সূর্য্যের দ্বারা গণনা করা হয় ১৯৩৯ সাল হতে। এটির উদ্ভাবক ছিলেন পাকিস্তানের আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের জামেয়া আহমদীয়ার অধ্যাপক আল¬ামা মোহাম্মদ ইসমাইল। সারাবিশ্বের কয়েক কোটি আহমদী জামায়াতের সদস্যদের মধ্যে এটি বহুল ভাবে প্রচলিত রয়েছে। ইদানিং আরব দেশেও এর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। উন্নত বিশ্বের সাথে সাথে সকল মুসলিম বিশ্বে বৈজ্ঞানিক চিন্তা চেতনায় ও বাস্তবতার ভিত্তিতে সকল মহল কর্তৃক এ হিজরী শামছি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
এছিল মোটামুটি হিসাবে প্রচলিত ও অপ্রচলিত বর্ষের সামান্য বিবরণী। যা গবেষকদের গবেষণার বিষয়। যেহেতু আমি বাংলা বর্ষ নিয়ে লিখতে বসেছি তাই বাংলা সংস্কৃতির মূল ভিত্তি ও বাংলা সনের উৎপত্তি ও ক্রম বিকাশের বিষয়ে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করছি, যা পাঠকদেরকে চিন্তার খোরাক দিবে বলে আমার বিশ্বাস।
বাংলা সনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ : আজ হতে অর্থাৎ ২০১৩ খ্রীষ্টাব্দের প্রায় পাঁচশত বৎসর পূর্বে আমাদের এই বাংলা সনের জন্ম। জন্মস্থান বর্তমান ভারতের দিল্লি নগরীতে। এ সনের জন্মদাতা ছিলেন একজন অবাঙালি গবেষক। জন্মলগ্ন হতে এ সনের পরিচিতি ছিল ফসলী সন হিসাবে। মোগলদের রাজকার্যে সুবিধা অনুযায়ী-৪৪৬ হিজরী কমরী বা চান্দ্র বৎসরের হিসাব অনুযায়ী পরিচালিত হত। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের দিনক্ষণ পূর্ব হতেই সঠিক ভাবে চান্দ্র মাসের হিসেবে নির্ধারণ করা সম্ভবপর ছিল না। এই অসংগতি ও অসুবিধা দূর করার মানসে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে পন্ডিত ফতেউল¬া সিরাজীর দীর্ঘ গবেষণার ফসল এই বাংলা বর্ষ। প্রথমে সম্রাট আকবরের ইচ্ছে ছিল তার সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম “দীন এ এলাহি” ধর্মের স্মরণে এলাহি সন চালু করবে। কিন্তু তা সর্বসাধারণের নিকট সমাদরে গৃহীত না হওয়ার কারণে নতুন সৌর ফসলী সনই সকলের নিকট গৃহীত হয়েছিল। পন্ডিত ফতেউল¬া সিরাজী দীর্ঘ গবেষণা করে ১১ এপ্রিল ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দ মোতাবেক ২৭ বা ২৮ রবিউস্ সানী ৯৬৩ হিজরী কমরীসন হতে নতুন এ সৌর ফসলী সনের প্রচলন করেন। ১ মহরম ছিল ১৬ জুলাই তাই হিজরী সন গণনা শুরু হল এই ১৬ জুলাই হতে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) হিজরী কমরী সনের ব্যবহার শুরু করেছিলেন। ৯৬৩ হিজরী কমরী সনের রবিউস সানি পর্যন্ত যে চান্দ্র হিসাবটি চালু ছিল তাতে সৌর হিসাব যুক্ত হয়ে ফসলী সনের যাত্রা শুরু হয়। এই ফসলী সন হিজরী সনেরই চান্দ্র ও সৌর হিসাবের মিলিত রূপ। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পরবর্তী কালে এই সনটি উপেক্ষিত হওয়ায় শুধু বাংলার মাটিতে এটি গৃহীত হয়েছে বলে আজ এর নাম বাংলা সন। ভারত সরকার ১৩৬৪ সালে অর্থাৎ ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দের ২২ মার্চ বাংলা সন পরিত্যাগ করে কনিস্ক প্রবর্তিত শকাব্দ সনের প্রবর্তন করেন। ঐ সময় ছিল ১৮৮০ শকাব্দ। ভারত সরকার ১৩৬৩ সালের ৮ চৈত্র তারিখে ১৮৭৯ শকাব্দের ১ চৈত্রকে নববর্ষের প্রথমদিন ধার্য্য করেন। উলে¬খ্য যে, ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দ বাংলা সনের জন্ম লগ্ন থেকেই ছিল ১৪৭৮ শকাব্দের ১ বৈশাখ। দৈনিক ইত্তেফাকের ১ বৈশাখ ১৩৯১ বাংলা সংখ্যার বক্তব্য অনুযায়ী দেখা যায় মধ্যযুগে সুলতান হোসেন শাহের আমল হতেই বাংলাদেশে বাংলা সনের আবির্ভাব। তাই প্রায়শ ধারণা করা হয়ে থাকে হোসেন শাহ এই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। প্রকৃত পক্ষে এ গবেষণা বা মতামত ভূল বলে গবেষকদের নিকট প্রমাণিত হয়েছে। গবেষকদের মতে ফতেউল্লা সিরাজীই হলেন এ বাংলা সনের মূল প্রবর্তক।
যখন হতে এ ফসলী সন বা বাংলা সন বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবহার হতে থাকে তখন হতে এর বিভিন্ন সমস্যা পরিলক্ষিত হয় এবং এ বাংলা সনে মাসের দিনের সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকে না বলে পরবর্তীতে সকলকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। যার কারণে এ বিষয়টিকে নির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্য তৎকালীন সরকার বিশিষ্ট ভাষাবিদ ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি ১৯৬৬ সালে একটি সুপারিশ প্রণয়ন করেন। সে সুপারিশ মোতাবেক একাডেমী ১৩৭৩ সালে অর্থাৎ ১৯৬৮ ইংরেজী সন হতে একটি সংশোধিত দিনপঞ্জি চালু করে। এতে বৎসরের প্রথম পাঁচ মাস (বৈশাখ হতে ভাদ্র) ৩১ দিনে আর বাকী সাত মাস ৩০ দিনে গণনার হিসাব ধরা হয়েছিল। ৪ দ্বারা যে বছর বিভাজ্য হবে তাকে অতিবর্ষ গণ্য করে ইংরেজী সনের অনুরূপ চৈত্র মাসকে ৩১ দিন ধরে গণনা করার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু ডঃ শহীদুল্লাহর সুপারিশ অনুযায়ী আজো আমাদের দেশে কোন সন চালু হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। বর্তমানে পুরোনো দিনের হিসাব অনুযায়ী হিন্দু সম্প্রদায়ের চুলচেরা দিন মাস তিথি নির্ধারণের প্রয়োজনেই পূর্ববর্তী হিসাবে আজো পঞ্জিকা সমূহে প্রচলিত হয়ে আসছে। এ বাংলা সনের ১২ মাসের নাম সমূহের একটি ইতিবৃত্ত রয়েছে। জ্যোতিষ শাস্ত্র বিশারদরা নক্ষত্রের হিসাব অনুযায়ী তিনশ ষাট দিন বছর গণনা করে থাকে। সাতাশটি তারকার অবস্থানকে কেন্দ্র করে নক্ষত্র বছর আবর্তিত হয়। এ সাতাশটি তারকা ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র মতে অশ্বিনী, ভরনী, কৃত্তিকা, রোহিনী, মৃগশ্চিরা, আদ্রা, পূনবর্সু, পূজা, অন্নেষা, মঘা, পূর্বাফাল্গুনী, উত্তর ফাল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যৈষ্ঠা, মুনা, পূর্বষারা, শ্রবণা, ধনিষ্টা, শতভীষা, পূর্বাভাদ্রপদ, উত্তর ভাদ্রপদ এবং রেবতী। উপর্যুক্ত তারকাগুলির সোয়া দুই পাদ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক একটি মাস। যেমন :- অশ্বিনী হতে আশ্বিন, কৃত্তিকা হতে কার্ত্তিক, পুষ্যা হতে পৌষ, মঘা হতে মাঘ, ফাল্গুনী হতে ফাল্গুন, চৈতা হতে চৈত্র, বিশাখা হতে বৈশাখ, জৈষ্ঠা হতে জ্যৈষ্ঠ, আষাড়া হতে আষাঢ়, শ্রবণা হতে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ হতে ভাদ্র মাসের নামকরণ করা হয়েছে। অনুরুপ মৃগশ্চিরা হতে হয়েছে মার্গশীর্ষ মাস, পরবর্তী কালে এ মাসের নাম রাখা হয় অগ্রহায়ণমাস।
তথাকথিত মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টিকারী ইসলামপ্রেমী বা ভক্তদের ধারণা চান্দ্র বৎসর ইসলামী এবং সৌর বৎসর অইসলামী। এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল ও অজ্ঞতা প্রসুত। অজ্ঞতা, অশিক্ষা কুশিক্ষা এবং তথাকথিত আলেমদের বিভ্রান্তিমূলক মূলক প্রচার হতে এর উৎপত্তি। চান্দ্রের হিসাব অনুযায়ী যে রকম মুসলমানরা তাদের রোজা, ঈদ, কোরবানী ইত্যাদি পালন করে থাকে তদ্রুপ সূর্য্যরে সাথে সময় মিলিয়ে নামাজের সময় এবং রোজার সেহেরী ও ইফতার প্রভৃতি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে থাকেন। সুতরাং চাঁদতারা পতাকা দেখলেই যে, ইসলামী পতাকা হবে এটি ঠিক নয়। তদ্রুপ লাইলাহা ইল্লাল্রাহু মোহাম্মদুর রসুল্লাহ কলেমার নীচে নাঙ্গা তরবারী দেয়া সৌদি রাজ পতাকা এবং পাকিস্তানী পতাকা মানে ইসলামী পতাকা নয়। মুসলমানের মধ্যে যেমন চাঁদের প্রয়োজন তদ্রুপ হিন্দুদের শিবের কপালে চাঁদ তারা একে রেখেছেন এবং চন্দ্রবিন্দুর চাঁদ দ্বারা স্বর্গীয় বুঝিয়ে থাকেন। তেমনি পূজা পার্বণের সময় ও তারা চাঁদের হিসাব দ্বারা করেন থাকেন। সুতরাং এ বিষয়গুলিকে দূরভিসন্ধি মূলকভাবে সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব নিয়ে না দেখে দেশীয় সংস্কৃতি এবং সময় গণনার হিসেবে চিহ্নিত করলেই কোন বির্তক থাকার কথা নয়। তবুও আবার এসব বিতর্ক এখনও আমাদের সংস্কৃতিতে বিরাজমান বলে আমরা নিজেদেরকে উদার চিত্তের মন মানসিকতায় প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। সে মুসলমান হোক বা হিন্দু হোক সকলেই আমরা সংকীর্ণ মনমানসিকতা নিয়ে এসব বিতর্ক এক মহাকাল ব্যাপী নিজেদের মধ্যে টিকিয়ে রেখেছি এর থেকে মুক্ত হওয়া অবশ্য কর্তব্য। নতুন প্রজন্মের প্রতিবাদী তরুণ সমাজই এর থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে সমাজকে। ইংরেজী বর্ষ ও মাস ও দিন যেভাবে বর্তমানে বর্ণিত রয়েছে তা প্রত্যেকটি গ্রীক ও রোমান দেবদেবীর নামের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও মুসলিম বর্ষের ও দিনক্ষণ বিভিন্ন ঘটনা ও সময়ের আলোকে নির্ধারিত। তদ্রুপ বাংলা সনের মান ও বর্ষ ও ঋতু প্রভৃতি চাঁদ ও তারকাদের নামের আদলে প্রস্তুতকৃত। কাজেই এনিয়ে অযথা বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। পৃথিবীর কোথাও কোন দেশে ছয়টি ঋতুর প্রচলন নেই। একমাত্র আমাদের বাংলা বর্ষে ছয়টি ঋতু প্রচলিত। আরবী ও ইংরেজী বর্ষে সর্বক্ষেত্রে চারটি ঋতু বিরাজমান। শুধু আমাদের দেশে এবং বাংলা বর্ষে ছয়টি ঋতু তাই এই সোনালী শস্যের সুজলা সুফলা সুন্দর এই দেশটিকে কবি ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে গর্ব অনুভব করেছেন।
যে জাতি তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, কায়দা, কানুন ও চালচলন প্রভৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে দেয়, সে জাতি তার অস্তিত্ব নিয়ে কোন দিনই ঠিকে থাকতে পারে না। সকল প্রকার মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল চিন্তা ও চেতনার মানুষদের ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য কামনা করে নতুন বাংলা বর্ষকে স্বাগতম জানাই। এ নববর্ষ আমাদের জন্য শান্তি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং বাঙালিত্বের বিজয় দান করুক এবং সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ দ্রুত শেষ করা এখন সময়ে দাবি।

Exit mobile version