প্রতিদিন সকাল সাতটায় চট্টগ্রাম থেকে সুবর্ণ ছাড়ে। আজ ও ব্যতিক্রম নেই। একটি মেয়ে দৌঁড়ে এসে বলে,ভাইয়া আপনি এই সিটে বসবেন? জানলার পাশে বসতে স্বাচ্ছন্দ মনে করি।
ছেলেটি না করে না। পাশের সিটে বসে।
সুবর্ণ ছুটছে। কোন সিট খালি নেই। একটু পরে চা-নাস্তা আসে। ছেলেটি সকালের নাস্তাা করে নি। তাই সে অর্ডার দেয়। ডিম, পাউরুটি, চা।
ছেলেটি খায়।
মেয়েটি ব্যাগ থেকে রুটি ডিম বের করে খায়। সঙ্গে ফ্লাক্স থেকে চা।
যথা সময়ে সুবর্ণ থামে কমলাপুর রেল ষ্টেশনে। সবার সাথে ওরা ও নামে।
তোপখানা রোডে সস্তায় হোটেলরুম আছে। ছেলে- মেয়ে আলাদা থাকলে ও নিরাপদ। এটার একটা সুনাম আছে। ছেলেটি আগে পরপর মেয়েটিও একই হোটেলে। হোটেল ম্যানেজার দুইজনরই পরিচিত মনে হয়। তা’তে খুব অসুবিধে, ভয় কোনটাই নেই।
সকাল হতেই ছুটোছুটি। দুইজনেরই ইন্টারভিউ আছে। একই সময়ে দু’জন হোটেল থেকে বের হয়। পরীক্ষার হলে দু’জন মুখোমুখি। বাংলাদেশ কৃষিব্যাংকে চাকরির পরীক্ষা। অতি সাধারণ চাকরি।
বিকেল সাড়ে তিনটায় কমলাপুর রেল ষ্টেশনে আবারও দু’জনের দেখা। পাশাপাশি বসা।
কি করে হয় সবকিছু। এটা কি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেতে হচ্ছে। গত দু’দিন ধরে তাইতো হচ্ছে এদের, কি করে সম্ভব? ট্রেন ছুটছে। কারো কথা নেই। দু’জনেই অতি সাধারণ ঘরের। আহামরি তেমন কিছু নেই। চায় শুধু একটি চাকরি। পেটে দু’মুঠো ভাত,আর ডাল হলেই যথেষ্ট।
এমনিতে ছেলেরা সবকিছুতে সাহসী হয়। আজ কিন্তুু তা’ নয়। মেয়েটি মুখ খোলে প্রথম।
– আমি শুভশ্রী, আপনি?
কিছুক্ষণ নীরবতা। ছেলেটি চুপ। চুপ দেখেই শুভশ্রী আবারও বলে,
– আমি শুভশ্রী, আপনি?
– স্বপ্নদীপ আমি। ছেলেটি একটু লাজুক। তাই দেরীতে উত্তর দিলো।
ট্রেনের জানলা খোলা। বিপরীত হাওয়ায় শুভশ্রীর চুল উড়ছে। উড়ো চুলে হাত রেখে বলে,
– বাসা কোথায়? শুভশ্রীর দ্বিতীয় প্রশ্ন।
– আপনার বাসা কোথায়? ছেলেটি সাহসী সুরে উল্টো জিজ্ঞেস করে।
শুভশ্রী ঠোঁট কামড়ে হাসে। মনেমনে বলে,ছেলেটি যত বোকা ভেবেছি তা’ নয়।
– আসকার দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে। শুভশ্রী উত্তর দেয়।
ছেলেটি লাফিয়ে উঠে বলে,
– আমার ও বাসা আসকারদিঘীর দক্ষিণ পাড়ে।
– আমার চাকরিটা হবেতো! শুভশ্রীর প্রশ্ন।
– সব যখন হচ্ছে, হয়তো হবে।
– জানেন স্বপ্নদীপ,চাকরিটা আমার ভীষণ প্রয়োজন। না’হলে মা, ছোট ভাইটি না খেয়ে মরবে।
– বাবা কি করেন?
– ক’ বছর হলো মারা গেছে। ভাইটির কিছু হলে চিন্তা নেই। এখনও পড়ছে।
– কি পড়ছে?
– চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে এম বি এ ফাইন্যাল।
– সেতো ভালো কথা। আপনার চাকরি হয়ে যাবে। কিছুদিন পরে আপনার ভাইয়ের।
– আপনার চাকরি ও কি খুব প্রয়োজন?শুভশ্রী প্রশ্ন করে।
– প্রয়োজন বলেইতো ইন্টারভিউ দেয়া।
– বাসায় কে আছে?
– কেউ নেই,আমি একা।
– স্বপ্নের মতই আপনার জীবন। তাই আপনার নাম স্বপ্নদীপ। বেশ দারুণতো! শুভশ্রী আবেগী গলায় বলে।
– সেভাবে বলছেন কেন? স্বপ্নদীপের ফিরতি প্রশ্ন।
– পিছু টান নেই। কারো শাসন, দায়িত্ব নেই,স্বাধীন জীবনযাপন। খুব সুখ, আনন্দের জীবন।
– পৃথিবীতে সুখ- আনন্দ ক্ষনিকের। দুঃখটা চিরদিনের। কথাটা আমার নয়। তথাগত শাক্যমুণি বুদ্ধের।
– আপনি বুড্ডিষ্ট?
– ঐ প্রশ্ন কেন?
– বুদ্ধ দর্শনের কথা বলছেনতো, তাই প্রশ্ন করলাম।
– পৃথিবীর সকল ধর্ম একই কথাই বলে। শান্তির কথা,,মানুষের ভালোবাসতে,দুখে পাশে দাঁড়াতে বলে। সবার উপরে মানুষ সত্য, সেই মানবতার কথাইতো প্রত্যেক ধর্মের শেষ কথা।
ট্রেন থামে রাত এগারটায়।
এবার আলাদা নয়। দুইজনের গন্তব্য এক। এক ট্যাক্সিতে দু’জন উঠে। কারো বাসা দূরাদূরি নয়।
কি আশ্চর্য দুইজনরই চাকরি হয়। আগ্রাবাদে অফিস। এক সঙ্গে যায়। অফিসের গাড়ী আসকারদিঘীর উত্তর পাড়ে দাঁড়ায়। জীবন চলে।
একদিন শুভশ্রীর ভাইয়ের চাকরি হয়। ভালো বেতনের চাকরি। ওদের পরিবারে সুখ থইথই করে।
আর একা জীবন ভালো লাগে না স্বপ্নদীপের। সে বিয়ে করে একাকীত্বকে দূরে তাড়াতে চায়। একদিন অফিস ছুটির পরে স্বপ্নদীপ বলে,
-শুভশ্রী একটা কথা ছিলো।
– কি কথা? বলো।
– এখানে নয়। চলো নির্জনে কোথাও,পার্কে, নাহয় রেষ্টুরেন্টে।
– ওমা, সে- কি অমন গুরুত্বপূর্ণ কথা, এখানে বলা যাবে না! ঠিক আছে চলো আগ্রাবাদ শিশু পার্কে যাই। অফিসের কাছেই।
দুইজনে পার্কে যায়। নির্জন জায়গা বেছে নিয়ে মুখোমুখি বসে।
স্বপ্নদীপ ভয়ে কথাটা বলতে পারে না। যদি শুভশ্রী কিছু মনে করে।
শুভশ্রী সাহসী। সহজে বলে,
– কি বলবে, বলো?
স্বপ্নদীপ শুভশ্রীর হাতের উপর হাত রাখে। এটাই প্রথম স্পর্শ দু’জনের। যেন আন্তরিক ছোঁয়া। স্বপ্নদীপের পুরো শরীরটা কাঁপে। শুভশ্রীর উপলব্দি হয় সেটা। দেরী না করে বলে,
– দীপ, কি বলবে বলো?
– আমার একা জীবন ভালো লাগে না। এবার বিয়ে করতে চাই।
– সেতো ভালো কথা। বিয়েটা করো। সংসারী হও।
– তোমাকে বিয়ে করতে চাই শুভশ্রী। তোমার, মায়ের আপত্তি আছে? দীপের কথা শোনে শুভশ্রী চুপ।
কথা নেই। শুভশ্রীর ঠোঁটে নির্মল হাসি।
ঠিক একদিন বিয়ে হয় দীপ- শুভশ্রীর।
সুখ আনন্দে সংসার চলছে। বছর পেরুতেই এক সন্তান আসে তাদের ঘরে। ফুটফুটে ফর্সা। কি ভাগ্য, একমাসের মাথায় ছেলেটি মারা যায় নিমুনিয়াই। সুখের ঘরে অন্ধকারের হাতছানি।
দু’জনের মন বিষন্নতায় ভরে যায়। চাকরি, দিন কাটা ভালো লাগে না কারো।
এভাবে বছর যায়। দেড় বছর পরে আবারও শুভশ্রীর কোলে আসে সন্তান। সে ও মারা যায়। এবারও নিমুনিয়াই । কি কারণ কেউ বোঝে না। দুইজনের মন ভেঙে চুর। কোন কিছুতে মন বসে না। কি চাকরি কি সংসারে। শুভশ্রীর মায়ের কথায় ডাক্তার দেখায়। কেন ছেলে বাঁচে না।
দীপ বলে,
– এখানে ডাক্তার কি বলবেন। সন্তানতো ঠিকভাবেই পৃথিবীতে আসে। অসুখে মারা যাচ্ছে। আর কথা হয় না কারো।
দিন যায়। নীরবে, নির্জনে, নিঃসঙ্গতায়।
এখন দুইহাজার বিশ সাল,মার্চ। শুভশ্রী আবার ও মা হবে। কিছুদিন পর। এবার আগের চেয়ে বারবার ডাক্তারের পরামর্শেই ছিলো। সচেতন ও।
সেদিন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।
জানলার পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছে শুভশ্রী। পাশে স্বপ্নদীপ।
শুভশ্রী বলছে,- দীপ, দেখেছ করোনা আসার পরে কি সুন্দর আকাশ। এরকম আগে কোনদিন দেখেছ? কি নির্মল। চারপাশে সুবাতাস বইছে। করোনা ভাইরাসে পুরো বিশ্বটা পাল্টে গেছে। দিনে রাতে ধুলো, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া নেই। কলকার খানার হইচই নেই, কর্ণফুলি, সুরমা, বুড়িগঙ্গার কোলে আবর্জনা নেই। আকাশে প্লেনের ধোঁয়া নেই। কি সুন্দর পৃথিবী! পৃথিবীটা কতদিন পরে প্রান খুলে হাসছে।
শুভশ্রীকে থামিয়ে স্বপ্নদীপ বলে,
– করোনা আমাদের অনেক দিয়েছে। নতুন করে জীবন পথে চলার শিক্ষা দিয়েছে। হয়তো অনেক মূল্যবাণ জীবন কেড়ে নিয়েছে।দেখো, সত্যিই, প্রকৃতি আজ ভীষণ খুশি। জলবায়ু পরিবর্তনের কথার কি প্রয়োজন?দেখেছ আজ প্রকৃতি ও হাসছে,গাছ নির্মল অক্সিজেন ছাড়ছে, মানুষেরা অবলীলায় তা’ গ্রহন করছে। বাগাণের ফুল সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। চতুর্পাশে কি আনন্দের ছোঁয়া! যেন পৃথিবী অনেক বছর পরে সকল অনাচার থেকে স্বস্হি পেয়ে প্রান খুলে হাসছে।
– শুনেছ, কত মানুষ মরছে করোনায়, আরো কত মরবে কে জানে?শুভশ্রী বলে থামে না। বলে, বেশি মানুষ মরছে তারা পৃথিবীকে শাসন করেছে যারা। এটা বড়ো পাপ। নিরীহ মানুষের উপর ব্যবসায়ী লোভ মনোচিত্তে শাসন। লক্ষলক্ষ মানুষ বোমা,গুলিতে মারা কত অন্যায়! দেখেছ সেই ক্ষমতাধর দেশেই পারছে না, করোনায় তাদের দেশের মানুষ মারা থামাতে। বের করতে পারছো সেই মহা প্রান ঘাতক ওষুধ তৈরী করতে। অথচ কুটিকুটি ডলার খরচ করে চাঁদে যাচ্ছে! চাঁদে হানিমুনের স্বপ্ন দেখছে, কি অদ্ভুত!
এবার দীপ বলে,
– জানো শুভশ্রী,বুদ্ধ বলেছেন, পৃথীবীতে সব কিছু পরিবর্তনশীল। কিছুই চিরস্হায়ী নয়। পৃথিবী জুড়ে যেই অন্যায়,অবিচার, অত্যাচার চলেছে, তা’ থামবার সময় এসেছে এবার। এসব থামাতে মানুষের বোমা,গুলির প্রয়োজন নেই, করোনায় যথেষ্ট। একদিন হয়তো থামবে সব অন্যায়,অবিচার।
– না, থামবে না।
– কেন থামবে না শুভশ্রী?
– মানুষ মাত্রই লোভী,তৃষ্ণাতুর,রাগী। এসব থাকলে থামবে কিভাবে?তবে এই শিক্ষায় পৃথিবীর সকলের একটি কাজ করা নিতান্ত প্রয়োজন। তা’ হলো বছরে একবার পনর দিনের জন্য লক ডাউন করা। তা’তে পৃথিবী বাঁচবে। মানুষ বাঁচবে নিরাপদে। আমাদের দেশের মানুষতো কথা শোনে না। সরকার বারবার বলার পর ও সবাই বেরুচ্ছে। বিদেশীরা বেরুচ্ছে না ঠিকই। তবু ও তারা মরছে কিন্তু অনেক। আমাদের দেশে মরতে শুরু করলে থামাবে কে? পৃথিবীতে এখন ও করোনার ওষুধ নেই। সব জেনে অন্যায় ভাবে বেরুচ্ছি সবাই। তার উপর নেতাদের উস্কানীমুলক কথা। এইতো সুবর্ণ সুযোগ সরকারকে ঘায়েল করার উপযুক্ত সময়।
– তুমি ঠিকই বলেছ। কাল কি হবে কেউ জানি না। তবু কেন এসব করছে ওরা। এই করোনাতো তাদের ও হতে পারে!
ছাব্বিশে মার্চ সকালে শুভশ্রীর ঘরে আসে এক ছেলে। পাশে স্বপ্নদীপ। কারো মুখে হাসি নেই। ভয়ে জবুথবু দু’জন।
চতুর্দিকে করোনার যুদ্ধ। করোনার ঐ যুদ্ধকেে পরাস্ত করতে পৃথিবীর সবাই সোচ্চার, প্রতীজ্ঞাবদ্ধ।
পৃথিবী আজ স্তব্দ,শান্ত,নীরব। কোথাও কোলাহল নেই।
ইশারায় শুভশ্রী স্বপ্নদীপকে ডাকে।
স্বপ্নদীপ কাছে আসে।
শুভশ্রী বলে,
– ছেলের কি নাম রাখবে ভেবেছ? দেখেছ কি সুন্দর হয়েছে তোমার ছেলে।
– কেন? আগের সন্তানেরা ও কি কম সুন্দর ছিলো।
– হয়তো ছিলো! তখনকার সময়, এবং এখনকার সময় কিন্তু এক নয়, ভিন্ন।
– সেটা আবার কি রকম?
– এখন পৃথিবী জুড়ে করোনার যুগ। তাই আমার ছেলের নাম রাখলাম করোনা।
– সেই নাম কেন রাখবে? খুব সাংঘাতিক। বিপদগামী, ভয়ানক সে।
– যাই হোক, করোনা মানে ভয়,আতংক। আর কেউ,কোন অসুখ আমার ছেলেকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। আমার ছেলে নাম করোনা।
ঠিক তখন সূর্যের স্নিগ্ধ ভোরের আলো জানালার পর্দার ফাঁকে করোনার মুখে পরে।
করোনা ঘুম চোখে হাসে।