সারা জীবন ধরে যাঁরা নিজের জীবন উৎসর্গ করে অনেক পরিশ্রম করে আমাদের জীবন গড়ার কাজে ব্যস্ত আজ তাঁদের কথা বলছি। এঁরা ছড়িয়ে আছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। ঘরে, ক্লাসরুমে, গানে- বাজনায়, খেলার মাঠে, অভিনয়ে – শিল্পে প্রযুক্তিতে সর্বত্র। এঁদের ছাড়া আমরা এক পা-ও চলা সম্ভব না। এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। এমনকি আমাদের কর্মক্ষেত্রেও এরা নিজেদের জায়গা করে নেন অবলীলাক্রমে। এঁরা সত্যিই সকলের ভাল চান আর ভালবাসেনও।এই ভালবাসা একান্তই মানসিক। তাঁদের স্বার্থ আর চাহিদার জায়গা শুধু একটাই তুমি মানুষ হও। কারণ তুমি মানুষ হলেই আমার তৃপ্তি। তাই এরা আমাদের বেয়াদপি, বেচালপনা সহ্য করতে পারেন না।চাহিদার একটু এদিক ওদিক হলেই জ্বলে ওঠেন, বকেন, কখনও মারেনও। সে যাই হোক না কেন উদ্দেশ্যটা সবসময়ই মহৎ।অর্থাৎ আমি শেষ চেষ্টা করব যাতে তুমি মাথা উঁচু করে সমাজের বুকে সমাজের বুকে চলাফেরা করতে পারো। এত কিছু পাওয়ার পরেও ছাত্র সমাজ কিভাবে চুপ করে থাকতে পারে? তারাও তো শিক্ষককে প্রতিদান কিছু দিতে চায় তাদের সাধ্যমতো।শিক্ষকরা যে, কতটা দায়িত্বশীল হতে পারে, সে প্রমাণ অনেকবার পেয়েছি। ইতিহাসের পাতায় পাতায় সে সব আমরা পড়েছি,জেনেছি। এবার আবার তার প্রমাণ পেলাম পৃথিবীজোড়া করোনা ভাইরাসজনিত এই অতিমারীর সময়ে। মাসের পর মাস ক্লাস বন্ধ। বাড়ির মধ্যে বসে তবুও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া। মনস্তত্ব আর মানসিকতার চ্যালেঞ্জ। কারও মুঠোয় স্মার্টফোন নামক বস্তুটা আছে, কারও নেই। এরপর ফল প্রকাশ পিছিয়েছে। চাকরির অফার লেটার পেয়েও চাকরীতে যোগ দেওয়া যাচ্ছে না।কচি আর কিশোর মনের থেকে ফিকে হয়ে যাচ্ছে চেনা পরচিত বন্ধু বান্ধবীদের ছবি। সব মিলিয়ে এক অসহনীয় অবস্থা। ঠিক সেই সময়েও শিক্ষকের জান লড়িয়ে পড়ুয়াদের পাশে থাকছেন। শুধু পড়াচ্ছেন বললে ভুল হবে। তাদের সুস্থ রাখা, মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার কাজটিও সমানে সমানে চালিয়ে গেছেন। শুধু পড়ানো নয়, অভিভাবকদের সঙ্গেও কথা বলেছেন, এসএমএস পাঠিয়েছেন, ই-মেইলও করেছেন। এমনকি লেসন প্ল্যানের ভিডিও লেকচারও করেছেন, সঙ্গে চলেছে গান বাজনা আর নানাধরণের আলোচনাও।সব থেকে বড় কথা ছাত্রছাত্রীদের ভালবেসেই শিক্ষক মহাশয়েরা এগুলো সম্ভব করেছেন হাসিমুখে। এই অতিমারীতেও তাই তারা অনবদ্য লড়াইয়ে বাজিমাত করেছেন। জিতে চলেছেন।এই ঝিমিয়ে পড়া অবস্থার মধ্যেও চিরাচরিত প্রথায় ছাত্র – শিক্ষকের মধুর মিলনে, বরণে প্রাণবন্ত। ছাত্র সমাজ ঠিক এই ধরণের শিক্ষক – শিক্ষিকাদের কাছে পেতে চান যারা প্রতিমুঃহূর্তে তাদের পাশে থাকেন।একেবারে বন্ধুর মতো। এগোনোর পথে কোথাও আটকে গেলে তারা শিক্ষকের কাছেই সবার আগে ছুটে যায়।ঠিক তেমনই তাদের সব থেকে ভাল খবরটাও সবার আগে পৌঁছে দিতে চায় শিক্ষকদেরই। তাঁদের প্রত্যেক কাজ এবং কথা- দুটোই শিক্ষনীয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন ” শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার সময়ে আর একটি বিষয় আমাদের স্মরণ রাখতে হবে – তাহারাও যাতে নিজের চিন্তা করতে শেখে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ” অর্থাৎ জানার শক্তি আমাদের পড়ুয়াদের মধ্যে আছে বটে, কিন্তু তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে।শিক্ষকদের কাছে পড়ুয়াদের এটাই আবদার। একজন শিক্ষক হিসেবে তাই আমাদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হলো আচার্য হিসেবে প্রত্যেক শিষ্যের অবস্থায় নিজেকে এমনভাবে নিয়ে যাওয়া যাতে তিনি নিজের শক্তির সঞ্চায়ণ ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে এমনভাবে ঘটাতে পারেন যা তাদের শিষ্যদের মধ্যে যাবতীয় নেতিবাচক ভাব দূর করে জাগিয়ে তোলে গঠনমূলক মনোভাব। জীবনের চল্লিশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এভাবেই নিজের বিশ্বভারতীকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শুধু পুঁথিগত শিক্ষা নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন তাঁর প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর সার্বিক বিকাশে। তিনি ইট কাঠে তৈরি চার দেওয়ালের বাইরে থেকে শিক্ষায়তনকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন মুক্ত মনের বিকাশের উপযোগী প্রকৃতির কোলে। এর আগে আমাদের দেশে যে কোন শিক্ষা ব্যবস্থাই আসতে পারেনি।এখানেই ফুটে উঠে কবিগুরুর সাহসী ও স্বচ্ছ চিন্তা।
ভাল শিক্ষকরা তাই সবসময় আমাদের রোল মডেল। তাঁরা বেঁচে থাকেন আমাদের মধ্যে বছরের পর বছর যুগের পর যুগ।এঁদেরকেই আমরা অনুকরণ করি আর স্মরণ করি। সেই শিক্ষকদের জানাই শ্রদ্ধা নিবেদন। কারণ তিনিই তার আারাধ্য দেবতা,যাঁর আশীর্বাদে অনেক ভাল হতে পারে ছাত্রছাত্রীর চিরজীবন।