নিশুতি রাত। চারপাশ চুপচাপ নিস্তব্ধ। কোথাও কেউ জেগে নেই। সময়টা অনেকটা নিরাপদ ভেবে আলমিরা হতে স্টেনগানটা বের করে আলতো গায়ে হাত বুলোয় কায়সার। কী ভারী, ঠা-া নিস্পন্দ স্টেনের কালো কুচকুচে লোহার নল। তার কতো আপন, চেনা এই স্টেন। স্টেনের সুট হোলগুলোতে কেমন যেনো বারুদ পোড়া ঘ্রাণ।
কায়সার এক সময় স্টেনের ‘সুটহোল’, ‘কি লক’ চেক করতে বসে যায়। লিভার স্প্রিং টেনে টেনে চেক করে দেখে। অনেকটা নিবিষ্টতায় ডুবে থাকা হঠাৎ করে পদশব্দে চমকে যায় কায়সার।
তাইতো নন্দিতা সেই কলাপাতা ডুরে শাড়ি নিরাভরণ সরু বেতসলতার মতো দু’হাত-আনত চোখের পাপড়ি জুড়ে এক ধরনের ত্রস্ততা।
– কি, কিছু বলতে নন্দিতা?
– না, কায়সার দা’, ছোট প্রত্যুত্তর নন্দিতার।
কায়সার এই মুহূর্তে অনেক কিছু ভাবলো। নন্দিতা কি কিছুই বলবে না? নন্দিতার বলার কী কিছুই নেই। নাহ্ তা হয় না। নন্দিতা পালাতেই চায়। কায়সার স্পষ্টত টের পায়-নন্দিতার কণ্ঠ-বোধে কিছু একটা বলার তৃষ্ণা যেনো লেগেই আছে।
হায়রে মানবজীবন/মানুষ একসময় কতো অসহায় হয়ে পড়ে। তার কোথাও যাওয়ার রাস্তা তখন আর খোলা থাকে না।
ঝিমধরা রাত। নিস্তব্ধতার প্রহর কেটে যেতে যেতে মুক্তিযোদ্ধা কায়সারের অনেক কথাই মনে পড়ে যায়। সেই দুধগাছি ব্রিজ অপারেশন-পাকিস্তানি আর্মি ট্রাক মাইন বসিয়ে উড়িয়ে দেয়া, হাজারো কুকীর্তির হোতা রাজাকার কমান্ডার মোর্শেদ মোল্লাকে ধরে এনে বেয়োনেট খুঁচিয়ে মারা-তারপর দলের অন্যান্যদের শরণখোলার ওদিকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা রথীনদের বাঁকখালী বাড়িতে এসে গা ঢাকা দেয়া।
কেননা, ক’দিন ধরে আশপাশে রেকি করে খবর পাওয়া গেছে, পাকিস্তানি আর্মি রাজাকাররা তাঁদের এই অপারেশনের পর মুক্তিবাহিনীর খোঁজে বসনডাঙ্গা আলীমপুরের ওদিকে কড়া পাহারা বসিয়েছে। তাই এই অবস্থায় কজনকে শরণখোলার ওদিকে সরিয়ে দিয়ে কায়সার উঠে এসেছে-রথীনদের এই বাড়িতে। উদ্দেশ্য-অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলে-অতপর দুলাপুর ক্যাম্পে গিয়া পৌঁছায়।
কায়সার রথীনদের বাড়িতে এরও আগে আরো বেশ ক’বার এসেছে। বাবা-বোন নন্দিতা আর রথীন এই তিনজনের বেশ সাজানো পরিবার। মা মারা গেছেন বছর তিনেক। এই ক’বার এখানে আসার সুবাদে কায়সার ওদের সবার কাছে অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে। কিন্তু নন্দিতাকে সবসময় এক ধরনের আচ্ছন্নতায় দেখে অবাক হয়ে যায় কায়সার। কিন্তু অতসব কিছু নিয়ে খুব একটা বেশি কিছু ভাবেনিও কায়সার।
তবে সেই বছরখানেক বাদে এক ঝড়-জলঝাপটার রাতে চুল-দাড়িতে একাকার আগুন-ভাটি চোখ-কাঁধে ঝোলানো স্টেন নিয়ে আধময়লা পোশাকের কায়সারকে দেখে সেই যে চমকে বিস্ময়ে হতবাক হলো-তার সেই বিস্ময়ের রেশ বুঝি এই ক’দিনে এখনো কাটেনি নন্দিতার।
সেই কলেজ পড়ুয়া মেয়ে নন্দিতা সোম আজ আরো ঘনীভূত রহস্য নিয়ে তার বিপদসংকুল জীবনকে ঘিরে ফেলেছে। এক নতুন প্রশ্ন হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
নন্দিতার এই ক’দিনের কার্য-কারণে এমন এক ধরনের চাপা রহস্য ছড়িয়ে পড়েছে তাতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কায়সার ভীষণ দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। সারাদিনের বার দুয়েক দেখায় কায়সার লক্ষ করে, নন্দিতার চোখে-মুখে কিসের যেনো ত্রস্ত-ইতিউতি ভাব। যার কোন সূত্র ঠিক ঠিক খুঁজে পায় না কায়সার।
রথীনের কথা মনে করে কায়সার। ওহ্ তাইতো রথীন হঠাৎ করে সামনের দিককার খবরাখবর নিতে বিকেলে সেই বহরমপুর গেছে। রথীনের বাবা মফস্বলেরু তহশিল অফিস হতে এখনো ফেরেনি। সত্যিই এই সময়টা কায়সারের জন্য ভারি অস্বস্তিকর ঠেকেছে।
আলমিরার পাল্লা টেনে স্টেনটা সরিয়ে রাখে কায়সার। নন্দিতার চোখে মুখে কিসের বাঁধভাঙা দৃষ্টি। কিছু বলতে চায় নন্দিতা।
– কায়সার দা’ আর কতদিন যুদ্ধ চলবে আপনাদের? কখন ঘরে ফেরবেন। কায়সার দা’…? নন্দিতা চকিতে প্রশ্ন করে।
যুদ্ধ-ঘরে ফেরা এমনি পরপর বিপরীত অথচ ব্যঞ্জনাময় শব্দগুলো মুক্তিযোদ্ধা কায়সারকে এ মুহূর্তে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তোলে। নিজকে অনেকাংশে নষ্টাললজিয়ায় তাড়িয়ে ফেরে।
কায়সার দা’ আপনি এমন ধরনের দুঃখ-কষ্ট, রক্তঝরার মাঝে কিসের জীবনবোধ, কিসের আকাক্সক্ষা নিয়ে বেঁচে আছেন। কায়সারের মৌনতায় চমকে যায় নন্দিতা।
নন্দিতার কথায় ভারি দোটানায় পড়ে যায় কায়সার। এ কোন নন্দিতা? এ কি নন্দিতার শুধু জানতে চাওয়া? নাকি অনেক যতেœ বুকের ভেতর বসত বাঁধা স্বপ্ন-বাসরের স্বগত উচ্চারণ। কিছুই বলে না কায়সার। নিঃশব্দে রাতের প্রহর কাটতে থাকে।
নন্দিতা ধীরে ধীরে আরো সপ্রতিভ হয়। কায়সার দা’ আপনি তো আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না, আপনার কি কিছুই বলার নেই? একজন সৈনিকের জীবন কী শুধু যুদ্ধেই সীমিত? তার কি নিজের করে কিছুই ভাবার নেই? কিছুই বলার নেই?
এক ধরনের ক্ষোভ-দুঃখময়তা নিয়ে নন্দিতা এ মুহূর্তে নিজে একজন পরিপূর্ণা নারীর অবয়বে-কায়সারের মুখোমুখি দাঁড়ায়। নন্দিতার কণ্ঠে-বচনে এক ভিন্ন প্রচ্ছন্নতা ছড়িয়ে পড়ে।
নন্দিতার দিকে ফিরে তাকায় কায়সার। নন্দিতার এই পড়ার ঘরের চারদিকে চোখ বুলায় সে। ভারী সুন্দর কুশিকাঁটা ফুল কাজ করেছে নন্দিতা। আয়নায় বাঁধাই করা দেয়ালে ঝোলানো কয়েকটার দিকে চোখ ফেরায় কায়সার। সব ক’টার নিচে ডান কোণায় লেখা এন এস নন্দিতা সোম। বুক সেলফ-আলমিরা-টেবিলের বইপত্তর এমনি সব কিছুতেই রুচিময়-øিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। যা সত্যিই দেখার মতো।
সেই মেয়ে নন্দিতা সোম-আজ এক অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব নিয়ে কায়সারের মুখোমুখি। কী বলার আছে কায়সারের? তারও তো নৌকো-জীবন। চারদিকে হানাদার প্রতিরোধের ঢেউ। দেশ-জনপদে আশা স্বপ্নভঙ্গের চালচিত্র, দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী-রাজাকার-আলবদরদের নিষ্ঠুর, ক্রুরতা, মৌন, মূক, দুঃখিনী গ্রাম বাংলা এতসব চোখে চোখে নিয়ে কায়সার মুক্তিযুদ্ধে উৎসর্গীত প্রাণ অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা।
স্টেনের বারুদ ঘ্রাণ, গ্রেনেডের ধ্বংস-বিস্বাদে কায়সার তো ভুলেই গেছে-জীবনের যে আরো একটা দিক আছে। চোখবুজে অসম পরাধীনতার যাঁতাকলে নিজকে অসহায়ভাবে সঁপে দিয়েও তো মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করতে পারে। হৃদয়ঘটিত কিছু ব্যাপার অনুষঙ্গ তো মানুষের জীবনযাপনের সাথে সাথেই পথ চলে। আর কায়সারও তো এই চিন্তা-চেতনায় সম্পৃক্ত একজন মানুষ।
তবু কেমন করে কায়সার বোঝাবে নন্দিতাকে-নন্দিতা বেঁচে থাকার এই উত্তরাধিকারের সংগ্রামই এই মুহূর্তে আমার কাছে সবচেয়ে বড় এবং মহৎ। অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধই-আমার একমাত্র উপজীব্য-আমার পবিত্র কর্তব্য দেশের প্রতি, দেশের মাটির প্রতি, আমার নৈতিক দায়িত্ব। এখানেই তো আমার একমাত্র সুখ। সত্যিকারের আÍতৃপ্তি। আমার আর কী-ই বা ভাবার আছে? কী ই বা চাওয়ার-বলার আছে এখন।
তারপরও কিছুই বলা হয় না কায়সারের। কিছুই বলে না কায়সার নন্দিতাকে। পাশ ফিরে তাকায় কায়সার। নন্দিতা নেই। নিঃশব্দে সরে গেছে। কী করবে কায়সার?
দীর্ঘসময় চলে গেলে পরে-অতপর এক প্রচ- ভাঙচুর হতে আর এক কায়সার জেগে উঠলে কায়সার ভাবে-স্টেনের অগণিত ‘সুট হোল’ হতে অগণিত নন্দিতা যেনো তার দিকে অনেক আকুতি নিয়ে চেয়ে আছে সেই-একই হৃদয় কাব্য নিয়ে, স্বপ্ন আকাক্সক্ষা নিয়ে।
অনেক কিছু আদ্যোপান্ত ভাবার পর অতঃপর কায়সার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। তার আর পিছু ফেরার সময়-অবকাশ নেই। পড়ে থাক-সেই স্বপ্নমেদুর সুখের পসরা-হাতছানি। নন্দিতা তাকে পুরুষ অথবা কাপুরুষ যা-ই ভাবে ভাবুক এ মুহূর্তে সে নন্দিতার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে রাজি নয়। সে হোক গৌরবের বা পরাজয়েরও।
ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকের সাথে পাল্লা দিয়ে বাঁকখালীর রাত ক্রমশঃ গভীর হতে থাকে। ঘুমুচ্ছে পুরো অজ পাড়াগাঁ। সাদামাটা কায়সারের ভেতর হতে ইস্পাত কঠিন আর এক কায়সার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে। জেগে ওঠে কর্তব্য নিষ্ঠ-নির্মোহ আর এক মুক্তিযোদ্ধা কায়সার।
ঘুরে দাঁড়ায় কায়সার। আলমিরা হতে প্রিয় স্টেনটা বের করে ম্যাগজিনগুলো চেকআপ করে আÍতৃপ্তিতে বুক ভরে শ্বাস নেয় কায়সার। বারুদ বারুদ ঘ্রাণের আমেজ সুটহোলগুলোতে।
সেই ক’মাসের সুখ-দুঃখের সাথী স্টেনটিকে সযতেœ বুকে আঁকড়ে ধরে কেনো যেনো বলতে ইচ্ছে হলো কায়সারের ‘নন্দিতা তুমি কবে অনেক অনেক সুখী হবে। কবে তোমার এক ভিন্ন নীরবতায় এমন একটি রাত একজন মানুষ মুগ্ধ হবে?’ কিন্তু তারপরও সে অন্তহীন চাওয়ার জগৎ হতে দারুণভাবে ফিরে আসে কায়সার। তার চেতনার কাছে হার মানে হৃদয় গাঁথা।
কোথাও কেউ জেগে নেই। সারা বাঁকখালী গ্রাম গভীর ঘুম-নিস্তব্ধতায় সমর্পিত। এই গাঁ কাঁটা দেয়া নীরব নিস্তব্ধতা পেরিয়ে, বুকে শব্দ নিঃশব্দের ভালোবাসা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কায়সার ভিন্নতর এক যুদ্ধ জয়ের পর দ্রুত আর এক যুদ্ধের প্রস্তুতিতে নেমে পড়ে।