রূপা খান খুব মিষ্টি স্বভাবের এক ভদ্র মহিলা। গুছিয়ে কথা বলে, অল্পতে মানুষকে আপন করে নিতে পারে। একদিন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসার সময় বিমানে আমার পাশের সিটে বসেছিল রূপা খান। প্রথমে পরিচয় তারপর শুরু হলো গল্প। আমারা দুজন দুজনকে আপু বলে সম্বোধন করে কথা বলা শুরু করলাম। রূপা আপুকে জিজ্ঞেস করলাম ছেলেমেয়ে কয়জন। উত্তরে বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো ছিলো দুই মেয়ে কিন্তু এখন একমেয়ে আছে, বড় মেয়ে মারা গেছে প্রায় আট মাস। বলতে বলতে দুই চোখের পানি টপটপ করে পড়তে থাকলো রূপা আপুর। আমি কি বলবো, কি বলে রূপা আপুকে সান্ত¦না দিবো বুঝতে পারছিলাম না। মনটা ভীষণ ভারী হয়ে গেলো মুহূর্তেই। একটু পরে রূপা আপু বলতে শুরু করলো মেয়ের কি হয়েছিলো, কিভাবে মারা গেলো। রূপা আপুর বড় মেয়ে যখন দশম শ্রেণিতে পড়তো তখন মেয়ে প্রায়সময় মাথা ব্যথার কথা বলতো, রূপা আপুর মেয়ে আগে থেকেই চশমা পড়তো, তাই মনে করতো চোখের সমস্যা। চোখের ডাক্তারের কাছে গেলো, ডাক্তার চোখ পরীক্ষা করে দেখলো, ডাক্তার বললো চশমার পাওয়ার আগে যা ছিলো তা থাকবে। চোখের কোনো সমস্যা আছে বলে মনে না। মেয়েকে নিয়ে বাসায় আসলো, চিন্তা করলো সামনে এস.এস.সি পরীক্ষা তাই পড়ালেখার চাপ বেশি সে জন্যই হয়তো মাথাব্যথা লেগে থাকে। এভাবে চলতে থাকলো, বেশি ব্যথা করলে ব্যথার ঔষধ খেয়ে সারানোর চেষ্টা করতো। পরীক্ষা শেষ হলে মেয়েকে কলকাতা গিয়ে আবার চোখের ডাক্তার দেখাবে মনস্থির করলো। সময়মত পরীক্ষা হয়ে গেলো। পরীক্ষা শেষে সপরিবারে কলকাতা গেলো, ডাক্তার দেখানো আর ঘুরাঘুরি দুটাই ইচ্ছা। যাওয়ার পর চোখের ডাক্তার দেখানো হলো কিন্তু কোনো সমস্যা পাওয়া গেলো না। রূপা আপু আর রূপা আপুর স্বামী ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো, রূপা আপুর স্বামী বললো একটা ব্রেইনের ডাক্তার দেখালে ভালো হয়। ডাক্তার দেখালো, ডাক্তার মাথার সব টেস্ট দিলো।
টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে রূপা আপু আর তার স্বামী আসলো ডাক্তারের কাছে, রিপোর্ট দেখে ডাক্তার মাথা নেড়ে বললো, অনেক দেরী করে ফেলেছেন। আপনার মেয়ের ব্রেইন টিউমার। শুনে যেন দুজনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। চোখের পানি যেন আর থামতে চায় না। মেধাবী মেয়েকে নিয়ে মা-বাবার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। এ মেয়ের মাথায় এত বড় রোগের সৃষ্টি হয়েছে তা কল্পানার ও বাইরে ছিলো। কলকাতার বড় এক হসপিটালে মেয়ের টিউমার অপারেশন হলো। দুই তিনটি কেমো দেয়ার পরে দেশে চলে আসলো। মেয়ের অবস্থা ভালো না। মা-বাবার চোখের সামনে মেয়ে এতো কষ্ট পাচ্ছে এটা রূপা আপু আর রূপা আপুর স্বামী সহ্য করতে পারছে না । কি করলে মেয়ে ভালো হয়ে যাবে এ নিয়ে চিন্তায় কান্নার যেন বাঁধ ভেঙে গেছে। মেয়ের অবস্থার অবনতি দেখে ঢাকার নামকরা হসপিটালে ভর্তি করালো। কেমোর যন্ত্রণায় আর রোগ যন্ত্রণায় মেয়ের জীবন প্রদীপ প্রায় নিবু নিবু, পাশে বসে আছে অসহায় মা-বাবা। চোখের পানি আর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এভাবে কষ্ট পেয়ে হসপিটালে বিশ দিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে রূপা আপুর মেয়ে চলে গেলো দুনিয়ার মায়া ছেড়ে। উফ, এতো কষ্ট শুনতে শুনতে মনে কষ্টের বন্যা বয়ে গেলো আমার। কি সান্তনা দিবো! কষ্ট ভীষণ কষ্ট। রূপা আপুর পাশে বসা ছোট মেয়ের দিকে দেখিয়ে বললাম, কি করবেন আপু যে চলে গেছে সে তো আর আসবে না, ছোট মেয়েকে দিয়ে আপনার সব স্বপ্ন পূরণ হউক, আর দু:খ ভুলার চেষ্টা করুন, দোয়া করি। বলতে বলতে আমি ও কেঁদে ফেললাম। রূপা আপু বললো হে আপা আর কি করবো! রূপা আপু আমাকে বললো, জানেন আপা আমার ইচ্ছে করে মেয়েকে যদি টেনে একটিবার বুকে জড়িয়ে আদর করতে পারতাম! বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম মূহুর্তের জন্য। একটি মায়ের আকুল ইচ্ছে ও ভালোবাসা পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথে তুলনা হয় না।
সন্তান সে তো বুকের মানিক
নি:শ্বাসের চেয়ে ও আপন,
প্রেম, ভালোবাসায় জড়াজড়ি
মা ও সন্তানের ভুবন।