জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ২০২১ সালের সাড়াজাগানো উপন্যাস প্রথমা থেকে প্রকাশিত “গোপন একটি নাম”। উপন্যাসটির দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ করেছেন মাসুক হেলাল।উপন্যাসটির নামকরণে যেমন লেখক পাঠককে কৌতূহলী করে তুলেছেন, তেমনি পাঠশেষে উপন্যাসটির কাহিনিও পাঠককে গভীর ভাবনায় আন্দোলিত করে। এ উপন্যাসে গতানুগতিক কাহিনিতে প্লট বিন্যস্ত হয়নি।চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তিন ইন্টার্নি চিকিৎসকের সকালেবেলার নাস্তা খাওয়া দিয়ে কাহিনির শুরু। নাস্তার টেবিলে দৈনিক পত্রিকা পড়তে গিয়ে ইন্টার্নি চিকিৎসক সালেহ একটি খবর আবিষ্কার করে। যার শিরোনাম ছিল “শিক্ষার্থীরা কি হালের বলদ?”এক কলেজ শিক্ষিকার হাতে বেদম মার খাওয়া শিক্ষার্থীর নগ্ন পিঠের ছবি ছাপিয়ে পত্রিকাটি খবরটি গুরুত্বসহকারে পরিবেশন করেছে। এই খবরটি নিয়ে রাহাত,সালেহ ও সঞ্জয় নামক তিনবন্ধুর আড্ডা জমে ওঠে।তাদের সঙ্গী হয় সঞ্জয়ের প্রেমিকা, অন্যদের জুনিয়র বন্ধু অণিমা। চায়ের কাপে ঝড় তুলে সেদিনের মতো সকালের আড্ডা শেষ হয়ে গেলেও সন্ধ্যায় নাটকীয় এক ঘটনা রাহাতকে এ কাহিনির অনিবার্য নায়ক হিসেবে আবির্ভূত করে। সকালের খবরের কাগজের সংবাদ শিরোণাম হওয়া সেই কলেজ শিক্ষিকা ঘুমের ঔষধ খেয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এসে ভর্তি হন। ঘটনাচক্রে সেই ওয়ার্ডে ডিউটি পড়ে রাহাতের। এরপর থেকেই মূল কাহিনির শুরু। সুচিত্রা সেনের আদলের অপূর্ব সুন্দরী সেই কলেজ শিক্ষিকাকে প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যায় তাঁর ছাত্রের বয়সী ইন্টার্নি চিকিৎসক রাহাতের। নিজ গরজেই সে কলেজ শিক্ষিকা শাহানারার পরিবারের সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ খোঁজে। সুযোগ মিলেও যায়। শাহানারার আত্মহত্যা চেষ্টার কারণ উদঘাটন করতে গিয়ে রাহাত জেনে যায় তাঁর জীবনে অন্য এক পুরুষের উপস্থিতি।সেই জীবন স্যারকে ঘিরে রাহাতের মধ্যে সৃষ্টি হয় মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব।
এদিকে রাহাতের বাড়িওয়ালার মেয়ে আনিকাকে নিয়েও আরেকটি কাহিনি সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলে। আনিকা সুন্দরী,সপ্রতিভ। রাহাত মনে মনে ভাবে বাড়িওয়ালা বুঝি ডাক্তার ছেলে পেয়ে তাকেই মেয়েজামাই বানাবার সুযোগে রয়েছে। কিন্তু রাহাতের সেই কল্পনাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে আনিকা রবিনের সাথে প্রেম করে রাহাতেরই চোখের সামনে।কখনো কখনো রাহাতের রুমটাই আনিকাদের ডেটিং স্পট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম জুটি বীথি ও সালেহর প্রেম, বিচ্ছেদ, বিয়ের কাহিনিও চমৎকারভাবে উঠে এসেছে এ উপন্যাসে। অসমবর্ণের বিয়েতে বন্ধুদের সহযোগিতার বাস্তবানুগ চিত্রই লেখক তুলে ধরেছেন।
এ উপন্যাসের শাহানারা চরিত্রটি পাঠককে গভীরভাবে ভাবায়। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, সুচিত্রা সেন ধাঁচের সুন্দরী শাহানারা মনোগতভাবে ভীষণ নিঃসঙ্গ। জীবন স্যারকে ভালোবেসে তিনি সংসার পাততে চেয়েছিলেন। কিন্তু মনোজাগতিক সমস্যা তাতে বাধ সেধেছে। তীব্র সন্দেহ এবং ঈর্ষা তাঁদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে। এক পর্যায়ে পাঠক জানতে পারে ছাত্রীকে বেদমভাবে পেটানোর নেপথ্যে রয়েছে ওই ছাত্রীকে ঘিরে জীবন স্যারের প্রতি শাহানারার সন্দেহ। রাহাত চরিত্রটি যেন নিয়তির হাতের ক্রীড়নক। তার জীবনে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেছে। কোনোটাকেই সে রুখতে পারেনি। ম্যাডামের অতুলনীয় সৌন্দর্য তাকে আকৃষ্ট করেছিল। সে পতঙ্গের মতো ছুটে গেছে ম্যাডামের দিকে। যখন সে বুঝতে পেরেছে ম্যাডাম জীবন স্যারের প্রতি অনুরক্ত, তখন তার ভেতর দহনের সৃষ্টি হয়েছে। আনিকার প্রতি মনোযোগ দিয়ে সে ম্যাডামকে ভুলতে চাইলেও ম্যাডামের আকস্মিক মৃত্যু তাকে গভীর শূন্যতায় নিপতিত করেছে। আনিকা চরিত্রটি বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে। রবিন যেন আমাদের খুব চেনা। সালেহ,বীথি,সঞ্জয়,অণিমা, সৈয়দ আলী,চিশতি,বাড়িওয়ালা আমাদের চারপাশের চরিত্র।
সংলাপ রচনায় লেখক যুগানুগামী। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কথ্যভাষায় প্রমিত রীতি একেবারেই ব্যবহার করে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার অধিবাসীরা নিজেদের সমন্বিত সামাজিকজীবন চালু রাখার জন্য নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি করে নিয়েছে।যেটা ঠিক কোনো জেলার একক আঞ্চলিক ভাষা নয়। এটা বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সমন্বিত রূপ। এ উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা সেই ভাষাতেই কথা বলেছে,ব্যতিক্রম শুধু শাহানারা। তিনি নিজে প্রমিত বাংলায় কথা বলতেন এবং অন্যদের মুখেও তা শুনতে চাইতেন। রাহাতের মুখে আঞ্চলিক ভাষা শুনে তিনি খুব বিরক্তি নিয়ে বলেছিলেন,”আমার সাথে কথা বলার সময় ‘চইলা আসছি, ধইরা নেন’ এই সব বলবেন না প্লিজ। দুজন শিক্ষিত মানুষ, কলতলার বুয়ার ভাষায় কথা বলবে কেন?”
এ উপন্যাসে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এসেছে প্রবলভাবে। কখনো তা শাহানারার মধ্যে,কখনো তা রাহাতের মধ্যে। জীবন স্যারকে ভালোবেসে,দ্বিতীয়বারের মতো কাছে এসেও কেন শাহানারা ট্রাকের নিচে ঝাঁপ দিলো,তা লেখক আমাদের স্পষ্ট করেননি। তবে জীবন স্যারের একটি কথায় আমরাও চমকে উঠি। রাহাত জীবন স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিল কার উপর অভিমান করে শাহানারা এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলো! উত্তরে জীবন স্যার বলেছিলেন,” আমার তো মনে হয় আপনার ওপর। আপনার বাড়িওয়ালার মেয়ের সঙ্গে আপনার একটা সম্পর্ক আছে বলে সন্দেহ করছিল। আমাকে দু-একবার বলতে চেয়েছে,আমি বিশেষ পাত্তা দিইনি,চিনি তো ওকে…। সরি টু সে,শি ইজ আ মেন্টাল পেশেন্ট।”
গভীর ডিপ্রেশনে ভোগা শাহানারা কি আদৌ মেন্টাল পেশেন্ট ছিলেন? নাকি তিনি ভালোবাসার বুভুক্ষুতায় ভুগছিলেন? রাহাতের প্রতি কি তিনিও আকৃষ্ট হয়েছিলেন? রাহাতের ফ্ল্যাটে আসা, রাহাতের জন্য রান্না করা,রাহাতকে নিজের হোস্টেলে ডেকে নেওয়া,তারপর এক দুর্বল মুহূর্তে রাহাতের হাতে নিজেকে কিছুক্ষণের সঁপে দেওয়া সেই ধরনেরই ইঙ্গিত দেয়।
এ উপন্যাসে লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরী শুধু রাহাত শাহানারার ব্যক্তিজীবনের ছবিই আঁকেননি,তুলে এনেছেন রাজনৈতিক পরিস্থিতিও। চট্টগ্রাম মেডিকেলকে ঘিরে বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এ উপন্যাসে প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে। উঠে এসেছে প্রাক্তন ছাত্রনেতাদের ক্ষমতাও। সাধারণ মানুষের সাথে পুলিশের হৃদ্যতার চিত্র এঁকেছেন লেখক এ উপন্যাসে বাস্তবানুগভাবে।
মোবাইলফোনের যথেচ্ছা ব্যবহারের পরিণতি কীভাবে জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে তার নিখুঁত চিত্র ফুটে ওঠে আনিকা ও রাবিনের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার মধ্য দিয়ে।
সমকালীন সংকট রোহিঙ্গা প্রসঙ্গও এ উপন্যাসে এসেছে কাহিনির অনিবার্যতায়। এসেছে বর্তমানের শিক্ষিত মুসলমানদের ধর্মকেন্দ্রিক অতি রক্ষণশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়ার চিত্রও।চিকিৎসক দম্পতি রউফ-নাসরিন যার উদাহরণ।
বলতে গেলে পরিসরে উপন্যাসটি খুব বেশি বড় না হলেও,লেখকের বর্ণনাগুণে জীবনের বিস্তৃতরূপ এ উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রাহাত এবং আনিকার পরিণতি কী হয় তা নিয়ে বিশ্বজিৎ চৌধুরী আমাদের ধোঁয়াশায় রাখলেও, নায়কের মনের গহীনে লুকায়িত গোপন নামটি কার তা পাঠক স্পষ্টতই জেনে যায়। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে পাঠমুগ্ধ একটি উপন্যাসের। কাহিনি বিন্যাস, চরিত্র সৃষ্টি, সংলাপকুশলতা এবং মানসিক দ্বন্দ্বে “গোপন একটি নাম” একটি অসাধারণ উপন্যাস।আমরা লেখকের কাছ থেকে এমন আরও মুগ্ধপাঠ উপন্যাসের প্রত্যাশায় রইলাম।