আমি পারলাম, শেষ পর্যন্ত আমি ওকে বলে দিতে পারলাম। অনেকক্ষণ ধরে মনে মনে সাজাচ্ছিলাম কীভাবে বলবো, কিন্তু বলে উঠতে পারছিলাম না।এ মুহূর্তে পেরে গেলাম। উফ্! কী যে শান্তি লাগছে এখন। আমার কথাটা শুনে ও হতভম্ব হয়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমি বেশ মজা পাচ্ছিলাম।মনের ভেতর ওর প্রতি জমে থাকা তীব্র ঘৃণাটা কি একবার উথলে উঠেছিল? হয়তো উঠেছিল। ও এতটাই বিস্মিত হয়েছিল যে ওর মুখে কোনো কথা সরছিল না। ও ভাবতে পারেনি।আমিও যে পারি ও ভাবতে পারেনি। ভেবেছিল ও একাই করবে। যা খুশি ও একাই করবে। কিন্তু না, আমিও পেরেছি। আমিও পারি।
ওর সাথে আমার পরিচয় ভার্সিটিতে। প্রথম পরিচয়েই আমাকে নাকি ওর ভালো লেগে গিয়েছিল। আমি অবশ্য তেমনটি ভাবিনি। ওকে আমি তেমন করে মনেও রাখিনি। দ্বিতীয়বার যখন দেখা হলো ও নিজ থেকেই জানিয়েছিল আমাকে তার ভালোলাগার কথা। আমি শুনেছিলাম,কিন্তু কোনো কথা দিইনি। তৃতীয়বার দেখাতে নাছোড়বান্দা ও আমার কাছ থেকে কথা আদায় করে ছেড়েছিল। তারপর চুটিয়ে প্রেম করেছি চারবছর। এরপর বিয়ে।
বিয়ের পর আমরা বেশ ভালোই ছিলাম। ও ভালো চাকরি পেয়েছিলো।আমাকে কিছু করতে দেয়নি সে। আমি গৃহিণীই হয়ে গেলাম। তবে সময়টা আমাদের বেশ ভালোই কাটছিল।শুক্রবারে দুজনে ইচ্ছেমতো ঘুরতাম। আমাদের সেই দিনগুলো ছিল প্রজাপতিদিন। তারপর একসময় প্রেগন্যান্ট হলাম। শরীরটা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো।এসময় ওর অফিসের ব্যস্ততা বেড়ে গেলো।যতটুকু সময় আমি ওর কাছ থেকে আশা করেছিলাম, ও দিতে পারছিলো না। আমি মনমরা হয়ে পড়ে থাকতাম একা একা বাসায়। ওর বাবা মা গ্রামে থাকতেন। তাঁরাও এলেন না কেউ আমার এ দুঃসময়ে। আমার জেদের কারণে ওকে আমার পরিবার বিয়ে দিয়েছিল ঠিকই,কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। তাই আমিও আমাদের বাসায় কম যেতাম। ওরাও কম আসতো। তাই আমার প্রেগন্যান্সিকালটা খুবই নিঃসঙ্গ কাটছিল। তবুও আমি লড়াই করছিলাম।আমার চোখেমুখে ছিল অলীক জগতের স্বপ্ন।আমি বাস্তবকে এড়িয়ে এক অলীক জগতে বাসা বেঁধেছিলাম। সেখানে আমি নিজের মনের মতো কল্পনাকে থরে থরে সাজিয়ে দিন যাপন করতাম। অফিসের ব্যস্ততায় ও আমাকে সময় দিতো না বললেই চলে! তবুও আমি এক ভীষণ কল্পনাময় পাখায় ভর করে করে এক একটি দিন যাপন করছিলাম।
একসময় আমার প্রতীক্ষার শেষ হলো। এক দেবশিশু আমার কোল আলো করে পৃথিবীর মুখ দেখলো। আমি তার নাম রাখলাম স্বপ্ন। স্বপ্নকে পেয়ে আমাদের দিনগুলো আবার আনন্দে ভরে উঠলো। স্বপ্নের বাবার ব্যস্ততা যদিও কমেনি তবুও আমি আর একাকীত্বে ভুগছিলাম না। স্বপ্নকে নিয়ে আমি সারাদিন মেতে থাকতাম।নিজের দিকে তাকানোর অবসরটুকুও আমার ছিল না। ওর ইদানিং শুক্রবারেও হঠাৎ হঠাৎ অফিসে যেতে হয়। তবে এমনিতে যায় না, যেদিন ফোন আসে সেদিনই বেরিয়ে যেতে হয়। তবে এর পরের শুক্রবারটা ও আমাদের নিয়ে বেরিয়ে যায়। সারাদিন ইচ্ছেমতো ঘুরি আমরা,দুপুরে বাইরে খাই। তবে বিরক্ত লাগে এর মধ্যেই বার বার ফোন আসে ওর। অফিসিয়াল কথা সে আবার আমার সামনে বলে না। বার বার ফোন নিয়ে উঠে যায়। ওর জন্য তখন আমার খুব মায়া হয়।বেচারা অফিস আর পরিবার দুটো সমানতালে সামলাতে গিয়ে খুব হিমশিম খাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে খুব গর্বও অনুভব করি,আমার স্বামীভাগ্য খুব ভালো। এমনভাবে বউ-বাচ্চা নিয়ে কজনই বা বেড়ায়! দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিলো আমাদের।
একদিন ও অফিস থেকে ফিরে খুব হতাশ হয়ে বললো ওকে কুষ্টিয়া যেতে হবে অফিসট্যুরে।আমি অবাক হলাম।কারণ পাঁচ বছরের বিবাহিতজীবনে ও কখনো ট্যুরে যায়নি এবং ট্যুরের কথা কখনো ওর মুখে শুনিওনি। ও বললো এ সিস্টেম নতুন চালু হয়েছে ওদের অফিসে। ও না যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে,কিন্তু বস কোনো কথাই শুনতে নারাজ। ওর বিষণ্নতা দেখে আমার খুব খারাপ লাগছিলো, কিন্তু অফিসিয়াল কাজ যখন যেতে তো হবেই। আমি ওকে সান্ত¡না দিয়ে সব গুছিয়ে দিলাম। আমাকে সাবধানে থাকতে বলে স্বপ্নকে আদর করে ও বিদায় নিলো। যাওয়ার সময় আমার ঠোঁটে গভীর চুম্বন দিয়ে বললো,
-প্রতিটি মুহূর্তে তোমার বিরহে মরবো। ইচ্ছে করছে চাকরিটা এক্ষুণি ছেড়ে দিতে।
আমি হেসে বললাম,
-পাগলামি করো না তো। কিচ্ছু হবে না। ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো।
বিয়ের পর থেকে আমি কখনো একা থাকিনি। খুব অস্বস্তি লাগছিল আমার। কেমন যেন ভয়ও করছিল। রাত নয়টার দিকে স্বপ্নকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে খুব একাকীত্বে ভুগছিলাম। ওকে ফোন করলাম, ফোন বন্ধ। প্রথমে মনে একবার ধাক্কা খেলো, কোনো বিপদ হয়নি তো! পরে মনে হলো হয়তো ঘুমাচ্ছে। ওর একটা বাজে স্বভাব আছে। ঘুমাবার সময় ফোন বন্ধ রাখে। খুব কান্না পাচ্ছিল এরকম একাকী থাকতে। হঠাৎ আমার রিং টোন বেজে উঠলো। মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। ভেবেছিলাম ও, কিন্তু ও না, আমার মাসতুতো দিদি ফোন করেছে। প্রায় দুবছর দিদির সাথে দেখা হয়নি,এর মাঝে কথাও হয়নি। আমি তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করলাম।
ও পাশ থেকে দিদি বললো,
-কী রে কেমন আছিস তুই? তোর কোনো খবর টবর নেই কেন?
আমি বললাম,
-দিদি ভালো আছি।তোমারও তো কোনো খবর নেই।এতদিন পর আমাকে মনে পড়লো?
দিদি একথা সেকথা বলার পর বললো,
-শোন, তোকে একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি। তোর বর কই?
আমি বললাম,
-ও তো অফিসের কাজে কুষ্টিয়া গেছে।কেন বলো তো?
দিদি একটু থামলো,তারপর বললো,
-শোন,তুই কিন্তু মাথা গরম করবি না।খুব ঠাণ্ডা মাথায় শুনবি।সেদিন আমার বান্ধবী বেলী এসেছিল আমাদের বাসায়। ও তো বিধবা হয়েছে কয়েক বছর আগে। বাচ্চাকাচ্চাও নেই ওর।এখন একটা চাকরি করে। সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। আমরা ওকে নিয়ে খুব টেনশনে থাকতাম। যাই হোক,সেদিন দেখলাম খুব উচ্ছ্বল।আমি বললাম, কী রে তুই তো বেশ চনমনে হয়ে গেছিস।ব্যাপারখানা কী?ও চোখ নাচিয়ে বললো,একজন মনের মতো বন্ধু পেয়েছি রে এতদিনে।আমার সব কষ্টের ভার এখন ও নিয়ে নিয়েছে। আমি চাইলে ও আমাকে বিয়ে করতেও রাজি।তবে আমি রাজি হচ্ছি না,কারণ ওর বউ বাচ্চা আছে। তবে ও খুব জোরাজুরি করছে।বলছে আমাকে আলাদা ফ্ল্যাটে রাখবে। ওর চাপে শেষপর্যন্ত হয়তো রাজি হয়ে যাবো।
দিদির মুখে টেলিফোনে ওর বান্ধবীর বন্ধু জুটানোর কাহিনি শুনতে আমার বিরক্ত লাগছিলো। কোথায় এতদিন পরে ফোন করেছে নিজের কথা বলবে,তা না করে বান্ধবীর বন্ধু জোটানোর কাহিনি আমাকে শোনাচ্ছে। তাও যদি আমি বান্ধবীকে চিনতাম!আমার এ দিদিটা এমনই। এত বাড়তি কথা বলতে পারে।
আমি বিরক্তি গোপন রেখে দিদিকে বললাম,
– দিদি তোমার কথা বলো,তোমার বান্ধবীর কথা থাক।
দিদি আমাকে ধমকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-আগে পুরোটা শোন, তারপর কথা বলিস। বেলীর মুখে ওর নতুন বন্ধুর এত উদারতার গল্প শুনে আমি বললাম, বাব্বা! এমন বন্ধুও আছে?দেখি তোর বন্ধুর একটা ছবি দেখা, একটু দেখি। বেলী ওর মোবাইলে তোলা কিছু ছবি দেখালো।সীবীচে তোলা ছবিগুলো।বিয়ে না করলেও দুজন যে বেশ ঘনিষ্টতায় পৌঁছেছে ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়। ছবিগুলো দেখে আমার তো আক্কেলগুড়ুম। কেন বল তো?
আমি বললাম,
-কেন?
দিদি কোনো ভনিতা না করে সরাসরি বললো,
-বেলীর বন্ধুটা হলো তোর বর।
আমি দিদিকে উড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-দূর,তুমি কাকে দেখতে কাকে দেখেছো।ওর সাথে হয়তো চেহারার মিল আছে। ও বেলীর সাথে ঘুরবে কখন? শুক্রবারে তো ও আমাদের সাথেই থাকে,আর অন্য ছয়দিন অফিস করে। ওর অফিসে কী যে কাজের চাপ!
দিদি বললো,
– জানতাম তুই বিশ্বাস করবি না। আমিও প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে ওর কাছ থেকে নাম ঠিকানা নিয়েই শিউর হলাম। আমার কর্তব্য ছিল তোকে জানিয়ে দেওয়া,তাই জানালাম। যদিও বেলীকে আমি কিছুই বলিনি। এবার তোর যা খুশি কর। বাসায় আসিস।এখন রাখছি।
ফোনটা রেখে দিলো দিদি। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। এসব কি সত্য! আমার মন বলছে সব মিথ্যা। দিদির কোথাও ভুল হচ্ছে! কিন্তু দিদি যে বললো নাম ঠিকানা নিয়েছে। খুব অস্থির হয়ে উঠলো মন। করবো না করবো না করেও ওকে ফোন করলাম। এবার রিসিভ করলো ও। আমি বললাম,
-কী অবস্থা তোমার? কতদূর গেলে?
ও জানালো।কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলাম।মনকে কিছুতেই শান্ত রাখতে পারছিলাম না। রাতে আর কিছুই খেলাম না।স্বপ্নকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
তিনদিন পর ও ফিরে এলো। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। স্বপ্নকে কোলে নিয়ে ওর হাতে একটা খেলনা দিলো। আমার মাথায় শুধুই ঘুরছিল বেলী নামটা। যতই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলাম,ততই ভেতর থেকে কে যেন আমাকে অস্থির করে তুলছিল। ও কিন্তু একদম স্বাভাবিক। খেতে বসে আমাকে বললো,
-তোমাদের চিন্তায় ঠিকমতো অফিসের কাজ করতে পারছিলাম না। বার বার তোমাদের কথা মনে পড়ছিল।
আমি বললাম,
-কই,তেমন ফোন তো করোনি!
ও বললো,
-কাজের চাপে পারিনি গো।
খাওয়া দাওয়ার পর ও খাটে গা এলিয়ে দিলো। সবকিছু গুছিয়ে আমি ওর মুখোমুখি বসলাম,তারপর চোখে চোখ রেখে বললাম,
-বেলী আপা ফোন করেছিল।
মুহূর্তেই ওর মুখ সাদা হয়ে গেলো। বিস্ময়ে ওর চোখগুলো যেন বেরিয়ে আসবে। থোতলাতে থোতলাতে বললো,
-বে বে বেলী বে বে বে বেলী কে?
আমি শান্ত চোখে বললাম,
-তুমিই বলো বেলী কে? উনি তো আমায় বললেন উনি আমার সতীন।
ও তড়াক করে উঠে বসলো,বললো,
-সব মিথ্যে কথা। বেলী নামের কাউকে আমি চিনি না। তোমাকে এসব বাজে কথা কে বলেছে? কে বলেছে বলো।
আমি স্মিত হেসে বললাম,
-বেলী আপাই তো বললো।আর কে বলবে?
ও জোর দিয়ে বললো,
-প্রশ্নই আসে না বেলী বলার। বেলী কখনো এসব বলবে না। তুমি শুধু নামটা বলো কে তোমার কানে এসব তুলেছে?
আমি আবারও হাসলাম। তারপর বললাম,
-তুমি না এইমাত্র বললে বেলী নামের কাউকে তুমি চেনো না। এখন আবার বলছো,বেলী কখনো এসব বলবে না। আসলে বেলী আপাই বলেছে। উনি আমাকে বললেন, আমি সরে গেলে তিনি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি।
ওর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেলো। কথা গুছিয়ে বলতে পারছিল না। তবুও জোর দিয়ে বললো,
-কখন ফোন করেছে?
আমি বললাম,
-গতকাল
ও দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-সব মিথ্যে কথা।গতকাল বেলী তোমাকে ফোন করতেই পারে না।এসব অন্য কেউ বলেছে তোমাকে।
আমি স্থির চোখে ওকে দেখছিলাম। আমার নয় বছরের ভালোবাসার মানুষটার সত্যকে মিথ্যা বানানোর প্রাণান্তকর লড়াই আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম।তারপর ওরই কথার সূত্র ধরে জানতে চাইলাম,
-তুমি কীভাবে এতটা ওভারশিউর হচ্ছো যে বেলী ফোন করতে পারে না?
ও দৃঢ়তার সাথে আমার চোখে চোখ রেখে বললো,
-কারণ বেলী গত তিনদিন সারাক্ষণ আমার সাথেই ছিল। আর রাতে আমার আগে ও ঘুমিয়ে পড়তো। তোমাকে ফোনটা ও করলো কখন? সত্যি করে বলো তোমার কাছে কে এসেছিল?
হালচাষের সময় বজ্রাঘাতে মৃত্যুর আগমুহূর্তেও যেমন কৃষক জানতে পারে না তার আসন্ন মৃত্যুর বার্তা আমিও তেমনি বুঝতে পারিনি ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে আমার কাঁচের মতো ভঙ্গুর হয়ে যাওয়ার তথ্য। আমি বজ্রাহত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার মানে কুষ্টিয়া যাবার নাম করে ও বেলীকে নিয়ে প্রমোদভ্রমণে বেরিয়েছিল। ওকে ঘৃণা করবো কি,নিজের প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা হচ্ছিল।আমি এতটাই ব্যর্থ এক নারী,যে তার স্বামীকে ধরে রাখতে পারেনি। কথাটা বলে ও নিজেই নিশ্চুপ হয়ে গেলো। ও বুঝে ফেলেছে,যে গুলি বেরিয়ে গেছে তাকে আর ফেরানো যাবে না।আমি উঠে গেলাম ওর সামনে থেকে।

চিৎকার করে কাঁদতে পারলে ভালো লাগতো,কিন্তু কান্না আসছে না। ছোটবেলা থেকে শুনেছি,অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর। আমি কি তবে পাথর হয়ে গেলাম! বারান্দায় গিয়ে বসে রইলাম। এখন আমার কী করা উচিত? এম এ পাশ করে ঘরে বসেছিলাম শুধু ওর কারণে।ও পছন্দ করতো না ঘরের বউ চাকরি করা।অথচ ঠিকই চাকরিজীবী প্রেমিকা জুটিয়ে নিয়েছে।আমি যখন নিজের সমস্ত সত্ত্বাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ওর সংসার গুচাচ্ছি,সন্তান সামলাচ্ছি, ওর যাতে বেশি পরিশ্রম না হয় তা ভেবে বাজারটাও নিজের হাতে করছি তখন ও প্রতিটি মুহূর্তে আরেক নারীকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনছে। তাকে বিয়ে করে আলাদা ফ্ল্যাটে রাখার আশ্বাসও দিয়েছে।তাকে নিয়ে প্রমোদভ্রমণও সেরে এসেছে। দিদি বলেছিল ছবিগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে ওদের ঘনিষ্টতা চরমে পৌছেছে। তিনদিন তিনরাত অন্য নারী নিয়ে বাইরে কাটিয়ে এলো।আর কী বাকী আছে! আর এই বোকা আমি কিছুই ধরতে পারিনি। প্রতিটি মুহূর্তে ঠকে গেছি,অথচ কিছুই জানতে পারিনি। এভাবে ঠকালো আমাকে ও! অথচ ও প্রাপ্য সম্মান ঠিকমতো পায় না বলে আমি বাবার বাসায় পর্যন্ত যাই না। তার প্রতিদান দিলো ও আমাকে এভাবে?
না,সম্ভব না ওর সাথে আমার আর একত্রে থাকা। আমার শিক্ষা আছে,ঠিকই একটা কিছু করে খেতে পারবো। কাল সকালেই স্বপ্নকে নিয়ে আমি চলে যাবো।খুব কষ্ট হবে আমার এই ছোট্ট সংসারটি ছেড়ে থাকতে। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। একজন ঠকবাজ,প্রতারকের সাথে সংসার করা চলে না। ও বেলীকে বিয়ে করে নিজের মতোই থাকুক। সারাটা রাত এসব ভেবে ভেবে বারান্দাতে কাটিয়ে দিলাম। ও এলো না আমাকে রুমে ফিরিয়ে নিতে।
সকালবেলা আমি আমার রুমে ঢুকলাম। তারপর বড় স্যুটকেসটা নামিয়ে কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিলাম। স্বপ্নকে তুলে সাজিয়ে নিলাম। ও অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমি কি ওকে ঘুমন্ত রেখেই চলে যাবো? না, তাহলে পলায়ন হয়ে যাবে। আমি পালাবো কেন? আমি ওকে ত্যাগ করবো। দৃঢ়তার সাথেই ত্যাগ করবো।
স্বপ্নকে বললাম বাবাকে ডেকে তুলতে। তিনবছরের স্বপ্ন ‘পাপা পাপা’ করে ধাক্কাতে লাগলো ওকে। ও চোখ খুললো। স্বপ্নকে জড়িয়ে ধরে ও আমার দিকে তাকালো। আমাকে শাড়ি পরা আর হাতে স্যুটকেস দেখে মনে হয় কিছুটা অবাক হলো। আমার গলা কাঁপছিল, ভয় হচ্ছিল কথাগুলো ঠিকমতো বলতে পারবো কিনা,কারণ আমি যে ওকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিলাম।ওকে ছাড়া জীবনে চলতে হবে কখনো তো ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবিনি। আমি ভেঙে পড়ছিলাম ভীষণভাবে।তীব্র কষ্টকে চেপে রাখতে গিয়ে গলায় চাপ চাপ ব্যথা অনুভব করছিলাম,কিন্তু আমার মনকে শক্ত করতে হবে,ঘুরে দাঁড়াতে হবে আমাকে। আমি খুব শান্ত গলায় ওকে বললাম,
-আমি চলে যাচ্ছি। তোমার সবকিছু রেখে গেলাম।আমাকে কখনো ফেরাবার চেষ্টা করো না। তোমার জীবন তুমি তোমার মতো করে সাজিয়ে নিও।
ও ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
কিছু একটা বলতে চাইলো। আমি হাতজোড় করে বললাম,
– প্লিজ কিছু বলো না। আমি শুনতে চাই না।
ও উঠে বসলো। স্বপ্নকে কোলে নিতে চাইলো,আমি স্বপ্নকে দ্রুত কোলে তুলে নিলাম।তারপর আরেকবারও পিছু না ফিরে স্যুটকেসটা নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম।সিঁড়ি ভেঙে নিচে আসার সময় বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। এ সিঁড়ি আমি আর কখনো মাড়াবো না। তিল তিল করে গুছিয়ে আনা সংসারে আমি আর ফিরবো না। তবুও আমায় এগুতে হবে। যেতে হবে বহুদূর। হোক না সে পথ যতই বন্ধুর।