সেই বিকেল চারটে থেকে রাহুলের জন্য পার্কে বসে আছে অহনা। আর এখন বাজে প্রায় পাঁচটা। কিন্তু এখনো প্রেমিকপ্রবরটির দেখা মিলছে না। সাথে আবার তার মোবাইলটাও এই মুহূর্তে বন্ধ আছে বলছে।
একেতো প্যাচপেচে গরম, তার উপর রাহুলের পছন্দমতো সাজসজ্জায় অহনার প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত প্রায়!
রাগে মেজাজটা একেবারে সপ্তমে চড়ে আছে তার!

কিন্তু একসময় তার রাগ গিয়ে দুশ্চিন্তায় পরিণত হলো।
কি হলো রাহুলের? সময়ের ব্যাপারে সে তো খুবই পাংচুয়াল একটা ছেলে। সবসময় অহনাই দেরী করে, রাহুল কক্ষনো নয়। তাহলে আজ কি হলো? কোনরকম বিপদ হলো না তো তার?
সাতপাঁচ ভাবনায় অহনার দুশ্চিন্তা যখন একেবারে চরমে, তখন দেখে পার্কের গেট দিয়ে ঢুকছে রাহুল। গায়ে নীল রঙের পাঞ্জাবী আর স্টোনওয়াশ ডেনিমে একেবারে রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে তাকে!

কিন্তু কপালে রক্ত লেগে আছে কেন রাহুলের? টেনশনে বেঞ্চি থেকে উঠে অহনা দৌড়ে গেল রাহুলের দিকে।
“কি হয়েছে রাহুল? এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি? কপালে রক্ত কেন? আরে, কথা কেন বলছো না তুমি?”
চোখে জল নিয়ে রাহুলকে জড়িয়ে ধরতে গেলে অহনার ছোঁয়া বাঁচিয়ে এক ঝটকায় পেছনে সরে গেলো রাহুল!

” কি হলো রাহুলের? এমন উদ্ভট আচরণ করছে কেন? হতভম্ব হয়ে গেলো অহনা!

” আজ শরীরটা কেন জানি ভালো লাগছে না অহনা। তাছাড়া অন্য একটা বিষয়ে আমার খুব তাড়াও আছে। তাই বলছি, চলো ফিরে যাই। আজ আমরা একসাথেই যাবো। চলো।”

আমরা দুজনে কখনো কি একসাথে বাসায় গেছি যে, আজ যাবো? আমার মা দেখলে আর আস্ত রাখবে আমায়? তাছাড়া আমি আরো কতক্ষণ বসবো এখানে। তোমার তাড়া থাকলে তুমি চলে যাও”।
অভিমান যেন ঝরে ঝরে পড়ছে অহনার কন্ঠে!

” রাগ করোনা অহনা। আমার সত্যিই আর থাকার জো নেই। এখন যাচ্ছি তবে কাজ সেরে ঘন্টাখানেক পর আমি আবার আসবো তোমায় নিতে।
তুমি অপেক্ষা করো আমার জন্যে “। কথা শেষ করে একপ্রকার দৌড়েই পার্ক থেকে বেরিয়ে গেলো রাহুল।

রাহুলের এমন অভূতপূর্ব আচরণে পাথর হয়ে বসে রইলো অহনা!
কিছুক্ষণ পরে একটু ধাতস্থ হয়ে চারিদিকে চোখ বুলাতেই অহনা দেখে, ওদিকের একটা বেঞ্চ থেকে সাদা পোশাকের এক অতিবৃদ্ধ লোক তাকে হাতের ইশারায় ডাকছে।
চোখের ভুল ভেবে আবারও তাকাতে দেখে, এবার ঐ লোক প্রাণপণে দু’হাত দিয়েই ডাকছে তাকে।

এখন কারো সাথে কোন কথা বলতেই অহনার একদম ইচ্ছে করছে না! তারপরেও কি যেন এক অমোঘ আকর্ষণে গুটিগুটি পায়ে ওদিকপানে এগোতে লাগলো সে ।

পরনের পাজামা- পাঞ্জাবিটার মতোই ধবধবে চুলদাড়ি বৃদ্ধটার। সাথে আছে বয়সের ভারে ঝুলে যাওয়া চামড়াসর্বস্ব একটা মুখ। কুঁজো হয়ে বসে আছে লোকটা।
” বসো, আমার কাছটিতে একটু বসো। সামনে তোমার বিশাল বিপদ। এই বিষয়েই কথা আছে তোমার সাথে আমার। ”
অহনার দিকে তাকিয়ে একরকম আদেশের ভঙ্গিতেই অহনাকে বললো লোকটা।
অবাক হয়ে গেলো অহনা! যতটা না অপরিচিত এই লোকের কথায়, তার চেয়েও বেশি অবাক হলো সে বুড়ো লোকটির চোখদুটো দেখে!
এমন উজ্জ্বল, আগুনঝরা আর তীব্র চাহনি সে আর কখনো কারো চোখেই দেখেনি। পাশাপাশি কি গম্ভীর কন্ঠস্বর! যেটা কোন অশীতিপর বৃদ্ধলোকের থাকারই কথা নয়!
দম দেয়া কলের পুতুলের মত পাশে বসে পড়লো অহনা।
” নীল পাঞ্জাবি পরা ঐ সুদর্শন ছেলেটা যার নাম রাহুল, সে তোমার প্রেমিক, তোমরা সহপাঠী, আর তোমাদের পাঁচ বছরের প্রেম, তাই না? ”
” হ্যাঁ, কিন্তু আপনি এত কথা জানলেন কি করে? ” অবাক প্রশ্ন অহনার।
” আমি তোমাদের বিষয়ে আরও অনেক কিছুই জানি। তবে কিভাবে জানলাম সেটা এখন বড় কথা নয়। মূল কথা হলো, সামনে তোমার বিশাল বিপদ! মৃত্যুযোগ আছে। আর সেই বিপদটা আসতে চলেছে তোমার প্রেমিকের কাছ থেকে। সাবধান হও মেয়ে! খুব সাবধান! ”
“আপনি একজন মুরব্বি মানুষ হয়ে পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন কেন? আপনি কতটুকু জানেন রাহুলের বিষয়ে? জানেন কতটা সৎ আর ভালোমানুষ সে? নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে সে আমায়। আমাকে ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে পারেনা সে, আর আপনি বলছেন তার থেকে আমার মৃত্যুর মতো ভয়াবহ বিপদ আসবে? যত্তোসব! আচ্ছা চলি।”
মহা বিরক্তির সাথে উঠে দাঁড়ালো অহনা।

” আরে বসো বসো। ” আদেশ করলেন বৃদ্ধ।
না বসবো না। আমি চলি।”
” বসো বলছি। চুপ করে বসো এখানে “। আদেশ তো নয়, যেন হুংকার দিলেন বৃদ্ধ।
এবার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে পরলো অহনা।

” রাগ না করে ঠান্ডা মাথায় আমার কিছু কথা শোনো তুমি মা । মঙ্গল হবে তোমার। তুমি যে বললে তোমায় ছাড়া রাহুল একমুহূর্তও থাকতে পারেনা সেটা খুবই সত্যি। আর সেটাই হবে তোমার মৃত্যুর কারণ। যেখানে গেছে সেখানে সে একা থাকতে পারছে না বলেই তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে এসেছে। ভাগ্যিস! তুমি যাওনি। তবে সে আবার আসবে তোমায় নিয়ে যেতে। বারবার আসবে। তুমি কিন্তু মনকে শক্ত করে ফিরিয়ে দিও তাকে বারবার। ” খুব মোলায়েম কন্ঠ এবার বৃদ্ধের।

” কিসব বলছেন আপনি? রাহুল কোথায় গেছে? আর আমি তার সাথে গেলে কি ক্ষতি হবে? তাকে তো আমি ভালোবাসি।” অবাক প্রশ্ন অহনার।

” ভালোবাসো বলেই তো বিপদ মেয়ে ! সেও তোমায় খুব ভালোবাসে বলেই তো ওখানে একা থাকতে পারছে না।তোমায় সাথে করে নিয়ে যেতে চায় “।
“ওখানে মানে কোনখানে? কি জানেন আপনি? হেঁয়ালি না করে বলুন তো রাহুল কোথায় গেছে? ”
” রাহুল আর এই পৃথিবীর কেউ নয়। একঘন্টা আগে সে অন্যজগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে।”
অহনার মাথার উপর বাজটা পুরোপুরিভাবেই ফেললেন এবার বৃদ্ধ!

ধুত্তোরি! পাগল একটার পাল্লায় পড়ে খামোখা সময় নষ্ট! যত্তোসব! মুরব্বি ভেবে এই বুড়োকে পাত্তা দেওয়াটাই ভুল হয়েছে আমার।”
এবার আর কোনোদিকে না তাকিয়ে গেটের দিকে হাঁটা দিলো অহনা। এই বুড়োলোকটার সাথে পার্কে আর নয়। প্রয়োজনে গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবে সে রাহুলের জন্য।

পার্সের ভেতরে মোবাইল বেজে উঠলো। কয়েকটা রিং হয়ে আবার কেটেও গেলো। বের করে দেখে প্রায় বিশটার মতো মিসডকল এসে জমা হয়েছে। সবগুলোই ক্লাসমেটদের।
আশ্চর্য! এতগুলো কল এসেছে কিন্তু একবারও সে শুনলো না? অথচ পার্সটা তো তার হাতেই ছিলো সারাক্ষণ! কি যে অদ্ভুত সব ঘটনা আজ ঘটে চলেছে তার সাথে!
প্রিয় বান্ধবী শিরিনকে রিং দেয়ার উদ্যোগ নিতেই আবারো কল এলো। শিরিনের কল।
” অহনা তুই কোথায়? রাহুলের খবরটা শোনার পর থেকেই তোকে অনবরত আমরা সবাই রিং দিয়ে চলেছি

রাহুলের খবর মানে? কি বলছিস?
” রাহুল মারা গেছে অহনা। ” কাঁদতে লাগলো শিরিন।
” কি যা তা বলছিস বলতো? এই তো ঘন্টাখানেক আগেই আমার সাথে দেখা হয়েছে পার্কে “। পাগল পাগল লাগছিলো যেন অহনার!
“না রে অহনা, তোর ভুল হচ্ছে কোথাও। কোথায় নাকি যাবার তাড়া ছিলো তার। ওদের বাসার সামনে রাস্তাটা দ্রুত পার হতে গিয়ে চলন্ত ট্রাকের নিচে পড়ে মারা গেছে সে। তুই দ্রুত বাসায় চলে আয়। পোস্ট মর্টেমের জন্য ডেডবডি পুলিশ নিয়ে গেছে।” কান্নার দমকে আর কিচ্ছু বলতে পারছিলো না শিরিন।

টলতে টলতে গেটের বাইরে যাওয়ার আগে গেটের কাছে দোকানটা থেকে এক বোতল পানি কিনে পুরোটাই ঢকঢক করে খেয়ে নিলো অহনা।
একটুখানি ধাতস্থ হলো এবার সে।

” যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আপা? ” দোকানদার প্রশ্ন করলো অহনাকে।

উফ্! আবারো কথা বলতে হবে? এরা কি সবাই আমাকে পাগল বানিয়ে দেবে!!
“কি প্রশ্ন? তাড়াতাড়ি বলো “?
” আপনার কি কোনোভাবে শরীর খারাপ? সেই তখন থেকেই দেখছি, আপনি একা একা কথা বলে যাচ্ছেন।। একবার এদিকের বেঞ্চিতে বসে , আবার কতক্ষণ পরে ওদিকের ভাঙা ইটপাথরের উপর বসে অনবরত বিড়বিড় করে যাচ্ছিলেন। ”
” কি সব ফালতু কথা বলছো তুমি? একা একা কেন কথা বলবো? আর কিসের ভাঙা ইটপাথর? ভালো বেঞ্চেই তো বসেছিলাম আমি। আর নিজে নিজে কথা বলছিলাম মানে? বেঞ্চের উপর বসে থাকা জ্বলজ্যান্ত বুড়ো মানুষটাকে তোমার চোখে পড়ছে না? যত্তোসব!!
রেগেমেগে দোকানদারের প্রশ্নের উত্তর দিলো অহনা।
” কিছু মনে করবেন না আপা, ওদিকটাতে কোন বেঞ্চই তো নাই। আর বুড়ো লোকই বা কোত্থেকে আসবে এখানে? আপনি কি বলছেন আপা? ”
” আরে ভাই, তুমি কি চোখে দেখোনা? ঐ ওদিকে দেখো… ঐ বুড়ো…!
আর এগোতো পারলো না অহনার কথা। সত্যিই তো, কোথায় বুড়ো লোকটা? আর কোথায় বা বেঞ্চটা? ওদিকটাতো ইট সুড়কিতে ভর্তি হয়ে আছে!

হায় আল্লাহ! কি হচ্ছে আমার সাথে এসব? নিজেকে আর যেন ধরে রাখতে পারছিলো না অহনা।
দেখে, গেটের বাইরে রাহুল এসে দাঁড়িয়েছে। দু’হাত বাড়িয়ে অহনাকে’ ‘এসো অহনা, আমার কাছে এসো’ বলে ডাকছে সে।
মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যায় অহনা।
পরিপূর্ণ জ্ঞান হারাবার মুহূর্তে দেখে, একটা ভাঙাচোরা শীর্ণ লোক অনবরত বলে চলেছেছে, ‘ না, না, অহনা, তুমি রাহুলের সাথে কখনোই যাবেনা “।