একটানা লিখতে লিখতে চোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। তখনই খেয়াল হয়, টেবিলের উপর রিসেট পড়ে রয়েছে। পাশে গ্লাসভর্তি পানি। পর্দার ফাঁকে গিন্নীর বুক উঠানামা করার দৃশ্য। ঠিক চোরের মতো রিসেট গিলে পানি চালান করে দেয় তন্ময় স্যানাল। ঔষধ খালি না ভরাপেটে খেলো, সেটা কে দেখছে!
দু’দিন ধরে প্রচন্ড জ্বরে ভুগছে তন্ময়। শরীরের একেকটা অঙ্গ যেন ব্যথায় ছিঁড়ে পড়ছে। কিন্তু একটানা নিজের মনকে বলে চলেছে, “একটু চেষ্টা কর, বাপ। বইটা শেষ করতেই হবে, যেমন করে হোক, যদি—-” বাকীটা ভাবতে না চাইলেও মনের গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়ায় সেসব। করোনার মারাত্মক ছোবলে জর্জরিত আজ বিশ্ব। জ্বর ব্যাথা, শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি কত রকম যন্ত্রনা যে জড়িয়ে আছে, কেবল ভুক্তভূগিরাই বর্ননা দিতে সক্ষম। চিন্তার অদম্য জোয়ারকে থামিয়ে দিয়ে এতক্ষণ পর্যন্ত লিখছিল তন্ময়। প্রকাশকের তাড়া যেন ক্যাটালিস্টের কাজ করছিল অবিরাম।
হঠাৎ ঘুমজড়ানো কন্ঠে সুবর্ণা বলে উঠে,
“এ্যাই, এখনো শেষ হয়নি তোমার? কি যে করো না!’ এত মিষ্টি করে কেন যে অন্য সময় বলে না সুবর্ণা! আধোঘুমে যেন নেশার ঘোরে শব্দগুলো মধুর হয়ে উঠে। মধ্যরাতের এই মায়াবী আকর্ষণ যে কোন পুরুষকেই মাতাল করে তোলে। কিন্তু তন্ময় আজ মাতাল নয়। উদ্বেগের এক গুবরে পোকা যেন তার ভেতরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। চেয়ার ছাড়ার আগে একবার এফবি’তে ঢুঁ মারা তন্ময়ের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। নিশিজাগা পাখিগুলো নিঃশব্দে চ্যাট চালিয়ে যায় এ সময়। তার ইনবক্সে দুই বন্ধুর ম্যাসেজ, সেই সাথে প্রকাশকের উপস্থিতি- ‘ভাইজান মেলাতো এসে পড়লো ঘাড়ে’। বাক্যটা পড়েই হাসি পেল তন্ময়ের। প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে পৃথিবীর মুখ, সেখানে আদৌ বইমেলা হবে কি’না, স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানে না।
শ্যামাঙ্গিনী স্নিগ্ধা লিখেছে, ‘কিরে শালা, এখনও ঝুঁকে আছিস খাতায়?’ তন্ময় জবাব দেয়, ‘তোর কি তাতে? চরকা নিজেরটায় তেল দিতে থাক।’ বন্ধু রশীদের ম্যাসেজে উদ্বেগ, ‘ভাবী বলল তোর শরীরটা ভালো নেই, খেয়াল রাখিস।’ তন্ময়ের উদাসী জবাব, ‘খেয়াল রেখেও কি পারবো বেঁচে থাকতে? চলেতো যেতেই হবে।’ আজকাল এরকম কথাবার্তাই হরদম শোনা যাচ্ছে। মৃত্যুই একমাত্র নিশ্চিত বিষয় জেনেও মানুষ কেমন অনিশ্চিত ভীতিতে ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে। আচমকা পেটে মোচড় দেয় তন্ময়ের। চেয়ার সরিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে গা গুলিয়ে উঠে। তার হাতের ধাক্কায় টেবিল নড়ে উঠাতে গ্লাসটা মেঝেয় পড়ে চৌচির হয়ে যায়।
গ্লাসভাঙ্গার শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বসে সুবর্ণা। কয়েক সেকেন্ড অবুঝের মতো এদিক সেদিক তাকায়। এরপর বিছানা ছেড়ে ছুটে আসে আর ব্যাকুল স্বরে জানতে চায়,
এ্যাই, কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন?
টকটকে লাল চোখে অদ্ভুত আকুতি তন্ময়ের। গলায় কি যেন ফুটছে তার। আটকে আসছে বুঝি শ্বাস। দু’হাত গলার কাছে নিয়ে সে চেষ্টা করছে, কাঁটার মতো যা কিছু আছে, সব নিচে নেমে যায়। একফোঁটা বাতাসের জন্য খাবি খাচ্ছে তন্ময়ের শরীরটা। সুবর্ণা পাগলের মতো তার বাহুতে ঝাঁকি দিয়ে বলছে “এ্যাই, তুমিতো পড়ে যাচ্ছো, কি হয়েছে তোমার? কেমন লাগছে? পানি খাবে?” সুবর্ণা পানি আনতে ছুটে যাওয়ার সময় কাঁচের টুকরো আটকে যায় তার কোমল পায়ে। ‘উফ!’ বলে নিচু হয়ে রক্তমাখা টুকরোটা তুলছে সুবর্ণা-
চোখ বন্ধ করার আগে এই ছিল তন্ময়ের দেখা শেষ দৃশ্য। এরপর অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার, অক্সিজেন আর অসমাপ্ত ‘কালোছায়া’ উপন্যাসের অসহায় খাতা মিলেমিশে অন্যরকম গল্প। সেটা না হয় আরেক দিন হবে!