“আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই।” কবির কবিতার এ আহ্বানের সুরেই, খেলার অনুষজ্ঞ বন্ধুদের মুখ, সান্নিধ্য! আহা!! সে সময় তথা আমাদের শৈশব কতো রকম খেলা-গোল্লাছুট, এক্কাদোকা-দাড়িয়াবাধা, হাডুডু-কাদামাটি আর ধুলোতে মাখানো শৈশব!
হারিয়ে যাচ্ছে আনন্দময় সেই শৈশব! এখন শৈশব মানে কাঁধে ভারি বইয়ের ব্যাগ-পাবলিক পরীক্ষার চাপ, কোচিং সেন্টার-অভিভাবকের ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতায় চিড়েচ্যাপ্ট। শৈশব! অবসরে মোবাইল, কার্টুন মোটু পাতলু ইত্যাদি-করোনাকালীন সময়ের পর থেকে শিশুদের জীবন মানে ‘অনলাইন’ স্কুলে নেই মাঠ, নিয়মিত সাংস্কৃতিকচর্চা বা সৃজনশীল অনুশীলন। আর পরিবারতো ‘নিউক্লিয়ার! যৌথ পরিবারের সবার সান্নিধ্যে হাসি, আড্ডা-আনন্দ-দাদী-নানীর মধুর বন্ধনে রূপকথার জগৎ নেই-তাইতো কল্পনার বিকাশ ও কই! নেই-নেই! ব্যস্ত! ব্যস্ত মা ও বাবা উভয়েই অতএব এক বছরের শিশুর হাতেও মোবাইল। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন-‘একজন শিশুর প্রতি ১১০ গ্রাম মস্তিষ্ক টিস্যুতে প্রতি মিনিটে ৫৫ মিলিমিটার রক্তের প্রবাহ দরকার, ৫.৫ মিলিগ্রাম গ্লুকোজ দরকার, ৩.৫ মিলিমিটার অক্সিজেনের প্রবাহ দরকার যা শিশুর মেধার বিকাশ সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত শাণিত স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। এক্ষেত্রে বলতে হয় পরিবারের পরিবেশ কি তেমন স্বাস্থ্যসম্মত! উদ্বেগমুক্ত শান্তি ও সহাবস্থানের পরিবেশ-একই সাথে মায়া মমতা ও ভালোবাসার বন্ধন।
এ বিপন্নতায় বিশ্বের প্রায় ৯০০ মিলিয়নের মতো শিশুর শৈশব, সিরিয়া, আফগানিস্তান ইউক্রেন সহ বিভিন্ন দেশের সাথে মিয়ানমারের শিশু এবং আমাদের দেশের প্রান্তিক শিশুদের সাথে আদিবাসী শিশুরাও সহিংস অবস্থান যেমন দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, অপহরণ, পাচার হত্যা, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি নানামুখী নেতিবাচক সূচকের ক্রামগত উর্ধ্বগতি নেতিবাচক সূচকের ক্রমাগত উর্ধ্বগতি ২০১৭ সালের সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে-‘হারিয়ে যাওয়া শৈশব’ এ শিরোনামের সাতটি সূচক তথা শিশু মৃত্যুর হার, অপুস্টি, শিক্ষাবঞ্চিত শিশুর হার, শিশুশ্রম শিশু বিবাহ ও শিশুর প্রতি সহিংসতা” বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৪। এ পাঁচ বছরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুণগত অবস্থানের উর্ধ্বগতি এলেও এখনো হতাশজনক। অবস্থানগত দিকে দেশের শিশুরা বিত্তশালী, উচ্চ ও মধ্য নি¤œবিত্ত বস্তিবাসী পথ শিশু আদিবাসি শিশু ও গ্রামের শিশু বৈষম্যের শুরু এখান থেকেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রায় সব শিশুর অবস্থান নেতিবাচক।
শিশু শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখি প্রাথমিক শিক্ষার ১১টি ভাগে বিভক্ত। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এরচাইতে বড়ো গলদ আর কি হতে পারে?
বিভাজনের পদ্ধতিতে বেড়ে ওঠা শিশুরা যথাযথ ভাবে বিকশিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারা কঠিন। এছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এসব বিষয়ে চর্চা কতোটা, শিশুদের মনে দেশে প্রেমের ভিত রচনা কি হচ্ছে যথাযথভাবে আরও কিছু অনুষঙ্গ এসে যায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সুযোগ অনেক কিন্তু গ্রামাঞ্চলে, পাহাড়ি এলাকায় অবকাঠামোগত সমস্যার সাথে যুক্ত হয়েছে গুণগত মান, শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত। আনন্দের সাথে পাঠদান হচ্ছে কি? আছে কি খেলার মাঠ বা হচ্ছে কি সুস্থ বিনোদন চর্চা। নৈতিক শিক্ষা দানেও কতোটা সদিচ্ছা যেমনটি আমাদের শৈশব বাল্য শিক্ষার বইগুলোতে পেতাম।
এর সাথে যুক্ত শিশু শ্রম ও পাচার শিশুদের প্রতি নির্যাতন শিশুর মতামত বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে আন্তরিক কতোটা পরিবার? বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ব্যাপারে কতোটা ইতিবাচক মনোভাব রাষ্ট্রের! এগুলোর নেতিবাচক প্রভাবে শিশুর শারিরীক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ একই সাথে নৈতিক বিকাশও। যথাযথ সামাজিকীকরণ কি হচ্ছে? বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। শিশুর সার্বিক বিকাশে আইন অনেক কিন্তু বাস্তবায়নে পিছিয়ে কি করা দরকার।
প্রথমত প্রয়োজন চিরায়ত শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন পরীক্ষামুখী নয় তাদের জন্য প্রয়োজন আনন্দ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা।
শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে দু’টো ক্ষেত্র পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন সঠিক পদ্ধতি এবং আনন্দের সাথে শিক্ষা প্রদান একই সাথে সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবেশ সৃষ্ট করা প্রয়োজন ভাল সমৃদ্ধ শিক্ষার পরিবেশ-বয়স, রুচি ও সামর্থ অনুযায়ী যা তৈরি করতে হবে। সাংস্কৃতিক বাতাবরণের প্রয়োজন- শিশুর হাতে মোবাইল না তুলে দিতে হবে রঙিন বই, রঙতুলি- পাবলিক পরীক্ষার কঠিন চাপ থেকে তাদের বের করে আনার সঠিক পদ্ধতি অবশ্যই তৈরি করতে হবে।
প্রতি বছরের বইমেলায় বাংলা একাডেমি শিশুদের জন্য শিশুকর্ণারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে-এখন শিশু সাহিত্যিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে আন্তরিকভাবে যাতে ঐতিহ্যবাহী অতীতের মতো তাদের হাতে সমৃদ্ধ সাহিত্য তুলে দেই। শিশুদের যথাযথ মানসিক বিকাশে সঠিক শিশু শিক্ষাদান পদ্ধতি যদি তৈরি করা না যায় তাহলে ‘কিশোর গ্যাং’ নামক যে অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজে মাথাচাড়া দিয়েছে তা থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।  লেখক : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ।