বিকেল সাড়ে ৪টা। পাশের মসজিদ থেকে আসরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। অন্য সময়ে সুরের মায়া ছড়িয়ে দেওয়া মোয়াজ্জিনের গলায় যেন আজ ক্লান্তির ছাপ। হবেই বা না কেন? গত কয়েকদিন ধরে যা গরম পড়ছে। জৈষ্ঠের এই রুক্ষ-শুষ্ক প্রকৃতিতে বৃষ্টির দেখা নেই আনুমানিক পাঁচ মাস। পুরো জীবজগতে নাভিশ্বাস উঠার দশা। রোদ মরে আসা এই বিকেল বেলাতেও কেমন অস্বস্তিকর গরম।
ঐন্দ্রিলা তাদের তিনতলার ভাড়া বাসার বেলকনিতে পায়চারি করতে করতে নিচের গাছগুলো দেখছে। কেমন ঝিম মেরে আছে তারা। একটুও বাতাসের আলোড়ন নেই ডালপালায়। ঐন্দ্রিলার হাঁসফাঁস লাগে। এই কোভিড মহামারীতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ একবছরেরও বেশি সময়। অতি শীঘ্রই খুলবে এমন কোনো আশাও নেই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে এসময় কত মজা হত! ঝোঁপ-জঙ্গলে ঘেরা ক্যাম্পাসে চেনা-অচেনা কত রকমের যে গাছ। এই জৈষ্ঠে সেখানে পেকে পেকে ঝুলে থাকে আম-জাম-কাঁঠাল কত কী! ক্লাস-ল্যাবের ফাঁকে কেউ একজন চুরি করে আস্ত একটা কাঁঠাল পেড়ে নিয়ে আসলে তা নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে হুলস্থুল পড়ে যায়। চলে কাড়াকাড়ির বাড়াবাড়ি। কতদিন হল ষোলশহরে, শাটলে, মউয়ের দোকানে, ঝুপড়িতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হয় না। ভাবতে ভাবতে ঐন্দ্রিলা উদাস হয়ে যায়।
হঠাৎ হাতের মুঠোফোনে মেসেঞ্জারের ‘টুন’ শব্দ। অয়নের টেক্সট। পুরনো দিনের চিঠির মত বেশ বড়সড় লেখা।
“ঐন্দ্রি, কেমন আছ? ভালো? একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি একটুক্ষণ আগে। স্বপ্নটা তাই একেবারে তরতাজাই। শাটলে ক্যাম্পাস থেকে ফিরে একটা জমজমাট বৈকালিক আড্ডা হচ্ছিল ষোলশহর স্টেশনে। সেই আড্ডার মধ্যমণি ছিলে স্বাভাবিকভাবে তুমিই। সন্ধ্যে হয়ে গেলে ‘আমি চললাম’ বলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে তুমি রাস্তায় এসে একটা রিকসা ঠিক করে উঠে বসলে। যাত্রী পেয়ে রিকসাওয়ালা হিসু করতে বা বিড়ি-সিগ্রেট কিছু একটা ধরাতে তোমার অনুমতি নিয়ে একটু আড়ালে টঙ দোকানের দিকে চলে গেল। এরমধ্যে রিকসাটি একটু একটু করে পেছন দিকে গড়াতে শুরু করেছে। গন্তব্য বিশাল এক খোলা ম্যানহোল। বিষয়টা তুমি ধরতেই পারছ না, হেয়ালি তুমি দিব্যি বসে আছ দূরে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে। এদিকে তুমি চলে আসার পর আড্ডায় আর মন নেই আমার। চলে আসি পিছু পিছু। রাস্তার অপরপাশ থেকে তোমার রিকসার বিপথগামিতা আমার চোখ এড়ায় না। ভাবাভাবির সময় নেই। আমি সিনেমার নায়কের মত কয়েকটা চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে তীরবেগে ছুটে এসে দুই হাতে দুই ব্রেক জোরসে চেপে ধরে রিকসা থামাই। তুমি বিপদমুক্ত হলে। এরপর যেন তুমি সম্বিত ফিরে পেলে আর পেছনের খোলা ম্যানহোলের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলে। একটুপর রিকসাওয়ালা ফিরে এলে আমি তাকে তার অসাবধানতার জন্য মৃদু ভর্ৎসনা করি। সে লজ্জিত হয়। পরে তাকে বলি, তোমাদের চকবাজারের বাসা পর্যন্ত রিকসা আমিই চালিয়ে নেব, সে আগেভাগে অন্য গাড়িতে ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করলেই চলবে, ভাড়াটা ঠিকঠাক পেয়ে যাবে। রিকসাওয়ালার তাতে কোনো আপত্তি নেই, সে সাননন্দে ‘জ্বে, আচ্ছা’ বলে গলির ভিতরের ওই টঙ দোকানের দিকে চলে গেল আরেকটা সিগ্রেট ধরাতে। আমার অদ্ভূতুড়ে প্রস্তাব শুনে তুমি প্রথমে বিস্ময়ে ‘তা না না’ ও পরে দারূন মজা পেয়ে হেসে কুটি কুটি হলে।
এখন রিকসায় চালকের আসনে আমি, পেছনে যাত্রীর আসনে তুমি। সন্ধ্যার নরম বাতাস গায়ে লাগছে। তুমি রবীন্দ্র সঙ্গীতের কোন একটা গানের কলি গুন গুন করে গাইছ। নানা গলি, নানা পথ ঘুরে শেষে তোমাদের বাসার সামনে রিকসা এসে থামে। আমি চালকের আসন থেকে নেমে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে তোমার দিকে হাত বাড়াই- ‘ভাড়াটা’। তুমি কিলকিল করে হেসে উঠে আমার বাড়ানো হাত ঝাপটে ধরে রিকসা থেকে নেমে এলে। স্বপ্নের পরিসমাপ্তি এখানেই। বিশ্বাস কর তোমাকে যাত্রী বানিয়ে সন্ধ্যার পর নিরিবিলি পথে রিকসা চালানোর দৃশ্য কতটা মনোরম ছিল তা কাউকে বলে বুঝানো যাবে না। ইশ্, বাস্তব যে কেন স্বপ্নের মত সত্য ও সুন্দর হয় না?”
টেক্সটি পড়ে একটু আগ পর্যন্ত ঘুমোট হয়ে থাকা মনটি হঠাৎ বৃষ্টিস্নাত ঘাসের মত সতেজ হয়ে উঠে ঐন্দ্রিলার। সে অয়নকে ফিরতি মেসেজ দেয়- চল, তোমার স্বপ্নটা পূরণ করে দিই। কালই বের হচ্ছি। বিপ্লব উদ্যান, বিকেল ৩টা। এরপর চলবে এ জার্নি বাই রিকসা। রিকসা রিকসাওয়ালা নিজে চালাবে, না তুমি চালাবে- সে তোমার নিজস্ব ব্যাপার!
দুই.
৩টা বাজার দশ মিনিট আগেই অয়ন হাজির বিপ্লব উদ্যানে। এই সেই ঐতিহাসিক স্থান যেখানে মেজর জিয়া অসীম সাহসিকতায় ‘উই রিভোল্ট’ বলে নিজ সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে উদ্যানে মানুষজন হাতেগোনাই। অয়ন উদ্যানের দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে একটি গাছের ছায়ায় বসে ঐন্দ্রিলার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দেশে চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। নিয়ন্ত্রণ চেষ্টায় সরকার কিছুদিন পর পর দিচ্ছে লকডাউন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ প্রায় দেড় বছর। মানুষজন ঘরবন্দী। সহজে কেউ বের হয় না। বের হলে পথে মুখোমুখি হতে হয় পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের। জরিমানাও গুণতে হয় ভাগ্য খারাপ হলে। শুধু তাই নয়, পরিবারের কোনো সদস্যকে ঘর থেকে বের হতে হলে বড়দের কাছেও দিতে হয় নানা কৈফিয়ত। সব উপেক্ষা করে একজনের স্বপ্নের কথা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসা কেবল ঐন্দ্রিলাকেই মানায়। সে বরাবরই এমন। বন্ধুদের জন্য সর্বদা সম্প্রদানে সপ্তমী!
মিনিট-বিশেকের মধ্যে ঐন্দ্রিলা বিপ্লব উদ্যানে হাজির। তারা প্রথমে নিকটস্থ একটা রেস্টুরেন্টে যায়। সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি টিনেজারদের উৎপাতে। এই চরম বিধি-নিষেধের মধ্যেও স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা দীর্ঘদিন স্কুলে যেতে না পেরে সেখানে গিয়ে ভিড় জমিয়েছে। তাদের বেশিরভাগই অপরিণত প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল। তাদের কিছু কিছু আচরণ বেশ আপত্তিকর ঠেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শেষ বর্ষের এ বন্ধু-বান্ধব যুগলের কাছে। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে একটা রিকসা ঠিক করে। গন্তব্য আট-দশ মাইল দূরের অনন্যা আবাসিক।
নাম আবাসিক হলেও এখনো কোনো স্থাপনা সেভাবে গড়ে উঠেনি সেখানে। হয়ত ভবিষ্যতে হবে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সেখানে রয়েছে কাঁশবন আর ছোট ছোট বেতের ঝোঁপ। কাঁশফুলের ফাঁকে সবুজ গালিচার মত সতেজ ঘাসের উপর বসে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে গল্পে-আড্ডায় দারূন কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে দেয়া যায় অবলিলায়। ব্যস্ত নাগরিক জীবনের ফাঁকে দুদণ্ড শান্তির খোঁজে অনেকেই সবান্ধব চলে আসে এখানে।
তিন.
ঐন্দ্রিলা-অয়ন যখন রিকসায় উঠে তখন মাথার উপর ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর থাকলেও অনন্যা আবাসিকের কাছাকাছি আসতে না আসতেই আকাশের রঙ পাল্টাতে শুরু করে। মূল সড়কের পাশেই জায়গাটি। তারা রিকসা থেকে নেমে যখন কাঁশবনের একটু ভিতরের দিকে যায় তখন চারদিকে নেমে আসে হাহাকার করা অন্ধকার। এমনিতেই পড়ন্ত বেলা, তারউপর হঠাৎ নেমে আসা এমন অন্ধকারে গোটা এলাকায় সৃষ্টি হয় ভুতুড়ে পরিবেশ। এদিন কাঁশবন দেখতে যারা এসেছিল প্রকৃতির এমন ভয় জাগানিয়া রূপ দেখে অনেকেই সটকে পড়ছিল দ্রুত। অয়ন-ঐন্দ্রিলা দেড়শ টাকা রিকসা ভাড়ায় মাত্রই তো এসেছে, পরিস্থিতি যেমনই হোক কিছুটা সময় না কাটিয়ে ফেরার পথ ধরলে তাদের চলবে কী করে। কাঁশবন, বেতঝাঁড়ে আলোড়ন তুলে হঠাৎ শোঁ শোঁ করে বাতাস বইতে শুরু করল। সাথে মেঘের গুরু গম্ভীর গর্জন। কিছু বুঝে উঠার আগেই পড়া শুরু হল বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি। অয়ন দিশেহারা- এখন কী উপায়? আশেপাশে কোনো দোকানপাটও নেই যেখানে মাথাটা একটু গোঁজানো যায়। এসময় অয়নকে অবাক করে দিয়ে ঐন্দ্রিলা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করে ছাতাটা। সে কল্পনাই করেনি এমন ফকফকা রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ঐন্দ্রিলা ব্যাগে করে ছাতা নিয়ে আসবে। তবে ছোট্ট এক ছাতার নিচে দুইটা মানুষ যতটা সম্ভব কাছাকাছি দাঁড়িয়েও খুব একটা লাভ হয়নি। মিনিট-পাঁচেকের মধ্যে ঝপাঝপ ঝুমঝুম বৃষ্টিতে অর্ধেক ভিজে সারা। তখন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবেই হবে বোধয় যতই বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বাতাসের দাপটও। এভাবে কেটে যায় প্রায় আধাঘণ্টা। বৃষ্টি-বাতাসের মিলিত তাণ্ডবে এক পর্যায়ে দুইজনই ভিজে চুপসে যায়। দেখে মনে হবে এইমাত্র তারা পুকুর থেকে ডুব দিয়ে উঠেছে। ঐন্দ্রিলার ঘনকালো চুল বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছে। এতক্ষণ কিশোরীর চঞ্চলতায় বৃষ্টি উপভোগ করা ঐন্দ্রিলাকে হঠাৎ একটু বিচলিত দেখায়। সে চেহারাটা অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছে। অয়নের বুঝতে বাকি রইল না গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যাওয়া ভেজা কাপড়ে তার সামনে দাঁড়াতে সংকোচবোধ করছে সে!
জায়গাটি নির্জন। দৃষ্টি সীমার মধ্যে কোনো কাক-পক্ষীরও আনাগোনা নেই। একই ছাতার নিচে এমন সুন্দরী ও যুবতী একটি মেয়ের সঙ্গে এই নির্জন সন্ধ্যায় এত ঘনিষ্টভাবে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার কথা কোনোদিনও ভাবেনি অয়ন। প্রকৃতিই তাকে এমন পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে হয়ত কোনো কঠিন পরীক্ষাই নিচ্ছে আজ। ঐন্দ্রিলার উন্মুক্ত চওড়া কাঁধ, ভেজা শরীরের মাদকতাময় গন্ধ, ক্রমেই জমাট বেঁধে আসা অন্ধকার অয়নের শরীর-মনে অদ্ভূত এক শিহরণ সৃষ্টি করে। এই অনুভূতি নিষিদ্ধ প্রকৃতির যার স্বরূপ ও পরিণতি অয়নের জানা।
হঠাৎ নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল অয়নের। কারণ ঐন্দ্রিলা কখনো তার প্রেমিকা ছিল না, এখনো নয়। তারা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। অয়নকে সে অন্ধের মত বিশ্বাস করে বলেই এই পর্যন্ত চলে এসেছে। তাকে নিয়ে এমন চিন্তা করাটাও তো গুরুতর অন্যায়!
চার.
বৃষ্টি-বাতাসের তুমুল হট্টগোলের মধ্যেও দূরের কোনো মসজিদের মাইক থেকে আবছা আবছা শব্দে ভেসে আসছে মাগরিবের আজানের ধ্বনি। এর মধ্যে হঠাৎ নতুন দুর্যোগ সংযোগ। এখন বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে আসলেও শুরু হয়েছে কঠিন বজ্রপাত। আকাশ-বাতাস আলো করে ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে আর বুকে কাঁপন ধরিয়ে গরগর শব্দে এদিকওদিক হচ্ছে বজ্রপাত। এরই মধ্যে খুব কাছে একটা বজ্রপাত হলে ঐন্দ্রিলা যেন কেঁপে উঠে অয়নের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। অয়ন নিজের ত্রুটি ভেবে চকিত তফাতে সরে যায়!
পাঁচ.
ঐন্দ্রিলা-অয়ন দুজনই বিজ্ঞানের ছাত্র। তারা ভালোভাবে জানে বজ্রপাতের মধ্যে খোলা মাঠে তাদের এ অবস্থান কতটা ভয়ঙ্কর। শুধু তাই নই, মাথার উপর এঁকেবেঁকে যাওয়া বিদ্যুতের তাঁরগুলো তাদের আশঙ্কাকে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারা যতটা সম্ভব বিদ্যুতের খুঁটির কাছ থেকে দূরে সরে ছোট এক কালভার্টের উপর এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ঐন্দ্রিলা তাড়া দেয়- এবার চল, এখানে আর থাকা চলে না।
ঘাসে ঢাকা হাঁটার পথটাতে ততক্ষণে গোড়ালি ডোবা পানি। চারিদিকে গা ছমছমে ভুতুড়ে অন্ধকার। কোথাও একটু আলো নেই। তবে ঘন ঘন বিজলির আলো তাদের পথ দেখাচ্ছিল। সপ্ সপ্ শব্দে জলমগ্ন পথ মাড়িয়ে তারা কয়েক মিনিটের মধ্যে উঠে আসে মূল সড়কে। ভেজা কাপড়ে শীতে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে তারা অপেক্ষা করতে থাকে রিকসা বা সিএনজি কিছু একটার। অক্সিজেন-কুয়াইশ কলেজ এ রোডটা এমনিতেই নির্জন। রিকসা-সিএনজি ছাড়া অন্যকোনো গাড়ি খুব একটা এতে চলে না। তারমধ্যে এমন ঝড়ো বৃষ্টিতে সড়কটি আরো নিস্তব্ধ ও যানশূন্য হয়ে পড়েছে। তবে অয়নদের ভাগ্যটা নিতান্ত মন্দ নয়, রাস্তায় দাঁড়ানোর পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে তারা একটা রিকসা পেয়ে যায়। রিকসায় পাশাপাশি বসে শরীরের উত্তাপ বিনিময় হলেও তাদের মধ্যে আর খুব বেশি কথা হয়নি। কথা বলার জন্য অয়ন ভিতরে ভিতরে চুক চুক করলেও ঐন্দ্রিলার দিক থেকে তেমন সাড়া মিলেনি। হঠাৎ কেমন বদলে গেছে সে। তারা বিপ্লব উদ্যানে পৌঁছার পর একপ্রকার চুপচাপ আলাদা রিকসা নিয়ে যে যার মত বাসায় চলে যায়।
ছয়.
বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে অয়ন মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ঐন্দ্রিলার টেক্সট। ‘অয়ন, দুনিয়াতে দুইটা জিনিসকে আমি খুব ভয় পাই। সাঁপ আর বজ্রপাত। বাসায় অবস্থানকালে যদি কখনো বজ্রপাত হয় তখন রুমের দরজা-জানালা সব বন্ধ তো করিই, বিজলির আলো যেন চোখে না পড়ে সেজন্য জানালার সব পর্দা নামিয়ে দিয়ে গুম মেরে থাকি। বজ্রপাতের শব্দে এতটা ভীত হয়ে পড়ি যে, আশেপাশে মা-বাবা, ভাই-বোন যাকে পাই জড়িয়ে ধরে থাকি। তোমার সঙ্গে অনন্যা আবাসিকে যখন বজ্রপাতের কবলে পড়ি তখন কতটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম তুমি যদি সঙ্গীর অবস্থাটা একটু বুঝতে! আমি প্রত্যেকবার বজ্রপাতের শব্দে যখন কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম তখন খুব আশা করছিলাম তুমি একটু ভরসা যুগিয়ে আমাকে কাছে টেনে নেবে! বিজন প্রকৃতির মাঝে আমরা কেবল দুইটা প্রাণী। এই নির্জন পরিবেশে মিনিমাম রোমান্টিকতা বলেও তো একটা কথা থাকে! অথচ তুমি…। আসলে তুমি একটা অনুভূতিহীন অসাড় জড় পদার্থ!’

লেখক : সহ-সম্পাদক, দৈনিক আজাদী