আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭,১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে মজুরী বৈষম্য,কর্ম ঘন্টা নির্দিষ্ট করা,কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে সূতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে ।ঐ মিছিলে পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও দমন পীড়ন করে। ১৯০৯ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জাটকিনের নেতৃত্বে নিউইয়র্কে প্রথম সম্মেলন হয়। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ২য় নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়,সম্মেলনে ক্লারা জাটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। ১৯১৪ সাল থেকে বিশ্বের কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার আগে নারী দিবস পালন করা হত। ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘ দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন দেশকে আহবান করে।বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি সম্মান দেখানো ও নারীর কাজের সামাজিক মূল্যায়নের দাবীতে দিবসটি পালন করা হয়। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সরকারি ছুটি থাকে,যেমন-আফগানিস্থান,রাশিয়া,মঙ্গোলিয়া,কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, কিউবা, জর্জিয়া, গিনিবিস্উা, ইরিত্রিয়া, তাজিকিস্থান, কিরগিজিস্থান,লাওস,জাম্বিয়া,ইউক্রেন,তুর্কমেনিস্থান প্রভৃতি।এছাড়া চীন,নেপাল, মাদাগাস্কার,মেসিডোনিয়ায় এদিন শুধু নারীরা ছুটি ভোগ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ,ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে দিবসটি পালন করে থাকে। আমাদের দেশে এমন এক পরিস্থিতিতে নারী দিবস পালন করা হবে যখন প্রতিদিন ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচেছ। খবরগুলোর নির্মমতা, বর্বরতা,বিভৎসতা এতটাই যে বিবেকবান মানুষ মাত্রই আঁতকে উঠে। তবে এক শ্রেনীর মানুষ আছে যারা নির্যাতিত মেয়েটির দোষ খুঁজতে তৎপর। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে, কাজ থেকে ফেরার পথে,শিক্ষকের বাসায়, মাদ্রাসায়,ওষুধ কিনে ফেরার পথে, রিক্সা থেকে নামিয়ে মেয়েরা ধর্ষিত হয়। মেয়েরা ঘরেও নিরাপদ নয়– বাবা, শ্বশুর, ভাই, দেবর, মামা, চাচা,প্রতিবেশি দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। নিজ ঘরে একটা পশু পাখিও নিরাপদ কিন্তু মেয়েরা নিরাপদ নয়,ঘরের দরজা ভেঙ্গে তাদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। ২০২০ সালে করোনা মহামারির মধ্যে মানুষ দেখেছে নারীর প্রতি মানবিক খরা ও মহামারি। নারীর অগ্রগতি থামানোর জন্য এ যেন এক পরিকল্পিত শকুনী থাবা। গত ১০ মাসে শুধুমাত্র রাজধানীতে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৫২৫ টি। ২০২০ সালের ১জানুয়ারি থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত রাজধানীর ৫০ থানার তথ্য নিয়ে প্রথম আলো পত্রিকা এই রিপোর্ট করে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একটাই চাওয়া আমাদের মেয়ে,মা, বোন যেন নির্ভয়ে, নিরাপদে পথ চলতে পারে-কোন শকুনের থাবা যেন তাদের পথ রোধ করতে না পারে। গ্রামের কিশোরী মেয়েটি যেন আনন্দে গাছের ডালে দোলনায় দোল খেতে পারে, সরিষা ক্ষেতে ওড়াতে পারে স্বপ্নের ফানুষ, পুকুর -নদীতে দল বেঁধে খেলতে পারে ডুব সাঁতার,বই-খাতা নিয়ে নির্বিঘ্নে হেঁটে যেতে পারে স্কুল,কলেজে। শহরের মেয়েটি যেন মাÑবাবার প্রহরায় পথ চলতে না হয়। নারী দিবসের প্রত্যাশা নারী নিরাপদে থাক , বেঁচে থাক। নারী শিক্ষা, নারী ক্ষমতায়নের মিছিল যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। আশার কথা হচ্ছে সম্প্রতি সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করেছে মৃত্যদন্ড। কিন্তু যে ঘটনার পেছনে বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে শুধুমাত্র আইন করে তা বন্ধ করা সম্ভব নয়। শিশু, কিশোরদের মানসিক বিকাশের সমস্যা, সামাজিক বৈষম্য,দারিদ্র,উপযুক্ত শিক্ষার অভাব,পারিবারিক অপরাধ,নেশা ও মাদকের সহজ প্রাপ্তি,অবৈধ আয়,অসুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ প্রভৃতি সমস্যা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার। পারিবারিক শিক্ষায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বিশেষ করে মা তার মেয়ে শিশুকে সংবেদনশীল বিষয়গুলো খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন। প্রতিবাদ করতে শেখান-মেয়েদের শরীরে হাত দিলে আঙ্গুলটা মচকে দিতে শেখান,শিক্ষার পাশাপাশি আত্মরক্ষার কৌশল শেখান।ছেলে সন্তানকে ছোট থেকে নারীর প্রতি সহমর্মিতা,সহযোগিতা ও সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে গড়ে তুলুন। পরিবারের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন খুব বেশি প্রয়োজন। মেয়ে শিশু,কিশোরীদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার গড়ে তুললে মা-বাবার অনুপস্থিতিতে নিরাপদ সময় কাটাতে পারবে। এছাড়া পাড়া মহল্লায় লাইব্রেরি,ক্লাব,খেলার মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে,কিশোরদের জন্য সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থা থাকলে তারা গ্যাং কালচারে আকৃষ্ট হবেনা। ১৯২০ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নে গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে স্কুল শিক্ষক মাকারেন্কা দায়িত্ব পেয়েছিলেন কিশোর অপরাধীদের সংশোধন করার,বিপথগামী শিশুদের জন্য তৈরি হয় গোর্কি কলোনি। তিনি বেশ কয়েকটি নিবন্ধ ও একটি সার্বজনীন প্রতিবেদন ইউক্রেনের সম্মেলনে উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর উদ্ভাবিত শিক্ষা পদ্ধতির প্রভাবে গোর্কি কলোনিতে বিকশিত হয় বহু রুশ প্রতিভা।তিনি বিবেচনা করেছিলেন শিশু ও তরুনদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিকভাবে বিকাশের জন্য কাজ অপরিহার্য। তিনি বলেন,“শিক্ষার্থীদের দেখানো দরকার যে,তাদের কাজ এবং জীবন দেশের কাজ এবং জীবনের অংশ”। আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়-১৮ শতকের শেষে ইংল্যান্ডের ম্যানচেষ্টার শহরে কিশোর গ্যাং নগরবাসীকে অতীষ্ট করে তুলেছিল। তখন ল্যাডস ক্লাব নামে ফুটবল ক্লাব গড়ে তোলা হয়। কয়েক বছর পর এর নাম হয় সেন্ট মার্কস ফুটবল ক্লাব। দেখা গেল সেখানে অপরাধের ঘটনা কমতে শুরু করেছে,আজ সেই ক্লাব ম্যানচেষ্টার সিটি ফুটবল ক্লাব নামে বিশ্বখ্যাত। রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন আইনের যথাযথ প্রয়োগ করলে অপরাধের সংখ্যা কমবে। আইনের কোন ফাঁক দিয়ে দোষী যেন বের হতে না পারে তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। নেশা ও মাদক জাতীয় দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ,পর্ণ সাইটগুলো বন্ধ করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভয়াবহ পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। আগামীতে আমরা যেন নারী দিবস পালন করতে পারি আনন্দমূখর পরিবেশে। নির্ভয়ে যেন নারীরা এগিয়ে যায়।। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্য যেন সার্থক হয়।